সরস্বতীর সঙ্গে দেখা হল গতকাল। আরে না না, মল্লিকপুরের মাণিক মেসোর ভাইঝি সেই সরস্বতী যার ডাকনাম সরো, সে নয়। সে তো নিতান্তই মানবী, জীবনানন্দ হলে বলতেন, হয়তো মানুষী নাকি মানুষিনী।
সে নয়। সেই সরস্বতী মানে সরোর সঙ্গে প্রেম করা যায়, সেই সরোর বিয়েতে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া যায়। তার পুত্র কন্যার মামা ডাক সহ্য করা যায়। যার সঙ্গে দেখা হল এ সেই সরস্বতী নয়।
দেখা হল সেই আসল আগমার্কা সরস্বতীর সঙ্গে। যিনি বিদ্যার দেবী। সেই যে যিনি, বীণা পুস্তক রঞ্জিত হস্তে আর যাঁর ইয়েযুগ ভূষিত মুক্তাহারে। থাক বাবা, আট্টু হলেই পাপ করে ফেলছিলাম। এই সরস্বতীর মাকে মা বলে ডাকতে হয়। সেই মায়ের মেয়ে হলেও কন্যাটিকেও মা বলে ডাকাই দস্তুর৷ এ যেন অনেকটা অঙ্কের ইনফিনিটির মত। ইনফিনিটির মাকেও বলতে হবে ইনফিনিটি। ইনফিনিটির মেয়েকেও তাই, ডাকতে হবে ইনফিনিটি।
অঙ্কের কথা থাক। অন্য কথা বলি। ছোটোবেলা থেকে বহুদিনই মনে বাসনা তাঁর সঙ্গে দেখা হলেই বর চাইব। লেখক হবার বর। সেই কালিদাসের মত। মহামূর্খ কালিদাস পেলে আমিই বা পাব না কেন? গণতন্ত্র বলে কিছু কি নেই নাকি দেশে?
হল, সেই দেখাই হল। কিন্তু বড় দেরিতে। আমার চিরবিদায়, শরীর ছেড়ে চলে যাবার আগে আগে। এখন বর পেলেই বা কী না পেলেই বা কী। কিন্তু হকের ধন ছাড়ব কেন? তাই চেয়েই বসলাম।
আসলে মনে তীব্র পীড়া। মানে, মাৎসর্য পীড়া। দেবীর বাহনটি অবধি কপালের আর কলমের জোরে বাংলা সাহিত্যের অধুনা তন্ত্র মন্ত্র রহস্য রোমাঞ্চ জঁরের লেখক হয়ে বসেছে। নামে চেনার উপায় নেই অবিশ্যি। সামান্য পালটে নিয়েছে নাম। নইলে আপনারাও চেনেন তাকে। হংসরাজ উপাধ্যায়।
তা, বর চাইতেই দেবী হাসলেন। – হ্যাঁ রে, ভূগোলটুগোল সব কিছুই ভুলে মেরে দিয়েছিস?
প্রশ্ন শুনে শিউরে উঠলাম। এই রে, চাইলাম সাহিত্য লেখার বর, ইনি দেখছি পুরো সিলেবাস নিয়ে টানাটানি শুরু করেছেন।
আমার শিউরে ওঠা দেখেই বোধহয় একটু যেন মায়া করে বললেন, – আমার চেহারাটা খেয়াল করেছিস কি?
তাকিয়ে দেখলাম, বললামও, – নাঃ তেমন বলবার মত কিছু চোখে পড়ছে না তো!
– আসলে অতিভক্তির স্টেজে আছিস তো। তাই খেয়াল করিসনি। আমার নাকটা একটু খ্যাঁদা, দেখেছিস? কেন খ্যাঁদা বল তো? বলে, নিজেই বললেন, – শুধু কি আমার? লক্ষ্মীদিদিরও। আসলে বাপী যখন সস্তায় জমি কিনে কৈলাশে বাড়ি বানাল, তখনও তো মানচিত্র বেশ তরল। ধীরে ধীরে শক্ত হতে টের পাওয়া গেল, কৈলাশ পড়েছে চিনের ভাগে। জানতি না তো? উইকি খুলে দেখে নিস বাছা। তা অ্যাদ্দিন ধরে নাকবোঁচা চিনেদের সঙ্গে মেলামেশা করে আমাদের আর্যনাসিকা এট্টু ইয়ে হবে না?
– মানে, দেবী লক্ষ্মীও কি ওই চিনেম্যান থুড়ি চিনে গার্ল হয়ে গেছেন?
– তা একটু হয়েছে বই কি। দেখিস না, তোদের দেশ তো ছাড়, এমন কী বিলেত আমেরিকারও সব জিনিসই মায় কম্পিউটার অ্যাকসেসরিজ শুদ্ধ সব কিছু চাইনিজ। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। তো বাণিজ্যের সেই পুরোটাই তো চিনের দখলে।
বুঝলাম। কিন্তু মাথায় ঘুরঘুর করছে ওই ফ্রিতে বর আদায়ের ব্যাপারটা। সেই কথাটা পাড়তেই রে রে করে উঠলেন দেবী। – সে এককালে যা হয়েছে হয়েছে। সামান্য গো-বর শুদ্ধ গোরু মানে গোরু আর তার পেটভর্তি ইয়ে পাচারের কেসে অবধি কেষ্টার মত লোক আটক। ও তো দারুণ প্রভাবশালী। গাঁজা কেসের কল্যাণে আমার বাপীর খুব কাছের হয়েও সালটাতে পারলো না। এখন আইন-কানুন খুব কড়া। ট্র্যান্স বর্ডার ওই সব বরটর পাচারের প্রশ্নই ওঠে না। তারপর ধর খরচাপাতি আমদানি-কর মিটিয়েটিটিয়ে বরটা সীমান্ত পেরোলো। আবার তো সেই তোদের দেশের সেন্ট্রাল জিএসটি স্টেট জিএসটি। সাসপেনশন খেয়েছিলি না? আগের মত ফ্রিতে তো দেওয়া যাবে না। তোর যা পোকায় কাটা পেনশন তাতে তুই ওই বর আর কিনতে পারবি না। লোনও পাবি না। যা বয়স, ইএমআই ম্যাচ করবে না।
– তাহলে মা গো, আমার কি কিছুই পাওয়া হবে না?
– নাঃ, এ জন্মে কিচ্ছুটি না। সামনের জন্মে কায়দা করে ওই কৈলাশের আশে পাশে জন্মাস। তখন হয় তো! মনে করে সেবারে চাস কিন্তু বাছা!
হংসরাজ থুড়ি রাজহংস মাকে পিঠে চড়িয়ে কৈলাসের দিকে উড়ে গেল। তার ভারি তাড়া। মাকে নামিয়েই ওকে আবার বইমেলায় নিজের লেখা বইয়ের অ্যাডে ব্যস্ত হতে হবে।
★