পাঁশকুড়ার কাছে একটা জায়গায় একটু কাজ ছিল। খুব ভোর ভোর বেরিয়েছিলাম। আকাশটা বেশ থম মেরে আছে। ভোরের কোলকাতার সাথে দিনের ব্যস্ততা মেলানো যায় না। এমনিতেই লকডাউনের জন্য রাস্তায় লোকজন কম। ইতস্তত কিছু জটলা। গলির কাছে চা দোকানটা এখনও খোলে নি। রতনদা আঁচে কয়লা চড়াচ্ছে। হঠাৎ কয়েকটা কুকুর কী মনে করে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো কে জানে! আমার গাড়ি গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়লো।
যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন পেরিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার দু’দিকে আকাশচুম্বী ইমারতের ভিড়। উঁচু ছাদে মেঘে ঢাকা ময়লা আকাশ মাখামাখি করে আছে। জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া ঢুকছে। মা উড়ালপুলে ওঠার পর চোখ বুজে ফেললাম। বহুদিন এত ভোরে ওঠার অভ্যেস নেই। গাড়িতে একটু সিকিঘুম দিয়ে দিতে হবে। পাঁশকুড়ার কাজ মিটিয়ে ফিরে এসে আবার বারো ঘন্টা ডিউটি। গাড়ি শাঁ শাঁ করে ছুটছে…
চোখটা লেগে গেছিল। হঠাৎ বাজ পড়ার শব্দে চমকে উঠলাম। বৃষ্টি শুরু হবে বোধহয়। চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। ফাঁকা হাইওয়েতে বহুদূর ছাড়া ছাড়া একটা আধটা গাড়ি। তাও বেশিরভাগ মালবোঝাই লরি বা ডাম্পার। ড্রাইভার দাদা জানলাগুলো বন্ধ করে এসিটা চালিয়ে দিলো। গাড়ির কাঁচে বৃষ্টির ছাঁট লাগতে শুরু করেছে। পাঁশকুড়া গিয়ে পৌঁছোলাম পৌনে সাতটায়। তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বজ্র-বিদ্যুৎ। চটপট কাজ মিটিয়ে সাড়ে সাতটায় আবার বেরিয়ে পড়লাম। দশটায় ডিউটি ধরতেই হবে।
এদিকে বৃষ্টি থামার নাম নেই। চারদিক ধোঁওয়া ধোঁওয়া। একটানা বৃষ্টির তান, ইঞ্জিনের মৃদু আওয়াজ আর ড্রাইভার দাদার মাখনের মতো গাড়ি চালানো; সব মিলিয়ে আবার ঘুমটা গাঢ় হয়ে আসছে। এমন সময়ই ঘটলো বিপত্তি! ঘটাং ঘটাং আওয়াজ তুলে গাড়িখানা বন্ধ হয়ে গেল। ঠেলেঠুলে রাস্তার এক পাশে নিয়ে আসা গেল। দাদা দেখেটেখে বললো, গ্যারাজে না নিয়ে গেলে সারানো যাবে না। মহা আতান্তরে পড়লাম। ছাতা মাথায় বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছি। এক একটা বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে একসা হয়ে যাচ্ছি। কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না… দাদা গাড়িটা নিয়ে খুটখুট করে যাচ্ছে। যদি কিছু করাটরা যায়…
হঠাৎ একটা সবুজ রঙের অ্যাম্বাসেডর গতি কমিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। এক টাকমাথা ভদ্রলোক গাড়ির কাঁচ নামিয়ে কান অব্দি হেসে বললেন– কী মশাই, গাড়ি খারাপ হ’ল নাকি?
এমনিতে তখন মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে। তার ওপর এরকম কান এঁটো করা হাসি দেখে পিত্তি জ্বলে গেল। কোনোরকমে বিরক্তি চেপে নিচের দিকে মুখ করে বললাম– হুঁ, ওই আর কী…
– তো চলুন না আমার গাড়িতে। আমিও কোলকাতার দিকেই যাচ্ছি। কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দেবো। কোন হসপিটাল আপনার?
আমি হসপিটাল যাবো বলে ভদ্রলোক জানলেন কী করে? আমি তো এখনো নিজের কোনও পরিচয় দিইনি… সাতপাঁচ ভাবছি। ভদ্রলোক হাসতে শুরু করলেন– কী ভাবছেন বুঝে গেছি। আরে মশাই, গাড়ির লোগোটা দেখেই বুঝেছি। নিন, নিন চলে আসুন। এই অতিমারীর সময় একজন ডাক্তারকে খানিক সাহায্য করার সুযোগ পেলে ছাড়ি কী করে বলুন?
এর পরে আর অবিশ্বাস করার কারণ থাকে না। দাদাকে গাড়ি গ্যারাজে দিতে বলে সবুজ অ্যাম্বাসেডরের সামনের সিটে উঠে এলাম। পেছনে টাকমাথা ভদ্রলোক ছাড়াও আরও একজন আছেন। এক ঝলক দেখে বুঝলাম, বেশ লম্বা, সুপুরুষ ভদ্রলোক। গায়ে গাঢ় বাদামী রঙের পাঞ্জাবী। পেছন ঘুরে দুজনের দিকেই তাকিয়ে হাল্কা হেসে বললাম, ধন্যবাদ! যদিও মাস্কের জন্য হাসিটা দেখা গেল না, বলাই বাহুল্য। ততক্ষণে দ্বিতীয় ভদ্রলোকও গলা খাঁকারি দিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন– শুধু লোগো নয়। সঠিক লোগো। ডাক্তারের সঠিক লোগো বড় একটা দেখা যায় না। এক সাপওলা রড অফ অ্যাসক্লেপিয়াসের জায়গায় সব জায়গায় দু-সাপওলা ক্যাডুসিয়াস দেখা যায়। ক্যাডুসিয়াস কিন্তু ডাক্তারদের প্রতীক নয়। ঠিক বললাম তো?
ভদ্রলোকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার তারিফ না করে থাকা যায় না। সঠিক ইতিহাস জ্ঞান আর সেই সাথে বৃষ্টির মধ্যেও এরকম ক্ষুরধার দৃষ্টি… হঠাৎই আমার সামনে থেকে একটা পর্দাকে যেন একটানে সরিয়ে ফেললো। সবুজ অ্যাম্বাসেডর… টাকমাথা ভদ্রলোক… সাথে লম্বা, সুদর্শন ভদ্রলোক… আমার পৃথিবী টলছে! তোতলাতে শুরু করলাম– মা-মা-মানে স্যার আপনারা… এ-এখানে…
– যাঃ! হঠাৎ আবার স্যার-ট্যার কেন? দাদাটাই ঠিক আছে। আর আমি তো এখনও নাইটহুড পাইনি, কী বলেন লালমোহন বাবু? হাসতে শুরু করলেন ভদ্রলোক।
আমি তখন বিস্ময়াহত। হতবাক। গলা শুকিয়ে আসছে। আনন্দ আর বিস্ময়ের আতিশয্যে কথা হারিয়ে ফেলেছি। ফেলুদা-ই পরিবেশটা সহজ করে দিলেন। আমি কপালের ঘামটাম মুছে গল্পে মেতে গেলাম। বর্তমানকালের রাজনীতি, অতিমারী, ঘূর্ণিঝড় কিচ্ছু বাদ গেল না। গল্প করতে করতে কখন যে গাড়ি হসপিটালের কাছাকাছি চলে এসেছে খেয়ালই করিনি। আবার একবার ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ি থেকে নামছি; ফেলুদা বললেন– আপনারও কিন্তু একটা কারণে ধন্যবাদ প্রাপ্য।
আমি আগাপাশতলা ভাবছি। আমি আবার কী উপকার করলাম? বরং, দিব্যি ওনাদের গাড়ি চেপে চলে এলাম। এত বৃষ্টিতে রাস্তায় এককাপ চা খাওয়ানোও সম্ভব হয়নি। তাহলে?
– আমি আপনার লেখা ‘ডা. নন্দ ঘোষের চেম্বার’ বইটা পড়েছি। আজ কাকতালীয়ভাবে আপনার সাথেই পরিচয় হয়ে যাবে ভাবিনি। খুব ভালো লিখেছেন। শিশুদের স্বাস্থ্য-সচেতনতা বিষয়ে এরকম বই খুব একটা দেখা যায় না। আপনার লেখার হাতটাও বেশ। অভ্যেস ছাড়বেন না।
লালমোহন বাবু বললেন– ওরেব্বাস! তাই নাকি? অন্যরকম বই। পড়ে দেখতে হয় তো… আচ্ছা, পড়ে কেমন লাগলো জানাবো।
লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছি। আমার বইয়ের প্রশংসা করছেন কিনা স্বয়ং ফেলুদা! লালমোহন বাবু আর ফেলুদা দুজনেরই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর নিয়ে রেখেছি। এসব পাওয়ার সৌভাগ্য আর ক’জনের হয়? গাড়ি থেকে নেমে হাত নাড়লাম। সবুজ অ্যাম্বাসেডর বাঁদিকে বেঁকে গেল। সোজা একশো মিটার হাঁটলেই আমার হসপিটাল…