তুঝসে নারাজ নেহি জিন্দেগি
হ্যয়রান হু ম্যায়…
অনুপ ঘোষালের উদাত্ত কন্ঠে ‘মাসুম’ সিনেমার সেই বিখ্যাত গান ভেসে এল সামনে এসে বসা মহিলাটির রিংটোনে।ডাক্তারের সামনে ফোনে কথা বলবে!আমার ইগো একেবারে চড়বড়িয়ে উঠল।ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত হয়ে একটা পেল্লাই ধমক দিতে যেতেই উনি ফোনটি ধরে শুধু বললেন, আমি পরে কথা বলছি।তারপর কেটে দিলেন।তাকিয়ে দেখলাম রোগা মাঝারি হাইটের এক মহিলা বসে আছেন।মুখচোখে ভয়ঙ্কর ক্লান্তির ছাপ।
নাম বয়স জেনে নিয়ে রুটিন প্রশ্ন করলাম, কি সমস্যা?
কয়েক সেকেন্ড বোধহয়, তারপরেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।সামলানর সময় দিলাম।
—এবার বলুন কি কষ্ট।
—ডাক্তারবাবু আমি খুব খারাপ আছি,কিছু ভালো লাগেনা, কাজ করতে ইচ্ছে করেনা,ঘুম নেই, মরে যেতে ইচ্ছে করে শুধু বাচ্চাটার মুখ চেয়ে…।কথা শেষ করতে পারেন না।
ডায়াগনোসিসটা খুব কঠীন নয়।ডিপ্রেশন। কিন্তু উৎসটা জানার চেষ্টা করতে হবে।তাই জিজ্ঞাসা করলাম, মানসিক চাপের মত কিছু ঘটনা ঘটেছে?
মাথা নীচু করে একটু ভাবল তারপর ছোট্ট উত্তর, হ্যাঁ।
এবার গল্পটা শোনা গেল।ভদ্রমহিলার ছোটবেলাতেই বাবা মারা যান।দুজনের পেট চালানই মায়ের কাছে কঠীন হয়ে পড়ে।পড়াশোনা বিশেষ হয়নি।টেনেটুনে ক্লাস সিক্স।
তারপর ওই ছোট্ট বয়স থেকেই এলাকার একজন বিউটিশিয়ানের কাছে কাজ শেখা।এবং তার পার্লারে কাজে লাগা।তারপর আর একজনের পার্লারে কাজ করছেন গত দশ বছর।এর মধ্যে বিয়ে হয়েছে।দুটি বাচ্চা।বড়টি ছেলে বছর বারো বয়স ছোটটি মেয়ে বছর পাঁচেক বয়স। এমনিতে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ বিরাট কিছু নাহলেও কষ্ট নেই।সমস্যার শুরু একমাস আগে যদিও মূল প্রথিত আছে আরো অনেক পুরান দিনে।
ভদ্রমহিলা আর এক পুরুষের প্রেমে পড়েন।সম্পর্ক প্রায় আট নয় বছর।তিনিও বিবাহিত।সন্তান আছে।প্রেম এমনি গভীর দুজনেই ঠিক করছিলেন নিজেদের সংসার থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সংসার পাতবেন।একটু গুছিয়ে নিয়ে উপযুক্ত সময়ে নিজের নিজের সংসারকে জানানর অপেক্ষা।কিন্তু একদিন ফোন কলের সূত্রে সেই ভদ্রলোকের স্ত্রী সম্পর্কটা জানতে পেরে এনার স্বামীকে জানান, এনাকেও যাচ্ছেতাই ভাবে গালাগাল করেন।এনার স্বামীও ভীষণ রেগে যান।বলেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। ইনি তো প্রথমে এক অর্থে খুশীই হয়েছিলেন নিজে মুখে কাউকে বলতে হোলনা।এবার সেই বন্ধুকে নিয়ে নতুন জীবন।কথা হয়েই ছিল, ছোট মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে যাবেন।কিন্তু তাকে ফোন করতেই আসল ধাক্কাটা এল।তিনি সেই চিরাচরিত কথা বললেন, বন্ধুর মত মিশেছিল তাই সংসার ভেঙ্গে বেরন সম্ভব নয়।স্বামী এদিকে প্রচন্ড মানসিক অত্যাচার করছেন, ঘর হয়ত এমনিতেই ছাড়তে হবে।একূল ওকূল দুকূল ভাসিয়ে ভদ্রমহিলা এখন ডিপ্রেশনের রুগী।
প্রথমেই মন থেকে মুখে প্রায় এসেই গেছিল, এত প্রেমের সখ থাকলে এরকমই হয়! নিজেই নিজেকে ধমকালাম, চোপ, সাইকিয়াট্রিস্টকে জাজমেন্টাল হতে নেই!
একটু কথা বলে কিছু ওষুধ দিয়ে বাড়ি পাঠালাম।
পরেরবার ফলো আপে এসেছেন।ঘুম, ক্ষিধেটা ফিরেছে কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।বর উঠতে বসতে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলতে শুরু করেছিল তাই বাধ্য হয়ে একদিন বেরিয়ে এসেছেন।পার্লারের দিদি খুব ভালোবাসেন তাই আপাতত থাকার জায়গা দিয়েছেন।ছোট মেয়েটাকে নিয়ে সেখানে আছেন।কাজও ঠিক করতে পারছেন না।উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার ফিরে এলেন। মোবাইল বার করে একটা ছবি দেখার অনুরোধ করলেন।বললেন দেখুন আমার চেহারা কিরকম ছিল।এখন অর্ধেক হয়ে গেছি।
দেখলাম সত্যিই প্রচুর ওজন কমে প্রায় অর্ধেকই হয়ে গেছেন।প্রায় বলে ফেলেছিলাম, বেশ হয়েছে।
কিন্তু মুখে বললাম, আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিজেকে বললাম, সাইকিয়াট্রিস্টকে জাজমেন্টাল হতে নেই।
প্রায় মাসখানেক বাদে এলেন। সাথে একটা বাচ্চা মেয়ে।ছোট্ট গোলগাল চেহারা।বলাই বাহুল্য ছোট মেয়েটা।
মহিলার চেহারা একটু ফিরেছে, বিষন্নভাবটা একটু কমেছে।কিন্তু ভালো নেই।পার্লারের কাজ করতে পারছেনা, বাচ্চাকে সময় দিতে গিয়ে।তাকে একটা স্কুলে ভর্তি করার চেষ্টায় এদিক ওদিক যেতে হচ্ছে।সেই পার্লারের দিদি এখন ওকে পার্লারের কাজ দিচ্ছেন না।
বললাম চলছে কি করে।একটু মাথা নীচু করে থেকে বললেন একজনের বাড়ি ঘরমোছা, বাসন মাজার কাজ নিয়েছি।
—ছিলাম বিউটিশিয়ান হয়ে গেলাম কাজের লোক।
বলে চোখ মুছলেন।ফি দিতে ওষুধ কিনতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালের কথা বললাম।কিন্তু আমাকেই দেখাতে চায়।কোন ক্লিনিকে গেলে আমাকে দেখানো বা ওষুধ কেনার খরচ কম হবে বলে দিলাম।
এবার উঠে পড়ে বাচ্চাটাকে হাতে ধরে বেরতে গিয়েও ফিরে এল।বিরক্ত হয়ে ভাবছি আবার কোনো ছবি দেখাবে নাকি!বসে পড়ে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করল।
—ডাক্তারবাবু ডি এন এ টেস্ট কোথায় করা যায় বলতে পারবেন?
—কেন? অবাক হয়েই বললাম।
—আপনাকে সব কথা বলিনি।এই মেয়েটা আমার আর আমার সেই প্রেমিকের, আমার স্বামীর নয়।কিন্তু সে এখন এটাও অস্বীকার করছে।আমার এই দুই পুরুষ মানুষের কাউকেই দরকার নেই।আমি একাই ওকে মানুষ করব।শুধু রিপোর্টটা লোকটার মুখে ছুঁড়ে মারার জন্যে করতে চাইছিলাম।
আমি খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।বোঝালাম এখন এসব করার দরকার নেই।এবার বুঝলাম কেন মাসুম সিনেমার গান রিংটোন।ওই সিনেমায় নাসিরুদ্দিন শাহ তার সামাজিক ভাবে অবৈধ কিন্তু অতি প্রিয় সন্তান নিয়ে কিভাবে অস্বস্তি ও বিষন্ন ছিল।
অনেক কিছুই মাথায় আসছিল, সামাজিক নিয়ম কানুন, মুক্ত সম্পর্ক,বিবাহ নামে প্রতিষ্ঠানের টালমাটাল অবস্থা। এর কতটা দরকার।আমার কোন পক্ষ নেওয়া উচিৎ। এখন কি একটা আচ্ছা করে ধমক দেওয়া উচিৎ একটা অতি সাধারন মহিলার এই নিয়ম ভাঙ্গা আচরণের জন্য।
তারপর নিজেকে বললাম, সাইকিয়াট্রিস্টকে জাজমেন্টাল হতে নেই!
পরেরবার এলেন।বেশ হাসিখুশি , চেহারাতেও একটা জেল্লা এসেছে।বললেন বেশ ভালো আছি।
ভালো করে জিজ্ঞাসা করে দেখলাম ডিপ্রেশানের উপসর্গ অনেকে কমে গেছে।বললেন, ডাক্তারবাবু মেয়েকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি।বিউটি পার্লারের কাজ আবার শুরু করেছি।ওদিক থেকে সব কিছু জেনেও জায়েরা আমাকে বলছে বাড়ি ফিরে যেতে।বর ঝামেলা করলে ওরা সামলাবে।যদিও বাড়ি ফেরার কথা আমি এখনো ভাবিনি।তবে বেশ ভালো আছি।
আমার কি হওয়া উচিৎ খুশী না বিরক্ত।ভাবছিলাম।শেষে খুশিই হলাম,কারন নিজেকে প্রথম থেকেই বলে এসেছি… সাইকিয়াট্রিস্টকে জাজমেন্টাল হতে নেই।