লগ্ন গোধূলি, খালপাড়ের সন্ধেবেলা, ভাঙা সিমেন্টের টুকরোর ওপর উপবিষ্ট বুড়ো হাতুড়ে। আজ ওনার ভারি মনখারাপ। এ্যাকে দু হাজার সাত সালে কেনা একটা শৌখিন চটি আজ ফেলে দিতে হলো। তার ওপরে ওনার কোকোডাইল (এখন ওনার কুকুরের নাম কোকোডাইল। ভদ্রমহিলা মায়াময় চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে ‘কুমিরের মতো দাঁত বার করে’ ওনাকে কামড়ে দ্যায়, সেই জন্য এই নামকরণ) আজকে ওনার রান্না করা মাংস একটু খেয়েই শৃগালের মতো উর্ধমুখী হয়ে কেঁদে’ চলেছে। অথচ উনি রুল অভ ফোর অনুযায়ী সব মশলা (লঙ্কা থেকে লবণ, পাঁচফোড়ন থেকে গরম মশলা, সবই চার চামচ করে’ দিয়েছেন।)
এমন সময়ে একজন ধর্মহীন মানুষ দুগ্গা পুজোর চাঁদা তুলতে বেরিয়ে হাতুড়েকে দেখতে পেয়ে’ সটান ওনার অভিমুখে রওয়ানা দিলেন।ইনি একজন পরম ধর্মহীন মানুষ। মা বাবার শ্রাদ্ধশান্তি ইনি করেননি- যদিও শ্রাদ্ধশান্তি ইত্যাদি মোটেই বাঞ্ছনীয় নয় এবং বিতর্কিত বিষয়। কিন্তু ইনি সকল হিন্দু উৎসবে সক্রিয় অংশ নিয়ে (চাঁদা তোলা একটা পুণ্যকাজ) মুখপত্রিকায় সগৃহিনী চমৎকার চমৎকার সব ছবি সাঁটান। ক’দিন আগে উড়ুক্কু কালীবাড়িতে দন্ডী কাটার ছবি দিয়ে সকলের প্রভূত মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। তো সেই ভদ্রলোককে আমরা ভন্ডুলবাবু বলে’ ডাকবো (পুরাকালে ভন্ডুল নামে একজন মহামতি ঋষিবাবা ছিলেন)।
কুকুরের দাঁতে কি বিষ থাকে?
“হাতুড়েদা, আমার ছেলেকে কুকুরে আঁচড়ে দিয়েছে”
হাতুড়ে শিশুসুলভ সারল্যে প্রশ্ন করেন “কেন?”
“কুকুরটা ঘুমোচ্ছিলো। ছেলে কানে ফুঁ দিয়েছিলো”
আত্মমগ্ন হাতুড়ে বলেন “হয় না।সাধারণতঃ এভাবে হয় না।”
“কুকুরের দাঁতে বিষ থাকে না?”
বুড়ো খানিক আকাশে তাকিয়ে থেকে, উদাসমুখে পা নাচাতে নাচাতে বললেন “অহি, ভুজঙ্গ, আশীবিষ,পন্নগ, দ্বিজিহ্ব,সাপ, নাগ…”
“আরেঃহ, থামুন মশয়, এগুলো কী জিনিস?” “তাহলে কুকুর আর সাপ সমার্থক?” ভন্ডুলবাবু একটু তো তো করে বললেন “তাহলে?”
“দেখুন, যে কোনও স্তন্যপায়ী, উষ্ণ রক্তের জন্তু থেকেই এই রোগ ছড়াতে পারে। এমনকি আপনার থেকেও হতে পারে। সেই জন্য জলাতঙ্ক হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা আগে ইঞ্জেকশন নিয়ে তারপর কাজে যোগ দ্যান।” বলে ক্ষ্যাঁ ক্ষ্যাঁ করে’ খানেক হেসে নিয়ে, ফের আবার শুরু করেন “বুনো জন্তুর মধ্যে খ্যাঁকশেয়াল, রাক্কুন, স্কাঙ্ক (এনারা দুজন উত্তর আমেরিকাবাসী), বাদুড় বিশেষতঃ ভ্যাম্পায়ার বাদুড় থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় গবাদি পশুদের (ইশকুল থেকেই গবাদি পশু আর গব্য ঘৃত পড়ছি। কাকে বলে ঠিক জানা নেই।) এই রোগ হয়। আর পোষা জন্তুদের মধ্যে বেড়াল, কুকুর, ঘোড়া এবং গবাদি(এক্ষেত্রে গোমাতা প্রযোজ্য) পশুদের থেকে মানুষের এই রোগ হয়।”
“তাহলে কুকুরের নামে দোষ কেন?”
বুড়ো আড়নয়নে ভন্ডুলবাবুর দিকে চেয়ে বললেন “কৌকৌ (কুকুর) মানুষের সেরা বন্ধু তাই। এটা ক্ষুদ্র প্রতিদান মাত্র। আর কুকুরের মৃত্যু সাধারণতঃ মানুষের চোখের সামনেই হয়, সুতরাং সহজে হিসেব মিলে যায়। খ্যাঁকশেয়ালী পালায় ছুটি। সে তো আর মানুষের চোখের সামনে মরে না, তাই সাধারণ লোকে জানতে পারে না। ইঁদুর টিঁদুরের ক্ষেত্রে এই রোগ এখনও ধরা পড়ে নি। তবে জলাতঙ্কে কাঠবিড়ালীর মৃত্যুহার ০.০৪% মাত্র। তবে হয়। এবং জলাতঙ্ক রোগ পরীক্ষার একমাত্র উপায় মৃত জন্তুর ব্রেইনে জীবাণুর উপস্থিতি।সুতরাং জ্যান্ত অবস্থায় রোগটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার কোনও উপায় নেই।”
তাহলে কুকুরে কামড়ালে আব্বুলিশ স্তন্যপায়ী উষ্ণ রক্তের প্রাণী কামড়ালে, কী কর্তব্য?
হাতুড়ে পকেট হাৎড়ে বিড়ি সিগারেট না পেয়ে, গভীর বেদনায় বলতে থাকেন “দেখুন মশয়, এটা এ্যাতো সহজ প্রশ্ন নয় যে এ্যাক্কথায় বলে দেবো। দুটো কথা আছে। কিন্তু গলাটা শুকিয়ে গেছে। একটু চা না হ’লে তো আর বকতে পারি নে।” বলে ফের উদাস নয়নে মেঘলা আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন। হয়তো মেঘে ঢাকা তারা দেখছিলেন।
ভন্ডুলবাবু বিরস বদনে চা আনতে চললেন।
চা খেয়ে বুড়ো মুখ খুললো “যে জন্তুর রেবিস বা জলাতঙ্ক হয়েছে, একমাত্র তার থেকেই এই রোগ হ’তে পারে। যখন নার্ভ বেয়ে বেয়ে সেই জন্তুর ব্রেইনে এই রোগের জীবাণু (ড়্যাবডোভাইরাস, করোনার মতোই আরএনএ ভাইরাস) পৌঁছে যায়, তখন থেকেই জন্তুর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। জন্তুর ব্যবহারেও ভিন্নতা দ্যাখা যায়। তখন এই জীবাণু এসে তার লালা বা স্যালাইভা’তে চলে’ আসে। লালায় জীবাণু এসে গেলে তবেই সেই জন্তুর কামড় বা আঁচড় থেকে অন্য জন্তুর (মানুষ ইনক্লুডেড) শরীরে এই রোগ ঢোকে।”
ভন্ডুলবাবু হাঁফ ছাড়েন “উফফফফ, তাহলে আঁচড়ালে হবে না? বাঁচলাম।”
“যদি রোগগ্রস্ত জন্তুটা আঁচড়ানোর আগে জিভ দিয়ে তার থাবা চেটে থাকে, তাহলে আঁচড়ালেও হবে”
ভন্ডুলবাবু নিথর, নিস্তব্ধ।
“কিন্তু রোগাক্রান্ত এই পশু রোগলক্ষণ প্রকাশের দশদিনের মধ্যেই মারা যাবে। এবং যদি জন্তুটার অসুখের কোনও লক্ষণ না থাকে।তাহলে ধরে’ নেওয়া যায়, জন্তুটা রোগমুক্ত”
কী করে বুঝবো জন্তুটার রোগ নেই?
“যেহেতু রোগজীবাণু ব্রেইনে পৌঁছলে তবে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়, সেহেতু রোগের লক্ষণগুলো ব্যবহারঘটিত হয়। প্রথমতঃ জন্তুটা অল্পে বিরক্ত হবে, যাকে দেখবে তাকেই কামড়াতে আসবে। খাওয়া বন্ধ করবেই। অথবা এ্যাকেবারে নিথর পড়ে থাকবে। অর্থাৎ ফিউরিয়াস এবং প্যারালাইটিক। দুজনেই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বোধবুদ্ধি হারিয়ে কামড়াতে পারে। দুক্ষেত্রেই সে খাওয়া বন্ধ করবে।”
“আঁচড়ালেও ভয়? রক্ত না বেরোলেও?”
“হ্যাঁ গো, এই জীবাণুটা নার্ভ বেয়ে বেয়ে ব্রেইনে যায়। এমনকি আপনার ক্ষতস্থান চেটে’ দিলেও হতে পারে। যেহেতু চামড়ার সব থেকে ওপরের অংশেও নার্ভতন্তু আছে। এবং সেই নার্ভ বেয়ে জীবাণু ধীরে ধীরে ব্রেইনে যায়।সেই জন্য রোগাক্রান্ত জন্তুর আঁচড়, কামড়, দুইই ভয়ানক বিপজ্জনক। এমনকি দ্যাখা যায় না, এমন একটা ছোট্ট আঁচড়ই যথেষ্ট। তারপর অবধারিত মৃত্যু। একশো পার্সেন্ট গ্যারান্টি।”
তাহলে উপায়?
“একমাত্র উপায় ভ্যাক্সিন নেওয়া। ‘পৃথিবীতে এটাই একমাত্র ভ্যাক্সিন, যেটা রোগ জীবাণু ঢোকার পরে নিতে হয়’। আমরা ভুলবশতঃ টিটেনাসের ভ্যাক্সিন কেটে যাওয়ার পরে নিই। এটা আগে নিয়ে কোর্স কমপ্লিট করে’ রাখতে হয়। আগে না নেওয়া থাকলে অন্য ব্যবস্থা।
আর একমাত্র র্যাবিসে ভ্যাক্সিন কামড়ানোর পরে নিতে হয়। জন্তুটা র্যাবিড হলে দু রকমের ওষুধ লাগে। ভ্যাক্সিন এবং ইমিনোগ্লোবিউলিন (এটা তৈরি করে প্রতিরোধ ক্ষমতা)। যাতে ভ্যাক্সিন কাজ করার মতো যথেষ্ট সময় পায়। সব ভ্যাক্সিনই শরীরে গিয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে কিন্তু সেটার জন্য কিছুটা সময় লাগে। এবং যত গভীর কামড় হোক, সেলাই না করলেই ভালো হয়। নৈলে আরও নার্ভের ক্ষতি এবং দ্রুত রোগ ছড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি হবে।”
তাহলে উপায়? সব কুকুর স্যরি জন্তু মেরে ফ্যালা?
সব পোষ্য এবং ঘরোয়া জন্তদের প্রতি বছর ভ্যাক্সিন দেওয়া। আপনি মশয় নিজের এবং মানুষদের স্বাস্থ্যের দাবীই করতে শেখেন নি….”
হাতুড়ে বাক্য অসমাপ্ত রেখে ঘ্যুঁৎ ঘ্যুঁৎ করে’ হাসতে থাকেন।
ভন্ডুলবাবু হাতুড়ের মস্তিষ্কের স্থিরতায় সন্দিহান হয়ে ফের চাঁদা তুলতে চলে যান। বরং চাঁদায় একটা কমিশন থাকে, টার্গেট দিতে পারলে হেঁ হেঁ কমিশন আরও বাড়ে। সুতরাং হাতুড়ে তাঁর বাণী নিয়ে পেঁকো খালপাড়েই পড়ে রইলেন।