নতুন বছর, Covid-19 এর নতুন স্ট্রেন, কিন্তু সেই পুরোনো আশঙ্কার দিনরাত্রি। একের পর এক ঢেউ এর দোলায় বেসামাল জীবন যেই থিতু হওয়ার আশায় বুক বাঁধছে, তখনই তৃতীয় ঢেউ এর বার্তা নিয়ে ওমিক্রনের আবির্ভাব। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সারা দেশ সহ এই বঙ্গে ব্যাপক হারে সংক্রমণ বৃদ্ধি, স্কুল-কলেজ বন্ধের ঘোষণা, গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে তরজা, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে আবার আমরা সেই তিমিরেই। এই অবস্থায় বিগত দু বছরের অতিমারি মোকাবিলা থেকে শিক্ষা নিয়ে উপযুক্ত জনস্বাস্থ্য কার্যপ্রণালীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আপদকালীন সুরক্ষা এবং দীর্ঘকালীন আর্থ-সামাজিক সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করাই জননীতির একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
এভোলিউশনারী বায়োলজি অনুসারে ধারণা ছিলই যে Covid-19 ভাইরাসকে তার নিজের বাঁচার তাগিদেই এক সময় দাঁত নখ খোয়াতে হবে। এমনটাই হচ্ছে কিনা তা এখনও নিশ্চিতরূপে বলা না গেলেও, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাথমিক তথ্য এবং তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে – ওমিক্রন যতটা সংক্রামক ততটা প্রাণঘাতী নয়। গবেষণায় এটাও দেখা যাচ্ছে যে ওমিক্রন আক্রান্ত বাক্তির অনাক্রম্যতা (ইমিউনিটি) অনেক বেশি শক্তিশালী ডেল্টা স্ট্রেনকে প্রতিরোধ করতে ৪.৪ গুণ বেশি সফল এবং একই স্ট্রেনের (অর্থাৎ ওমিক্রন) ক্ষেত্রে ১৪ গুণ সফল। এর থেকে দুটো সিদ্ধান্তে আসা যায়। এক, ওমিক্রন সংক্রমণ খুব তাড়াতাড়ি কোভিড ১৯ এর ডেল্টা সংক্রমণকে (যে স্ট্রেন মানব দেহের পক্ষে তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি ক্ষতিকারক) ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে কমিয়ে আনবে। ফলে কোভিড ১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সংকটজনক অবস্থায় হাসপাতালে বা আইসিইউ-তে ভর্তি হওয়ার হার ও মৃত্যু হারও অনেক কমবে। তথ্য বলছে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের মেট্রো শহরগুলোতে ৭০-৮০ শতাংশ কোভিড ১৯ পজিটিভই ওমিক্রন স্ট্রেনে আক্রান্ত। দুই, ওমিক্রন সংক্রমণের ব্যাপকতার ফলে গোষ্ঠী প্রতিরোধক্ষমতাও (হার্ড ইমুউনিটি) গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে । তা দীর্ঘমেয়াদি হবে কিনা সে আলাদা প্রশ্ন। তাই জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে ওমিক্রনের এই তৃতীয় ঢেউ কিন্তু ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ পুনরুদ্ধার করার একটা সুবর্ণ সুযোগ।
ওমিক্রন সংক্রমণ নিয়ে যে দু একটা কথা আমরা জানি, ফুসফুস সংক্রমণে তার তুলনামূলক অক্ষমতা বোধহয় তার মধ্যে সবচেয়ে আশাপ্রদ। সেই অনুযায়ী জটিল রোগাক্রান্তের হার এবার বেশ কমই থাকার কথা । এখনও অবধি প্রাপ্ত তথ্যও খানিকটা তেমনই জানান দিচ্ছে। আবার উল্টোদিকে, বিদ্যুৎবেগে বেড়ে চলা সংক্রমণ-এর ফলে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হবেন, তার খুব সামান্য অংশেরও হাসপাতালে চিকিৎসা লাগলে, আশঙ্কা যে সংখ্যার নিরিখে তা আমাদের অপর্যাপ্ত চিকিৎসা পরিকাঠামোকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। শেষ প্রাপ্ত সরকারি তথ্য অনুযায়ী আমাদের রাজ্যে দৈনিক সংক্রমণের হার ৩৩ শতাংশ ছুঁই ছুঁই, দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যায় রোজ রোজ নতুন রেকর্ড। সব মিলিয়ে, ভালো মন্দে পরিস্থিতি জটিল। জটিল বলেই একটু বুঝে শুনে এগোনো কর্তব্য। নাহলে Covid-19 যে শারীরিক ব্যাধি থেকে সামাজিক বিপর্যয়ও ডেকে আনতে পারে, তা মনে রাখা দরকার।
তাহলে উপায়, আবার কি লক-ডাউন? না, কখনই নয়। প্রথমেই, অধিকাংশ আক্রান্তই যখন মৃদু উপসর্গে ভুগছেন, তখন ঘরে থেকে রোগ নিরাময়েই জোর দিতে হবে। হেল্পলাইন, বিভিন্ন গণজ্ঞাপন মাধ্যম, স্থানীয় প্রশাসনকে (পুরসভা) ব্যবহার করে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে হবে। মৃদু উপসর্গ মোকাবিলার বিভিন্ন ঘরোয়া পদ্ধতি যেমন স্টিম নেওয়া থেকে জ্বরের ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল; উপসর্গ বুঝে কখন সতর্ক হতে হবে আর সেক্ষেত্রে কোথায় যোগাযোগ করতে হবে, এমন সব তথ্যই সহজলভ্য করতে হবে। যে সমস্ত পরিবারে বয়স্ক এবং অন্যান্য অসুস্থতাযুক্ত মানুষ (ডায়াবেটিস বিশেষত) আছেন, বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তাঁদেরকে। মৃদু উপসর্গে যাঁদের বাড়িতে আইসোলেশনের সুযোগ আছে, তাঁরা আক্রান্ত হলে বাড়িতেই থাকুন। সরকারি বা অন্যান্য উদ্যোগে পরিচালিত সেফ হোম থাক যাঁদের সেই সুবিধে নেই–যেমন বস্তিবাসী বা গৃহহীন মানুষ–তাঁদের জন্য। আর Covid-19 এর জন্য অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা হোক প্রান্তিকতম স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও, যেমন পুরসভা পরিচালিত প্রাইমারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। শুধু জটিল উপসর্গযুক্ত এবং অন্যান্য অসুস্থতাযুক্ত Covid রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা থাক বড় হাসপাতালে। অকারণে বড় হাসপাতালগুলোকে Covid হাসপাতাল বানিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসায় ব্যাঘাত না ঘটানোই বাঞ্ছনীয়। তাতে এই সমস্ত হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা যেমন সংক্রমণ-এর হাত থেকে খানিক বাঁচবেন, তেমনই অন্যান্য রোগাক্রান্তরাও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবেন না।
এর পরেই প্রশ্ন বিভিন্ন অতিমারি সংক্রান্ত নিরাপত্তা বিধি নিয়ে। বার বার তিন বার Covid-19 ভাইরাস-এর নব নব রূপে আগমনে এটুকু পরিষ্কার Covid-19 থেকে সম্পূর্ণ পরিত্রাণ হয়ত সম্ভব নয়। তবে অদূর ভবিষ্যতে অতিমারি রূপে নয়, সাধারণ আর পাঁচটা রোগের মত হয়ত হতে যাচ্ছে Covid-19 এর পরিণতি। সংক্রমণ বা ভ্যাকসিন, যেভাবেই আসুক অনাক্রম্যতা, তার ফলে এপিডেমিক থেকে Covid-19 এর এপিডেমিওলোজির পরিভাষায় এন্ডেমিক হবার সম্ভাবনাই প্রবল। মানে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা আর চারটে করোনা ভাইরাস যেমন season এ season এ সর্দিকাশি বাঁধিয়ে থাকে, সেইরকম কিছু হবে SARS-CoV-2 এর ক্ষেত্রেও। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে হয়ত বাড়াবাড়িও হবে, তবে লক ডাউন বা অন্যান্য Covid-বিধির স্মৃতি উস্কে নয়। ১০০ জন ইমুনোলোজিস্ট, সংক্রামক রোগ গবেষক এবং ভাইরোলজিস্টদের মধ্যে নেচার জার্নালের সমীক্ষায় নব্বই শতাংশেরই তাই অভিমত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ-রোধক অনাক্রম্যতা কমলেও, বাড়াবাড়ি বা মৃত্যুর সম্ভাবনাও অনেকটাই কমবে। তাই যেখানে–বিশেষত এই ওমিক্রন স্ট্রেন এর ক্ষেত্রে–সিংহভাগ রোগী মৃদু উপসর্গে ভোগেন, সেখানে বারংবার জনজীবন ব্যাহত করা, ইস্কুল কলেজের পাঠ তুলে দেওয়া, অসংখ্য মানুষের রুজি রোজগারকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়া, ভাইরাসে না হলেও, ভাতে মারার নামান্তর। ঢেউ এলো কি এলো না, প্রথমেই জন পরিবহন ব্যবস্থার উপর কোপ মানুষের অশেষ দুর্ভোগ বৃদ্ধি এবং আখেরে ভিড় বাড়িয়ে ভাইরাস সংক্রমণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী উপকারে আসে? জন পরিসরে মানুষে মানুষে শারীরিক দূরত্ত্ব বজায় রাখতে তো উল্টে আরও বেশি জনপরিবহনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন! রাতের কারফিউ, সাতটায় লোক্যাল ট্রেন বন্ধ, এমন সব একুশে আইন দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, সরকারের অতিমারি বিষয়ক উপদেষ্টা মন্ডলীর মধ্যে আদৌ কোন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আছেন কিনা। তবে এর মানে এই নয় যে যত গন্ডগোল সব সরকারের, আর আমরা বিলকুল ঝাড়া হাত পা। আমাদেরও কিছু দায়িত্ত্ব আছে । মাস্ক ব্যবহার, দূরত্ত্ববিধি মেনে চলা, sanitzation-এসবের মাধ্যমে সংক্রমণ যত নিয়ন্ত্রণে থাকবে তত সময় পাওয়া যাবে আরও বেশি মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার, এবং সামগ্রিক ভাবে গোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে তোলার। এবং যাঁরা এখনও ভ্যাকসিন পাননি, তাঁদের মধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষজন, যাঁদের অন্য রোগ আছে, স্বাস্থ্যকর্মী বা জন পরিষেবা প্রদানে যুক্ত মানুষদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। ভ্যাকসিনের প্রসঙ্গে বর্তমানে যে প্রিকশান ডোজের (বা বুস্টার ডোজ) কথা বলা হচ্ছে তার উপর আরও তথ্য নির্ভর বিজ্ঞ্যান ভিত্তিক আলোচনা দরকার। ইউরোপ থেকে আমেরিকা সবাই বুস্টার ডোজের পন্থা নিচ্ছে, অতিসম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে যে বুস্তার ওমিক্রন সংক্রমণকে ঠেকাতে সাহায্য করবে। দুঃখের বিষয় ‘বুস্টার নীতির’ ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা কিন্তু গরিব বিশ্বে ভ্যাকসিন পৌছাতে আরও দেরি করাবে আর ফার্মা কোম্পানিগুলোর মুনাফা বারাতে আরও সাহায্য করবে। দেখা দরকার ভারতের মত দেশে বুস্টার ডোজ যেন কোন ভাবেই জনবাদী রাজনীতির অঙ্গ না হয়ে উঠে। ওমিক্রনের মত দুর্বল স্ট্রেনকে ঠেকাতে বুস্টার ডোজের দরকার (বয়স্ক ও অন্যান্য অসুস্থতাযুক্ত মানুষ ছাড়া) না যে সমস্ত দেশ এখনও ভ্যাকসিন পায়নি তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানো উচিত, তা জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞ্যানের নিরিখে বিচার করা হোক।
বড়দের চেয়ে শিশু বা adolescents মধ্যে covid এর প্রাবল্য এমনিতেই কম, উপরন্তু ওমিক্রন তুলনায় দুর্বল স্ট্রেন। তাই তাঁদের মধ্যে সংক্রমণ বা ভ্যাকসিন না পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা, এই সবের বিশেষ কারণ নেই। বরং বয়স্কদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা বলয় রেখে (যেমন গণ পরিবহনে যাতায়াত বন্ধ রাখা বা ব্যাঙ্ক সহ অন্যান্য অত্যাবস্যকিয় পরিষেবাগুলো আগামি দু-মাস দুয়ারে প্রদান করা) নিয়ন্ত্রিত ভাবেঃ সব কিছুকে চলতে দিলে বাজিমাতের সম্ভাবনা প্রবল। তবে, পাশাপাশি, এক ধাক্কায় আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ গগনচুম্বি হয়ে চিকিৎসা পরিষেবাকে যাতে বেকাবু না করে ফেলে সেদিকেও সরকারের নজর রাখা বিশেষ কর্তব্য। । সেইজন্য এই মুহূর্তে মেলা বা ভোটের সমাবেশ কিন্তু অপ্রয়োজনীয় এবং সম্ভাব্য superspreader। এই খেলা কিন্তু কৌশলের এবং ধৈর্য্যের। রাজনীতির চেনা ছকের বাইরে বিজ্ঞান নির্ভর, যুক্তিনিষ্ঠ, এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জনস্বাস্থ্য নীতি এখানে বেশি কার্যকারী হবে। পশ্চিমবঙ্গে পুর -ভোট মার্চের শুরুতে করলে কোন মহামারি অশুদ্ধ তো আর হবে না, বরং এই চলতে থাকা মহামারি থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে ওমিক্রন সংক্রমণের বৃদ্ধি দৈর্ঘ্যে নয় প্রস্থে লম্বা করতে হবে – তবেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে অপ্রতুল চিকিৎসা পরিকাঠামোকে বাতিব্যস্ত না করে সমষ্টিগত ভাবে ইমুউনিটি গড়ে উঠবে এবং অতিমারি-উত্তর পৃথিবীর দেখা মিলবে।
এই লেখাটি অমিতাভ সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে ডা সায়ন দাস লিখেছেন।
(এই লেখাটি এই সময় পত্রিকায় ১৪ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে।)