নাতিদীর্ঘ বিরতির পর ‘স্বাস্থ্যের বৃত্তে’ পত্রিকা আবার প্রকাশিত হতে চলেছে। নতুন করে শুরুর প্রথম সংখ্যার ফোকাস, শ্রমিকের স্বাস্থ্য। সরাসরি সেই বিষয় নিয়ে কাজ করার সুযোগ আমার হয়নি। পেশাগত স্বাস্থ্যসমস্যা বা অকুপেশনাল ডিজিজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যাকে জনস্বাস্থ্যের অন্যতম জরুরি অংশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
কিন্তু জনস্বাস্থ্য নিয়েও আমাদের ভাবনাগুলো উত্তরোত্তর ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। টিকা-র ভালোমন্দ, এই বিতর্কের বাইরে বৃহত্তর কোনও আলোচনা, ইদানীং, জনস্বাস্থ্যের পরিসরে জেগে উঠছে না। এই পরিস্থিতিতে একটা অন্যরকম আলোচনা পড়ার সুযোগ হলো সদ্য। সেই লেখাটা অনুবাদ করে আপনাদের পড়াতে চাইছি। অনুবাদ বলতে, ভাবানুবাদ। অনুবাদক হিসেবে স্বীকার করে নিই, এই অনুবাদকর্মে মূল লেখার ভাবনা অক্ষুণ্ণ রাখতে চেয়েছি, কিন্তু হুবহু অনুবাদ করিনি। ‘স্বাস্থ্যের বৃত্তে’-র পাঠকপাঠিকাদের কথা ভেবেই যথাসাধ্য ‘নিজের ভাষায়’ লিখেছি। কাজটাকে অপরাধ মনে হলে মার্জনা করবেন।
মূল লেখাটি ইংরেজিতে। এবং লেখাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থার, বিশেষত জনস্বাস্থ্য ভাবনার, সমস্যা ও সঙ্কট নিয়ে। কিন্তু এদেশের প্রেক্ষিতেও লেখাটা প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক, কেননা বিশ্বায়ন ও উদার অর্থনীতির দাপটে এদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও উত্তরোত্তর মার্কিন দেশের স্বাস্থ্যমডেল ধরে এগোচ্ছে। তেমনভাবে এগোনোর মুশকিলটা হলো, ধনী দেশে অনুসৃত সেই ব্যবস্থার মধ্যে যে খামতিগুলো থাকে, এবং খামতিগুলোর কারণে যে সঙ্কটগুলো তৈরি হয়, সেই সঙ্কট বহুগুণে বর্ধিত হয়ে গরীব ও উন্নয়নশীল দেশে প্রকট হয়ে ওঠে। কাজেই, আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে সেই সঙ্কটের চেহারা – ভবিষ্যতের সঙ্কট, যা কিনা বর্তমানেও আর খুব প্রচ্ছন্ন নেই – সেই চেহারাটাকে চিনতে পারা জরুরি। এবং সেই বিপদের বিষয়ে সচেতন হয়ে বিকল্প পথের কথা ভাবা জরুরি। তাই, ভিনদেশের লেখাখানা আপনাদের সামনে রইল।
“জনস্বাস্থ্যের হাল কীভাবে ফেরাতে পারেন? ডাক্তারের মতো করে ভাবা বন্ধ করুন” – এই শিরোনামে এরিক রেইনহার্ট-এর প্রবন্ধ। মার্কিন দেশের ‘দ্য নেশন’ পত্রিকায় প্রকাশিত৷ বাইশে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩।]
মার্কিন জনস্বাস্থ্যের শীর্ষস্তরে বদল আসন্ন। যাকে, জনস্বাস্থ্যের মত নড়বড়ে একটি ক্ষেত্রকে ঢেলে সাজানোর সুযোগ উপস্থিত, এমন করেও দেখা যেতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে বড় আটকানো-যেতে-পারত-এমন বিপর্যয়ের ছায়ায় বিদায় নিলেন অ্যান্থনি ফাউচি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট আগামীদিনের অতিমারী প্রতিরোধ ও মোকাবিলার প্রস্তুতির জন্য হোয়াইট হাউসে পাকাপোক্ত অফিস খুলছেন, সেখানে উপযুক্ত মানুষের হাতে দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও তাঁর উপদেষ্টাদের বুঝতে হবে, জনস্বাস্থ্যের যে পচন, তা একেবারে কাঠামোগত পচন। কমিটির মাথায় কে বসবেন, শুধু সেই মুখ বদলে ফেলে সমস্যার সুরাহা হবে না। কার্যকরী জাতীয় স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর নির্মাণের মুহূর্তে জনস্বাস্থ্যের সামগ্রিক বিকৃতিটা অনুধাবন করতে হবে, নেতৃত্বের বদলের সময় জনস্বাস্থ্য কীভাবে নিজস্ব গণ্ডীর স্বার্থসাধনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, সেই সমস্যাকে অনুধাবন করতে পারতে হবে।
জনস্বাস্থ্যের এই সামগ্রিক পচন ও নির্দিষ্ট স্বার্থানুসারী ভাবনার অন্যতম কারণ, জনস্বাস্থ্য বিষয়টির উত্তরোত্তর চিকিৎসাভিমুখী হয়ে ওঠা। পাব্লিক হেলথ-এর উত্তরোত্তর ‘মেডিকালাইজেশন’। দেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সংস্থা – সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন, সংক্ষেপে সিডিসি – তার কথাই ধরুন না৷ ১৯৫৩ সালের পর থেকে সেই সংস্থার মাথায় যাঁরা ছিলেন এবং আছেন, তাঁদের সকলেরই মূল ডিগ্রি ‘এমডি’, আনুষঙ্গিক কিছু ডিগ্রি থাকলেও সেগুলো প্রকৃতপ্রস্তাবে অলঙ্কারমাত্র। অথচ স্বাস্থ্য বলতে আদতে যা, তার মধ্যে কেবলমাত্র ১০-২০ শতাংশ-ই চিকিৎসার মাধ্যমে উন্নত করা সম্ভব। অথচ এই এত বছর ধরে সিডিসি স্রেফ ওই ১০-২০ শতাংশের উপরই মনোযোগ দিয়ে এসেছে – অর্থাৎ বিভিন্নরকম ওষুধ-পত্র পরীক্ষানিরীক্ষা টিকা ইত্যাদি – স্বাস্থ্যের বাকি নির্ণায়ক ফ্যাক্টরগুলোর দিকে ফিরেও তাকায়নি। অথচ একজন মানুষের স্বাস্থ্য ভালো হবে নাকি খারাপ, তার ৮০-৯০ শতাংশই নির্ভর করে বাকি বিষয়গুলোর উপর।
জনস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞ মিলটন রোমার বলেছিলেন, ডাক্তারি পড়তে গিয়ে যা যা শেখা হয়, জনস্বাস্থ্যের কাজের জন্য তার অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু কেবলমাত্র এই ‘অপ্রয়োজনীয়’ বিদ্যেয় মাথা বোঝাই হয়ে থাকার কারণে, সত্যিকারের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো – যেমন, শ্রম-আইন, শ্রমিকের ইতিহাস, সামাজিক নৃতত্ব, আর্থরাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়, এপিডেমিওলজি, পরিবেশ-বিজ্ঞান ইত্যাদি – সেই বিষয়গুলো আর পড়ে বা জেনে ওঠা যায় না। শুধু সেই সব বিষয়ে অজ্ঞতার কারণেই যে ডাক্তারবাবুদের দ্বারা পরিচালিত জনস্বাস্থ্য সংস্থা বিপজ্জনক, এমন নয়। আসল সমস্যা হলো জ্ঞানার্জনের পদ্ধতি বিষয়ে সন্দিগ্ধ বিনয়ের অভাব। ডাক্তারি-চিন্তাপদ্ধতির সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা বিষয়ে সচেতনতার অভাব। কেননা জনস্বাস্থ্যের চিন্তাপদ্ধতি ও ডাক্তারি-ভাবনাপদ্ধতি এক পথে হাঁটে না, অনেকসময়ই এই দুই চিন্তাপদ্ধতি একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।
ডাক্তারি চিন্তাপদ্ধতির সমস্যাটা কী? আমরা ডাক্তাররা যখন সামনে-থাকা রোগীকে দেখি, বা তাঁর সমস্যাকে বোঝার চেষ্টা করি, তখন মেনেই নিই যে তাঁর জীবনের বাকি বিষয়গুলোর পরিবর্তন করাটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর আর্থিক পরিস্থিতি, তাঁর পারিপার্শ্বিক ও সমাজ সেখানকার সমস্যা, তাঁর ধারদেনা, বেকারত্ব ও কর্মহীনতা, বা কর্মক্ষেত্রে তাঁর মালিকের চাহিদা ইত্যাদি প্রভৃতি – আমরা মেনেই নিই, এই সব সমস্যার মধ্যেই তিনি কতখানি ভালো থাকতে পারেন, আমাদের দায় সেটুকুই।
বিপরীতে, জনস্বাস্থ্যের চিন্তাভাবনা সামগ্রিকভাবে বৃহত্তর জনসমাজ বা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে। ডাক্তারির মতো করেই জনস্বাস্থ্যও চায় যাতে একজন ব্যক্তিমানুষ সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে জীবনযাপনে প্রকৃত-অর্থেই স্বাধীন হয়ে উঠতে পারেন, যাতে তিনি যেরকম চান তেমন জীবনই যাপন করতে সক্ষম হয়ে ওঠেন – কিন্তু ব্যক্তিমানুষকে সেই ‘সক্ষমতা ও স্বাধীনতা’ প্রদানের পথটি ডাক্তারির থেকে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আলাদা। সেখানে দমবন্ধ করা আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বা কর্মক্ষেত্রের সমস্যার মধ্যেই ব্যক্তিমানুষটি কীভাবে ‘যথাসম্ভব ভালো থাকতে পারেন’, তেমন সমাধান খোঁজা হয় না – বরং জনস্বাস্থ্য খোঁজে এমন পথ, যেখানে ব্যক্তিমানুষটির সক্ষমতা-স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতার পরিস্থিতিগত কারণগুলো চিহ্নিত করে, যাতে সরকারি উদ্যোগের সাহায্যে সেই পরিস্থিতিটাকেই বদলে ফেলা সম্ভব হয়। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা, কাজের নিশ্চয়তা, মাথার ‘পরে ছাদের নিশ্চয়তা, খাদ্যসুরক্ষা, কর্পোরেটের অবাধ বিচরণে লাগাম, নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা, জীবনযাত্রার নিরাপত্তা – এই সমস্ত কিছুই জনস্বাস্থ্যের আওতায় আসতে পারে।
মানুষ যেখানে যেমন আছেন, সেখানে পৌঁছে যাওয়াটাই জনস্বাস্থ্যের দায় নয় – পরিস্থিতি ও পরিবেশের বদল ঘটিয়ে মানুষকে নিজের পছন্দমতো বাঁচার স্বাধীনতা দেওয়াটা জনস্বাস্থ্যের কাজ। নিজের পছন্দমত বাঁচার জন্য অকারণ ঝুঁকি নিতে বাধ্য হতে না হওয়া – যেমন ধরুন, ব্যক্তিমানুষটি যেন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও কাজ/আয় হারানোর ভয়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজে যেতে বাধ্য না হ’ন – এর ব্যবস্থা করা অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের কাজ। ব্যক্তিমানুষের ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতার কথা বলছি না, বলছি সামাজিক অবস্থানের ফারাকের জন্য জেনেবুঝেও যে শারীরিক অসুস্থতার ঝুঁকি নিতে জনসংখ্যার বড় অংশ বাধ্য হন – যেমন, শুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ না পাওয়া, পরিশ্রুত পানীয় জল না পাওয়া, এবং সেই না-পাওয়ার কারণে অপরিশ্রুত জল খাওয়া বা দূষিত বায়ুর মধ্যেই বসবাসের ঝুঁকি – নাগরিককে সেই ঝুঁকিপূর্ণ জীবন থেকে পছন্দমতো জীবনযাত্রার স্বাধীনতা প্রদান, জনস্বাস্থ্যের দায়িত্ব অবশ্যই।
এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জনস্বাস্থ্য অগ্রাধিকার দেয় জনসংখ্যার সেই অংশকে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যাঁদের স্বাভাবিকভাবে বা ঝুঁকিহীনভাবে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা সবচাইতে বেশি ব্যাহত হচ্ছে। যেমন, বয়স্ক মানুষ, গৃহহীন মানুষ, কর্মহীন মানুষ, যাঁদের রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা কম তেমন মানুষ। কোনও মহত্ত্বের বোধ থেকে এঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, এমন নয় – অগ্রাধিকার একারণেই, কেননা অন্তত এটুকু বোঝা জনস্বাস্থ্যের কর্তব্য, যে, অরক্ষিতরা আক্রান্ত হলে সেই অসুস্থতা বহুগুণে বেড়ে সমাজের বাকি অংশকেও সমস্যায় ফেলবে। কাজেই, পুরো পরিস্থিতিটাকে জনস্বাস্থ্য দেখে নিচের তলা থেকে। সে দেখা তথাকথিত বিশেষজ্ঞ বা অর্থনীতিবিদ বা কর্পোরেটমালিক বা বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন।
যেহেতু জনস্বাস্থ্য ব্যাপারটা ডাক্তারির চাইতে আলাদা, তাই জনস্বাস্থ্যের বিশ্লেষণও চিকিৎসকদের বিশ্লেষণ থেকে আলাদা হওয়ার কথা। যেমন ধরুন, বর্তমান বাজারমুখী চিকিৎসাব্যবস্থায় বেশি বেশি চিকিৎসা করলে আর্থিক লাভ বেশি এবং এমন ভাবনা সামগ্রিকভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থার এই বিপদ নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি ঠিক একই চিন্তাধারা জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে মুশকিল। যেমন ধরুন, অকারণ বেশি চিকিৎসা করা অনুচিত, এমন যুক্তি যদি কোভিড টিকার ক্ষেত্রে দেওয়া হয়? অর্থাৎ, কোভিড-আক্রান্ত হলেও যাদের বাড়াবাড়ি হওয়ার ভয় নেই – যেমন স্কুল-ছাত্রছাত্রীরা – তাদের যদি টিকার আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়? তখন অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না, আপাতদৃষ্টিতে ঝুঁকিহীন এই ছাত্রছাত্রীদের আশেপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁরা কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত নন। অর্থাৎ এই টিকা-না-পাওয়া কিশোর-কিশোরীরা আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা খুবই কম হলেও তাদের কাছ থেকে আশেপাশের বয়স্ক মানুষ আক্রান্ত হলে বড়সড় বিপদ ঘটতে পারে। ঠিক তেমনই, আগাম-সতর্কতার নীতি (প্রিকশনারি প্রিন্সিপল) – যাতে কিনা মেনে নেওয়া হয়, বড়সড় বিপদের মুহূর্তে জরুরি প্রতিষেধক বা নিবারক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করাটা জরুরি নয় – এই নীতি জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও যাঁরা চিকিৎসকের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে অভ্যস্ত, তাঁরা এই নীতির তাৎপর্য অনুধাবন করে উঠতে পারবেন না। কেননা, ডাক্তারি করার সময় ছোট স্কেলে ভাবার অভ্যেস – সামনে থাকা রোগীটিরই কথা ভাবা হয় মাত্র – সেখানে চিকিৎসাটা অসুখ হলে তারপরই করা হয়, যাকে প্রতিক্রিয়ামূলক ভাবনা বলা যায় – যে চিন্তাপদ্ধতির সঙ্গে অসুখ-হতে-পারার-আগেই পদক্ষেপের প্রো-অ্যাকটিভ নীতির বিস্তর ফারাক।
বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি অক্ষুণ্ণ রেখেই ব্যক্তিমানুষের স্বাস্থ্যকে সামগ্রিক স্বাস্থ্যভাবনার সঙ্গে এক করে দেখার যে ভাবনা – চিকিৎসামুখী ভাবনা বা ডাক্তারি-চিন্তাপদ্ধতি, যা কিনা বর্তমানে সর্বত্র বিরাজমান – তা উত্তরোত্তর জনস্বাস্থ্যের ভাবনাকেও আচ্ছন্ন করে ফেলছে, যে বিপদ ইতোপূর্বে এত বেশি করে কখনোই ঘটেনি। ডাক্তারি-চিন্তাপদ্ধতি ডাক্তারবাবুদের ভাবনাকে প্রভাবিত করছে তো বটেই, জনস্বাস্থ্যের যে পাঠক্রম, যেখানে পড়াশোনার শেষে ভারি ভারি ডিগ্রি দেওয়া হয়, সেই পাঠক্রমগুলোকেও ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে এই ডাক্তারি-চিন্তাপদ্ধতি। সেখানেও ‘ডাক্তারবাবু’-দেরই ভিড়। এমনটি ঘটতে পারার প্রধান কারণ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসা-ভাবনার যে আদর্শ, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের আদর্শের সঙ্গে মিলে যায়।
অন্তত ১৯৯০-এর দশক থেকেই, ক্লিন্টনের সংস্কারনীতির সময় থেকেই, মার্কিন রাজনীতি বেসরকারিকরণ, মুক্ত অর্থনীতি, মুক্ত বাজারের আদর্শের দিকে হাঁটছে। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল – ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান, উভয়েই – সেই আদর্শকেই শিরোধার্য করেছে। এই আদর্শ সবার কাছে পরিষেবা ও সামগ্রী তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে হাত গুটিয়ে নিতে বলে এবং সেই কাজ যাতে বেসরকারি উদ্যোগে অধিক হতে অধিকতর মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে, সেদিকে নজর দেয়। কিন্তু এমন বন্দোবস্তে অসাম্য তো বাড়েই, তদুপরি এই ব্যবস্থায় যাবতীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রগুলোই নড়বড়ে হয়ে যায়। সরকারের প্রতি নাগরিকের ভরসা, এক নাগরিকের সহনাগরিকের প্রতি আস্থা – সবই নষ্ট হয়ে যায়। যে অবিশ্বাসের একটা চেহারা আমরা সদ্য দেখলাম টিকাকরণ বিষয়ে মানুষের অবিশ্বাসের মধ্যে।
এই বেসরকারিকরণের মানসিকতারই প্রকাশ আমরা দেখলাম, যখন খোদ প্রেসিডেন্টের নিয়োগ-করা ‘কোভিড-রেসপন্স কো-অর্ডিনেটর’ ডা আশিস ঝা কোভিড টেস্ট, কোভিড টিকা, কোভিড চিকিৎসার ওষুধপত্র সবকিছুরই বাণিজ্যিকীকরণের পক্ষে সওয়াল করলেন। আদতে সরকার-নিয়োজিত জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন কমিটির মাথায় বসে থাকা হর্তাকর্তারা যে সওয়াল করে চলেছেন, তার মধ্যে, মূলগতভাবেই একটি স্বতঃবিরোধ রয়েছে – মোদ্দা কথাটা হলো, জনস্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণ কখনোই একটি গ্রহণযোগ্য নীতি হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু মুশকিল, খোদ প্রেসিডেন্ট যখন নিজের মতো করে জনস্বাস্থ্যের হর্তাকর্তাদের নিয়োগ করেন, তখন জনস্বাস্থ্যের রাজনীতির পরিসরটা দখল করে দলীয় আর্থরাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণ ও অগ্রাধিকার নির্ধারণও তদনুসারী।
সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের যে সমস্যা ও তার কারণগুলো – যেমন শ্রমিকের কর্মসুরক্ষার অভাব, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, ওষুধ-কোম্পানির লাগামছাড়া বাড়বাড়ন্ত ও অনাচার, মুনাফাকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সবার নাগালের মধ্যে না আসতে পারা, আর্থিক অসাম্য – এই সবকিছু এড়িয়ে তথাকথিত জনস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞদের কাজ দাঁড়ায়, বর্তমান ব্যবস্থাটিকেই যেনতেনপ্রকারেণ টিকিয়ে রাখা ও তাঁদের রাজনৈতিক প্রভুদের উজ্জ্বল করে দেখানো। না করতে চাইলে, তাঁদের বিদেয় করে নতুন কোনও ডাক্তারবাবুকে সেই স্থানে বসিয়ে দেওয়া হয়। উপযুক্ত লোক পেতে অসুবিধে হয় না, কেননা অনেকেই তো এই সব পদের জন্য লালায়িত থাকেন।
বর্তমানে জনস্বাস্থ্যের হর্তাকর্তারা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশগ্রহণ করেন – অথচ জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন কমিটি সম্পূর্ণভাবে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত থাকবে এবং সেই কমিটিগুলো বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মন্ত্রীসভাকে তদনুসারী পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেবে, এমনটাই তো হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এমনটি যদি হতে হয়, তাহলে কমিটিতে কারা থাকবেন, সেই নির্বাচনপদ্ধতিকে হতে হবে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত। ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিস অফ সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিন (সংক্ষেপে, ন্যাসেম) গঠিত হয়েছিল ১৮৬৩ সালে – তাদের কাজ রাষ্ট্রের বিজ্ঞাননীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে দেশের কংগ্রেসকে উপদেশ ও নির্দেশ দেওয়া। জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন কমিটির মাথায় থাকার ব্যাপারে কারা উপযুক্ত, তা ন্যাসেম-এর পদ্ধতি অনুসরণ করে করা যেতে পারে, সেভাবেই নির্বাচন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য-কর্তারা দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেন, সত্যিসত্যিই জনগণের স্বার্থ দেখতে পারেন।
যে পদ্ধতিই অনুসৃত হোক না কেন, শুরুতেই আমাদের মেনে নিতে হবে যে, জনস্বাস্থ্যের নীতি যেভাবে পরিচালিত হয়, যেভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, তা, স্বভাবগুণেই, একান্তভাবে রাজনৈতিক (দলীয় রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না)। যাঁরা জনস্বাস্থ্যের হর্তাকর্তা হয়ে রাজনৈতিক ভাবনা থেকে দূরে সরে থাকতে চাইবেন, তাঁদের কাজকারবার ফালতু শুধু নয়, তার চাইতেও খারাপ। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের যে মূলগত রাজনীতি, তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য জরুরি দলীয় রাজনীতির প্রভাব বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থানুসারী ভাবনা থেকে জনস্বাস্থ্যকে মুক্ত রাখতে পারা। জনস্বার্থে পদক্ষেপ গ্রহণ, কর্পোরেট-কর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের মতের বিপরীতে গিয়ে জনমুখী জনস্বাস্থ্যের নির্দেশিকা জারি, এবং এই সব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন – দলীয় রাজনীতির ফাঁদ থেকে দূরে থাকতে না পারলে জনস্বাস্থ্য-কর্তাদের পক্ষে একাজ সম্ভবই নয়।
ডা ফাউচি বা ডা ঝা-এর মতো ডাক্তারবাবুরা, এই অতিমারীর শেষে, সাধারণ মানুষের কাছে বাড়াবাড়িরকমের পরিচিত নাম। পাব্লিকের বিরক্তির অভিমুখও তাঁরাই হয়েছেন অনেকসময়। কিন্তু বৃহত্তর জনমানসে পরিচিতির এই সুযোগটা তাঁদের ব্যবহার করা উচিত। ঠিক কী কী সীমাবদ্ধতার মধ্যে তাঁদের কাজ করতে হয়েছে, সেই সব কথা জনসমক্ষে খুলে বলার পক্ষে এটাই তাঁদের পক্ষে উপযুক্ত সময়। এবং কমিটির কী কী কাঠামোগত সমস্যার জন্য সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, কাঠামোর কোন ত্রুটির জন্য জনস্বাস্থ্য কমিটিকে আমজনতার স্বার্থ দেখার পরিবর্তে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে – সেই কথাগুলো খোলামেলাভাবে বলতে পারা উচিত। বলে প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেসের দৃষ্টিও, এইসময়ই, আকর্ষণ করতে পারেন। প্রেসিডেন্টেরও বোঝা উচিত, বিজ্ঞান-বিরোধী অ্যাজেন্ডা নিয়ে অতি-দক্ষিণপন্থীদের পুনরায় মাথাচাড়া দেওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। এমতাবস্থায় জনস্বাস্থ্যের কাঠামোগত পরিবর্তনের কথা ভাবার মধ্যেই রয়েছে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং আমজনতার উন্নতিসাধনের সুযোগ, দুইই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য-নীতির কাঠামোগত পরিবর্তন করার কাজটা সহজ নয়। শুধু বিভিন্ন কমিটিতে পরিবর্তন বা কমিটির নির্বাচন-পদ্ধতিতে পরিবর্তন দিয়ে বড় রদবদল সম্ভব হবে না – বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়া যে বড় বদল আসবে না, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এও ঠিক, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে যাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, সেইসব কমিটির রদবদল এই মুহূর্তে যতখানি জরুরি হয়ে পড়েছে, কয়েক বছর আগেও হয়ত কাজটা তত জরুরি ছিল না। এই সময়ে, ঠিক এই মুহূর্তে যখন সুযোগের দরজাটায় স্বাভাবিক সময়ের চাইতে একটু হলেও বেশি ফাঁক রয়েছে, তখন অন্তত খানিকটা বদল অর্জন করতে পারার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। না পারা গেলে, ভবিষ্যৎ-ব্যর্থতার শোচনীয় পরিস্থিতির আভাসও, ওই দরজা দিয়েই, দেখা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্যের বৃত্তে পত্রিকার মে, ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত।