ভোরবেলা ঘুম ভাঙল প্রবল শোরগোলে। শোবার ঘরের ঠিক বাইরে কে যেন চ্যাঁ-চ্যাঁ-চ্যাঁ-চ্যাঁ করে পরিত্রাহি চেঁচিয়েই চলেছে, আর সেই সঙ্গে আরও নানা পাখির ডাক — যার মধ্যে কাকের কা-কা, শালিকের কিচিরমিচির আর দূরে একটা কোকিলের ডাক মিলেমিশে একাকার। মনে হল, প্রধান চ্যাঁ-চ্যাঁ-টাও বোধহয় কোকিলেরই ডাক। কাক তাড়া করলে কেমন কিঁক্-কিঁক্ একটা শব্দ করে উড়ে পালায়, সেটাই কোনও ভাবে অতি কাতর হয়ে উঠেছে… কাক তাড়া করে ধরেই ফেলেছে বোধহয়…
অঘোর ঘুমের ঘোরের জাগাটাও ঘোর লাগা। তার মধ্যেই হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে দেখি, ও হরি! ছ-টা আট! সকাল হয়ে গেছে বলেই ঘরের ভেতরে এত আলো! এদিকে ওঠারও অবস্থা নেই, প্রচণ্ড গরমে অর্ধেক রাত ঘুমোতে পারিনি। চোখই খুলতে পারছি না। শিথিল হাত থেকে ফোন খসে পড়ল বালিশের পাশে; বাইরের হট্টগোল উপেক্ষা করে চোখটা আবার লেগে আসছে, মনে হল, আরে, প্যাঁচা আসেনি তো? একমাত্র প্যাঁচা আসলেই কাক, চড়াই, শালিক, ছাতারে বিহঙ্গসন্তানেরা সবাই ‘মিলে সবে’ পক্ষীকূলত্রাণে ব্রতী হয়ে ‘একতান মনপ্রাণ’ হয়ে কা-কা-ছি-ছি করতে লেগে যায়। আধোঘুমে এসব ভাবছি আর এর মধ্যে বাইরের ডামাডোলটা তীব্র আকার ধারণ করেছে ঠিক আমার ঘর-লাগোয়া বারান্দার বাইরে। আর্ত চ্যাঁ-চ্যাঁ রবে কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়! এই রে! প্যাঁচা বুঝি কোকিল শিকার করেছে আমার বারান্দার ঠিক বাইরে! না কি ভেতরে ঢুকেই পড়েছে? সর্বনাশ! তাহলে তো বারান্দায় রক্তারক্তি…
কোনোরকমে ঘুমচোখেই লাফ মেরে বিছানা ছেড়ে গিয়ে বারান্দার দরজা খুলেছি, রাতে বেড়ালের হাত থেকে বাঁচতে দরজা বন্ধ রাখতে হয়; যেমনই দরজা খোলা, প্রবল একরাশ ডানা ঝটপটানির সঙ্গে সঙ্গে একটা উড়ুক্কু প্রাণী ঘরে ঢুকে মেঝেতে আছড়ে পড়ল। শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে সরে গেছিলাম বলে আমার সঙ্গে ধাক্কা লাগল না, আক্ষরিক অর্থেই হিন্দিতে যাকে বলে একেবারে ‘বগল-দিয়ে’ অনুপ্রবেশ!
ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের ভেতরে আধবোজা দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারার আগেই তিনি দৃষ্টির অন্তরালে হারিয়েছেন — খাটের নিচেই ঢুকেছেন, আর যাবেনই বা কোথায়? খেয়াল হল বাড়ির ভেতর দিকের দরজাটা খোলা, Zena মর্নিং ওয়াকে যাবার আগে খুলে যায়। এই দরজা দিয়ে কোকিল, বা কোকিলের ছানা বাড়ির ভেতরে ঢুকলে বাড়ির বেড়ালদের হাত থেকে রক্ষা পাবার সম্ভাবনা কম। তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে খেয়াল হল হাতে ওয়েস্ট (পেপার) বাস্কেট। রিফ্লেক্স অ্যাকশনেই তুলে নিয়েছি। শিকারের পেছনে শিকারী ঢুকে পড়লে এই বাস্কেট চাপা দিয়ে তাকে রক্ষা করা যায়। যাকে দেখতেই পাইনি ঠিক করে, তাকে আবার বাস্কেট-চাপা! হ্যেঃ! দরজা বন্ধ করে ওয়েস্ট (পেপার) বাস্কেট-টা যথাস্থানে রেখে খেয়াল করলাম আক্রান্ত পাখির চ্যাঁ-চ্যাঁ আর শোনা যাচ্ছে না। প্যাঁচা নয়, সম্ভবত কাকেরাই দল বেঁধে আক্রমণ করেছিল। আধজাগা ব্রেনের ঘুমন্ত অংশকে জেগে ওঠা অংশ ধমকে বলল, প্যাঁচা কখনও সকালে শিকার করে? যত্তোসব!
কাকের দল বারান্দায় ঢুকতে পারেনি, বাইরে থেকেই কা-কা করে এখন একে একে উড়ে চলে যাচ্ছে। আমারও আর দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা নেই। রাত-জাগার পরে এই সময়েই ঘুম পায় আরও বেশি। বিছানায় শুয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখলাম খাটের নিচে।
কোকিল-টোকিল কেউ নেই।
গেল কোথায়? পাখিটা যেখানে এসে মেঝেতে আছড়ে পড়েছিল, সেখান থেকে খাটের নিচে ছাড়া আর কোথাও তো যাবার উপায় ছিল না। তবে কি আমি যখন দরজা বন্ধ করতে গেছি, তখন বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল? হতেই পারে, কিন্তু তখনও তো কাকেরা বাইরে ছিল!
তবে?
ভাবতে পারছি না, ঘুম আবার আচ্ছন্ন করছে, ঘুমিয়ে পড়ার আগে শুনতে পেলাম দূর থেকে চ্যাঁ-চ্যাঁ রব ভেসে আসছে — অর্থাৎ বেরিয়ে চলে-ই গেছে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। স্বপ্ন দেখছি খাটের নিচে কোকিল, বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে পা টিপে টিপে আসছে হুলো-টা, পাখিটা নড়ছে চড়ছে, খড়মড় শব্দ হচ্ছে… আমার ঘুম পাতলা হয়ে আসছে; মনে হচ্ছে — না, কোকিল হতে পারে না। যে পাখিটা উড়ে ঘরে ঢুকে পড়েছিল, সেটা অত বড়ো ছিল না। তবে কি শালিক? না, অত কালচে রং ছিল না। বেশ অনেকটাই সাদা ছিল। সাদা-কালো পাখি… একটু লাল, বা কমলার ছোঁয়া ছিল কি? তবে কি গুয়ে শালিক? সেটা হতে পারে…
কিন্তু খড়মড় শব্দটা যেন বাড়ছে? কাগজের মধ্যে ইঁদুর হাঁটলে যেমন হয়… পায়ের কাছে বইয়ের তাক, সেখানে…?
আবার ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। চোখের সামনে বইয়ের তাকের বইয়ের ফাঁক থেকে ছোটো-মতন সাদা-কালো পাখিটা উল্কার গতিতে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।
আরে, এ তো… ঘুম ছুটে গেল, তড়িঘড়ি বারান্দার খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখি বারান্দার দূরের কোনে গ্রিল আঁকড়ে খাড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। সাদা-কালো, তার মাথায় লাল টুপি, পিঠে ভাঁজ করা ডানাদুটো সোনালী!
ফ্লেম-ব্যাক! কাকের তাড়া খেয়ে বেচারা কাঠঠোকরা ঢুকে পড়েছিল ঘরে! গোলমাল মিটে গেলে এখন বাইরে বেরিয়েছে, কিন্তু গ্রিলের বাইরে যাবার আগে চারপাশটা দেখে নিচ্ছে।
ক্যামেরা! ক্যামেরা! আমার বইয়ের তাকে ফ্লেম-ব্যাক আশ্রয় নিয়েছিল, তার বিদায়-টা অন্তত যদি রেকর্ড করে রাখতে পারি …
কোথায় গেল ফোন-টা? এই তো এখানেই রেখে রাতে শুয়েছিলাম! কোথায় …
ও, প্রথম বার ঘুম ভেঙে হাতে নিয়েছিলাম সময় দেখার জন্য। তারপরে বিছানাতেই রয়েছে। চট করে তুলে নিয়ে ফিরে গিয়ে দেখলাম, ক্যামেরা চালু হবার আগেই ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল রক্ষা পাওয়া ফ্লেম-ব্যাক। সাতটা বেজেছে। মিনিট পঞ্চাশেক সে ছিল আমার ঘরে।
না-ই বা হলো ছবি। পাখিটা বেঁচে তো গেল। বেশ উশীনর-উশীনর লাগল নিজেকে। বস্তুত, উশীনরের চেয়েও এক-কাঠি ওপরে। শিকারী আশ্রয়দাতার কাছে তো পাউন্ড-অফ্-ফ্লেশ্-ও চাইতে আসেনি।
শুধু লজ্জা এই, যে ফ্লেম-ব্যাকের ডাক চিনতে পারিনি — থাকলই বা তার কণ্ঠে আর্তনাদ, হলই বা আমার চোখে ঘুম।