মনোচিকিৎসক হিসেবে আমাকে মানুষের জীবনের গল্প শুনতেই হয়, কিন্তু এই গল্প শোনার কাজটা আমার ভীষণ পছন্দের বলেই হয়তো কাজটাকে কাজ বলে মনেই হয় না। ওষুধ, রক্তপরীক্ষা, মানসিক সমস্যা ইত্যাদির বাইরে গিয়েও মাঝেমাঝেই আমি মানুষের জীবনের গল্পগুলো শুনি, আলোচনা করি… চিকিৎসকের কাজ আসলে তো শুধুই রোগের চিকিৎসা করা নয়, মানুষের চিকিৎসা করা আর সেই জন্যই সব রুগী আলাদা, সব মানুষ আলাদা, সব জীবনের গল্প আলাদা, আর সবারই কোনো না কোনো গল্প আছে….!
গল্প করছিলাম একজন schizophrenia রুগীর মা আর দিদির সঙ্গে। এই অসুখে যেটা হয় সেটা হলো শুরুতে অনেক উপসর্গ থাকে, যেগুলোকে বলে positive symptoms – hallucination, সন্দেহ, ভয় পাওয়া, অসংলগ্ন কথা বলা, রেগে যাওয়া ইত্যাদি… এই উপসর্গগুলো অপেক্ষাকৃত সহজেই চিকিৎসায় সাড়া দেয়। সমস্যা দেখা যায় -negative symptoms নিয়ে। যেখানে মানুষের কথা বলার ইচ্ছে কমে যায়, উদ্যোগ কমে যায়, সামাজিক মেলামেশার ইচ্ছে কমে যায়,আনন্দ বা দুঃখ কোনো অনুভূতিই তাদের বিশেষ স্পর্শ করে না, নিজের মতন থাকেন, একা।
আমার এই রুগী, বছর তিরিশের যুবতী… এখন কোনো উপসর্গ নেই আগের মতন, শুধুই নিজের থেকে সে বিশেষ কথা বলে না, কারোর সাথে মেশে না, ঘরের কাজ করে কিন্তু যদি বাড়ির লোক করতে বলে তবেই… মা- এর চিন্তার শেষ নেই! এই মেয়ের বিয়ে দেবেন কি করে? সংসার-বিয়ে এগুলো সে সামলাবে কি করে?? দেখাশোনা চলছে, কিন্তু এগোচ্ছে না কিছুই! এদিকে বয়স তিরিশ! মেয়েদের জীবনের ভয়ানক একটা ডেডলাইন এই তিরিশ বছর বয়স-টা! তিরিশ কিন্তু বিয়ে হয়নি, তিরিশ কিন্তু বাচ্চা হয়নি – এ জিনিস না সমাজ মেনে নিতে পারে না বাড়ির লোক! তিরিশের মেয়েটার জন্য এখন নিজের বাড়িতে থাকাই যেনো একটা “unauthorized stay”, আর কোনোক্রমে বিয়ে হওয়ার পরে, সেই বিয়ে যদি ভেঙ্গে যায়? তারপরে বাড়ি ফিরে আসা তো আরোই বড়ো অনধিকার অনুপ্রবেশ, তাই না??
মেয়েটার মাকে বোঝালাম যে আপনার মেয়ের তো তবুও একটা অসুখ আছে, আমি তো এমন অনেক সম্পূর্ণ সুস্থ মেয়েদের গল্প জানি, যাদের বয়স তিরিশ পেরিয়েছে, কিন্তু শুধু বিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে বলে তারা আর বাড়ির লোকের সাথে আজকাল কথা বলে না, বলতে চায় না। কি লাভ বলুন মেয়েটাকে বিয়ে নিয়ে অতিষ্ঠ করে? কি লাভ কোনোরকম-এ একটা বিয়ে দিয়ে? বিয়ে দেওয়া তো ঝেড়ে ফেলা নয়… অসুখর কথা গোপন করে বিয়ে হয় এমন কতো মেয়ের, তারপরে ওষুধ খাওয়া বন্ধ হয়, আবার অসুখ বেড়ে যায়, আবার বিয়ে ভাঙ্গে, আবার সেই জন্য অসুখ বাড়ে, ততদিনে বাবা-মা-এর সঞ্চয়ের টাকাটুকুও বিয়ের জন্য খরচ হয়ে যায়, মেয়েটি হয়ে যায় পরিবারের বোঝা! তার চেয়ে বরং চিকিৎসা চলুক, জীবনসাথীর খোঁজও চলুক, বিয়ে এমন কারোর সাথেই হোক যে সবকিছু জেনেও ওর সঙ্গে জীবনটা ভাগ করে নিতে চাইবে… কিন্তু কোনোরকমে একটা বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত হই, এমন ভাবনার চেয়ে অনেক ভালো মেয়েকে একটু অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করা, প্রতিদিনের জীবনে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করা – তাই নয়?
আমি জানি না আমার এই রুগী নিজের জীবনসঙ্গী খুঁজে পাবে কিনা, কিন্তু যদি নাই পায়? মা-বাবা আর দিদির সাহায্যে, ভালোবাসায়, যত্নে যদি জীবনটা আরেকটু ভালো ভাবেই কাটিয়ে দিতে পারে, তবুও সে জীবন ব্যর্থ হবে কি?? কোনো জীবনই কি ব্যর্থ হয়?? আপনারাই বলুন।