খুব অভিমান হয়েছিল। জেলার চিফ মেডিকেল অফিসার স্যার আমাদের কলেজেরই সিনিয়র। আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। সার্জারি সাবজেক্টটা ওনারও খুব পছন্দের। মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করেন – “কি কি ভালো অপারেশন করলি বল।” আমি লম্বা ফিরিস্তি দিই। তিনি কিনা সব জেনেও এরকম কথা বললেন!
জেলা হাসপাতালে এসে বেশ কয়েকটি বড়ো বড়ো অপারেশন করেছি। থাইরয়েড, প্যারোটিড ছাড়া প্রস্টেট, নেফ্রোলিথোটমি অর্থাৎ কিডনি থেকে পাথর বার করা ইত্যাদি জেলা হাসপাতালের তুলনায় “জারা হটকে” অপারেশনও করেছি। ব্রেস্ট ক্যান্সারের অপারেশন অনেকগুলো করা হয়ে গেছে। পেনিস, টেস্টিস ক্যান্সারের অপারেশনও হয়েছে। অর্কিডোপেক্সি বা অন্ডকোষ ঠিক জায়গায় নামিয়ে আনার ছবি তো স্যারকে আমি নিজে দেখিয়েছি। প্রতিমাসে আমার অন্ততপক্ষে চারখানা গলব্লাডার রাখা থাকে। স্যার সব জেনেশুনে সবার সামনে বললেন যে আমি নাকি ছোটখাটো অপারেশন করে সংখ্যা বাড়িয়ে রাখি।
খুব মন খারাপ নিয়ে স্যারকে বললাম অপারেশনের খাতা চেক করে নিতে। কদিন আগেই এক প্রথম সারির দৈনিকের জেলার পাতায় আমার অপারেশনের খবর ছাপা হয়েছিল। সেও এক গল্প। সে-তো সিএমওস্যারের জানা।
আমি সপ্তাহে একদিন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চেম্বারে রোগী দেখি। সেখানে জাহিরভাই বলে একজন একদিন দেখাতে এসেছিল। গলার গলগণ্ড প্রায় বুক ছুঁয়েছে। সামান্য কাঠের কাজ করে। বেহদ্দ গরীব। তার ওপর দিনদিন চন্দ্রকলার মতো থাইরয়েডটি বেড়ে খোলতাই রূপ হয়েছে। পরিচয় দেবার যন্ত্রণায় বউ ছেড়ে চলে গেছে। আমি আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করি আগে ডাক্তার দেখায়নি কেন? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঝোলা থেকে বেড়াল বার করে। সাথের ঝোলাটাকে আগে খেয়াল করিনি। প্রায় কৃত্তিবাসী রামায়ণের সাইজের একতাড়া কাগজপত্র সেখান থেকে বেরোয়। কলকাতার প্রায় সব বড়ো হাসপাতাল তার ঘোরা। কাগজগুলো খুঁটিয়ে দেখলাম। কোনো পরীক্ষাতেই ক্যান্সার ধরা পড়েনি। বুঝলাম অপারেশন চলাকালীন বা অপারেশনের ঠিক পরপরই মারাত্মক বিপদের সম্ভাবনা আছে বলে সবাই দ্বিধাগ্রস্ত। কলকাতায় নাকি সবাই মিলে টেপাটেপি করে ছেড়ে দেয়। বুঝলাম, এরকম রেয়ার কেস ছাত্রছাত্রীরা সুযোগ বুঝে পড়ে নেয়।
“Fools rush in where angels dare to tread.” ব্যাস, আমার মধ্যের বোকাটা ক্ষেপে উঠলো। জাহিরকে বললাম হাসপাতালে আসতে। কঠিন অপারেশন, তাই অজ্ঞান করার ডাক্তারবাবু বা অ্যানাস্থেটিস্টকে দেখালাম। ডাক্তার পুলক রায়চৌধুরী তো বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমাকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল বিশ্লেষণ করে ভয় দেখাবার চেষ্টা করলেন। ভবি ভোলবার নয়। নিরুপায় হয়ে বললেন যে ব্লাডব্যাংক, আইসিইউ আর কয়েকজন নামকরা গুন্ডাকে যেন আগে থেকে খবর দেওয়া থাকে। কয়েক ইউনিট রক্ত লাগবে, আইসিইউ ব্যাকআপ লাগবে আর পেশেন্ট মারা যাবার পর লোকজন যখন আমাদের মারতে আসবে তখন আমাদের বাঁচাতে কিছু নামকরা গুন্ডা লাগবে।
নির্দিষ্ট দিনে অপারেশন হলো। ডাক্তার রায়চৌধুরীর আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে রোগীর জ্ঞানও ঠিকঠাক ফিরলো। গলা থেকে অ্যানাস্থেসিয়ার টিউব বার করে দেবার পর শ্বাসনালী চুপসে যাওয়ার যে ভয়টা ছিলো সেটাও হলোনা। মোটকথা জাহিরভাই বহাল তবিয়তে আইসিইউতে ঢুকলো। গুন্ডা ভাড়া করার পয়সাটাও আমার বেঁচে গেল।
কিন্তু এর পাশাপাশি আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল। ছোট শহর, জাহিরভাইকে অনেকে গলা দেখে চিনতো। বাংলার এক প্রথমশ্রেণীর দৈনিকের সাংবাদিকের মনে হ’ল খবরটা সবাইকে না জানালে অনেকেই জাহিরকে খুঁজে পাবে না। জেলার পাতায় একেবারে লীড নিউজ হয়ে খবরটা প্রকাশ পেলো।
সিএমও স্যার খুব খুশি। “ভালো ভালো অপারেশন কর। কোনো ঝামেলায় পড়লে আমি তো আছি। ” সত্যিই সবরকম পরিস্থিতিতে উনি আমার পাশে দাঁড়াতেন। কিন্তু হঠাৎ করে তাঁর চেম্বারে ডেকে আমাকে বকাবকি করায় খুব কষ্ট পেলাম। জাহিরভাইয়ের অপারেশনের খবর কাগজে বেরনোর পর থেকে জেলা হাসপাতালের ডাক্তারদের সাথে সাংবাদিকদের ভালো একটা সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। গত শীতে স্যারের মধ্যস্থতায় ওদের সাথে ডাক্তারদের একটা ক্রিকেট ম্যাচ হ’ল। প্রমোদ যাদব মেডিসিনের ডাক্তার, ভালো ক্রিকেট খেলে। প্রমোদকে স্যার খেলাটা সুষ্ঠুভাবে করানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। খেলার চার-পাঁচ দিন আগে প্রমোদের ফোন – “দাদা, স্যার তোমাকে ক্যাপ্টেন হতে বলেছেন। আর বলেছেন পুরষ্কার দেওয়ার সময় থাকবেন। আর আর্মির কিছু অফিসার থাকবেন। তাঁদের সামনে মাথা নিচু করাতে খুব আপত্তি স্যারের।”
কলেজ জীবনে ক্রিকেট খেলে পুরস্কার বলতে বাঁদিকের ফ্র্যাকচার ক্ল্যাভিকল- কণ্ঠার হাড় ভেঙে যাওয়া। প্রমোদ ছক কষতে বসে গেলো। “তুমি তো ক্রিকেট খেলতে, শুধু একটু প্র্যাকটিসের প্রয়োজন।” তারপর তিনদিন ধরে প্র্যাকটিস চললো। গভর্নমেন্ট কলেজের মাঠে ভাড়া করে আনা বোলারদের বলে। বাড়িতে ফিরে সবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছিল – সারা গায়ে এতো কালশিটে পড়ছে কিকরে! ক্রিকেট বডি কন্ট্যাক্ট গেম না হলেও বলের তো আর বডিতে কন্ট্যাক্ট করতে বাধা ছিলনা। ভাবছিলাম, এবার অন্যদিকের ক্ল্যাভিকেল না ভেঙে বসে। তিনদিন বাদে সারা গা হাত-পায় প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে মাঠে নামলাম। প্রমোদের বুদ্ধির প্রশংসা করতে হবে – আমাদের দলে একগুচ্ছ অন্য রাজ্য থেকে পড়তে আসা পিজিটি। সব অল্পবয়সী ছেলে। আমাদের আন্ডারে ডিএনবি করছে। প্রমোদ কড়া করে তাদের বলে রেখেছিল যে সবাই মাঠে না গেলে থিসিস পেপারে সই করবোনা। ইজ্জত কা সওয়াল হ্যায় ভাই। সবাই দারুণ খেললো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার – বল হাতে ভেলকি দেখালো আমার সার্জারির কলিগ প্রসূন আর ব্যাট হাতে প্রমোদ। আমাদের ছাত্রদের ওপর বেশি নির্ভর করতে হলো না।
জিতে যাওয়ার পর সিএমও স্যার মুচকি হেসে বললেন “জানতাম, তুই থাকলে দলটা উতরে যাবে।”
পরেরদিন একটা ছোট কাগজে ছোট করে ডাক্তারদের ম্যাচ জেতার খবরটা বেরিয়েছিল।
কিন্তু যে মানুষটা আমাকে এতো পছন্দ করেন তিনি কেন এমন কথা বলছেন। আমি তো যথেষ্ট পরিশ্রম করি। “তোর শাস্তি পাওনা আছে।” স্যার তাঁর চেয়ারে বসে কড়া গলায় কথাটা বলেন। “ডিএম সাহেবের সাথে কথা হচ্ছিল। জেলায় যারা ভালো কাজ করছে তাদের ছোট একটা অনুষ্ঠান করে পুরষ্কার দেওয়া হবে। তুই বেস্ট স্পেশালিষ্টের পুরষ্কারটা পাচ্ছিস।”
তার পরের বছরেও বেস্ট সার্জনের পুরষ্কার পেয়েছিলাম। কিন্তু প্রথমবারের মতো হঠাৎ মেঘ চিরে ওঠা রামধনুর মতো আনন্দ আর পাইনি।
অভিনন্দন জানাই। আর লেখা টা খুবই ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ ❤?
অভিনন্দন জানাই আপনাকে । এরকম রামধনু বার বার আপনার আকাশে উঠুক ।
ধন্যবাদ ❤❤?
আপনার magical power এর কথা তো আমাদের অজানা নয়। এই রকম আরও অনেক রামধনু ভবিষ্যতে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। ?
জহির ভাই এর operation এর গল্প খবরের কাগজে পড়া হয়নি তাই জানবার অপেক্ষায় রইলাম।
জাহির ভাই য়ের নামটা বদলে দিয়েছি। আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্টার সুস্মিত হালদার খবরটা করেছিলো। একবার নয়, দুবার খবরটা বেরিয়েছিল।
ধন্যবাদ রিয়াঙ্কা, মতামত দেবার জন্য। ???
বুঝলাম Sir ..কিন্তু পড়া হয়নি খবর টা হয়তো চোখে পড়ে নি
First a grt human being,honest and punctual dr .He feels for the people and honest in his duty.kudos to u,keep going like this
Thanks a lot. ❤?
Bukey aay Ani!
Kawlome r scalpel Aki dokkhotaay aaro ponchaash bawchhore choluk!
KAUSIK CCU.
Pawdobi bodley diley chintey shubidha hoy!
খেলোয়াড়দের তো তুই চিনিস। নামগুলো বদলে দিতে হয় কিছু কারণে।
আর জাহিরভাই তো তোর আন্ডারে সিসিইউতে ছিল। ওর নামটাও বদলে দিয়েছি । এখনো মাঝেমধ্যে মাছ নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়। মিসেসের সাথে একটাও কথা বলেনা। ঘরে ঢুকে মাছটা কেটে বাটিতে সাজিয়ে বেরিয়ে যায়।
Anirbanda khub bhalo laglo.Anekdin pore tomar songe dekhasona holo.Sei 1996 sale Rammam-e tomai relieve korechilam.
হ্যাঁ, কেমন আছো? ❤❤❤
Ekhon obdhi bhalo achi,tumio sabdhane theko.?
খুব ভালো লাগলো আপনার ডাক্তারি জীবনের ঘটনা পড়ে এবং পুরস্কার পাওয়ার কথা জেনে। জাহির ভাই এর অপারেশনের খবর টা পড়েছিলাম পেপারে, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এরকম অনেক ঘটনা আপনার জীবনে আছে সেটা অনেকেরই জানা, বর্তমান সময়ে যেখানে বেশীর ভাগ ডাক্তার বাবু রা জাহির ভাই দের মতো মানুষ দের কথা না ভেবে টাকা রোজগার কে বেশী গুরুত্ব দেয় সেখানে আপনি মানুষের জন্য এত ভাবেন, ভালো লাগে, পুরস্কার তো দিতে পারবোনা তবে অন্তত থেকে অনেক অনেক শ্রদ্ধা জানাই আপনাকে ।