কীভাবে ডাক্তারি করবো, সে বিষয়ে নিজের ভাবনাচিন্তাগুলো কেবলই বদলে যাচ্ছে। মোটামুটিভাবে পড়াশোনা আর শিক্ষানবিশি শেষ করার পর ভেবেছিলাম চুটিয়ে প্র্যাক্টিস শুরু করবো। কিছুদিন করতে শুরুও করেছিলাম। সারাদিন ঘুরতাম। কয়েক মাসের মধ্যেই বুঝতে পেরেছি এই ‘চুটিয়ে প্র্যাক্টিস’ ব্যাপারটা ঠিক আমার দ্বারা হবে না। বিস্তারিত আলোচনা বিতর্কিত হবে। তাই সেদিকে গেলাম না। শুধু এটুকু বলি, প্র্যাক্টিসের সাথে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন আনুষঙ্গিক ব্যাপারের বেশ কিছু দিক নিয়ে আমার সমস্যা হচ্ছিল। নার্সিং হোমগুলোতে পারতপক্ষে যাচ্ছি না। যে জায়গাগুলোতে খানিকটা নিজের মতো কাজ করতে পারি, সেগুলো ছাড়া বাকি জায়গা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। দিনের বেলা যেটুকু রোগী দেখার সেটা সেরে বাকি সময়টা নিজের জন্য রাখি। রোজ অন্তত ঘন্টাদুয়েক পড়াশোনা করি। প্রতিদিন পড়াশোনা না করলে কীভাবে রোগী দেখবো? শিখেছি তো সামান্যই। না জানার ভাগটাই অনেক অনেক বেশি। সারা জীবন ধরেই ডাক্তারির বিপুল জ্ঞানসাগরের সামনে নিজেকে ‘ছাত্র’ বলে ভাবতেই ভালো লাগবে।
সন্ধ্যের পর আমার প্রফেশনাল জীবন থেকে সম্পূর্ণ সরে আসি। এবং এভাবেই ভালো আছি। নিজের সাথে একলা হলেই অসংখ্য কথার দল ভিড় করে। কত রকমের যুক্তি-প্রতিযুক্তি, কথার ওপর কথা। ছোটখাটো যেসব বিষয় আগে সোজাসাপ্টা সাদা-কালো দেখতাম, এখন সেগুলোতেই সাদা-কালো সব মিশে গিয়ে ধূসরের বহু স্তর। বিবেকানন্দের জন্মদিন গেল। একটা সময় বিবেকানন্দ সম্পর্কে বেশ কিছু বইপত্র পড়েছি। খুব বিরাট কিছু জানি বা পড়ে ফেলেছি, সে দাবী করবো না। ওই সবাই যেমন পড়ে সেরকমই কিছু কিছু পড়েছিলাম। ছোটবেলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় প্রচুর পুরস্কার পেতাম। সব মিলিয়ে প্রায় শ’তিনেক তো হবেই। তার মধ্যেই বেশ কিছু বিবেকানন্দ বিষয়ক বইপত্র থাকতো। সেগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পড়তাম। ভালো লাগতো। বিশ্বাস আর ভক্তি সবই তখন সহজলভ্য আর একমুখী। যে বইতে যেমন লেখা থাকতো সেটাই বিশ্বাস করতাম। তখনও বুঝতাম না, তাদের বেশিরভাগই নিতান্ত ভক্তের লেখা। ভক্তি-গদগদ লেখায় যেভাবে একজন মানুষকে সর্বগুণান্বিত দেখানো হয়, এই লেখাগুলো সেরকমই। একটা সময়ের পরে এসব একঘেয়ে লেখায় অবিশ্বাস জন্মাতে বাধ্য। যেভাবে ‘অগ্নিশ্বর’ সিনেমায় উত্তমকুমারের অসাধারণ অভিনয় ছাপিয়েও পুরো কাহিনী অবাস্তব মনে হয়। বাস্তবে এরকম হয় না। হ’তে পারে না।
কিছু বছর পরে আরও অনেকগুলো বিবেকানন্দ বিষয়ক লেখা পড়লাম। যে লেখাগুলো আবার ঠিক উল্টো। পুরো লেখা জুড়েই বিবেকানন্দ সম্পর্কে নেতিবাচক কথা। বিভিন্ন বক্তব্যে তাঁর দ্বিচারিতা উঠে আসে। একঘেঁয়ে ‘ভালো’ শুনতে শুনতে হঠাৎ অন্যরকম কোনও আঙ্গিক দেখলে চমকে উঠে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। এমনকি সেটা সাদার বিপরীতে অসম্ভব কোনও ‘কালো’ হলেও। কিছুদিনের জন্য বিবেকানন্দ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নেতিবাচক অবস্থানে এলাম। আবারও সেই একই প্রশ্ন করলাম নিজেকে? একজন মানুষের সব ভালো যদি অসম্ভব হয়, সব মন্দই বা মেনে নিই কীভাবে? যেখানে অসংখ্য মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করছেন এবং যে বিশ্বাস কারও ক্ষতি করছে না। বিবেকানন্দ পড়ে কেউ খুন-জখম করেননি, ভাঙার খেলায় মাতেননি। কেউ বলেননি, আমার মতে না মিললে মাথা কাটা যাবে। বরং, অনেকেই মানসিক শান্তি পেয়েছেন। তবে? কোনটাকে মানি?
এ বিষয়ে আমার বর্তমান অবস্থান মাঝামাঝি। অবিমিশ্র সাদা কিংবা কালো নয়। বরং, মাঝের ধূসর বর্ণগুলোই বেশি করে সত্যি। মানুষ বলেই বিবেকানন্দের বহু বিচ্যুতি আছে। দ্বিচারিতা আছে। সে কার নেই? আমার আছে, আপনার আছে, সবার সব্বার আছে। হিসেব করলে দেখবেন, সারা জীবন ছাড়ুন, একটা গোটা দিনই আপনি নিজের ভাবনাচিন্তায় স্থির নন। সেটুকু মেনে নিয়েই বিবেকানন্দের বিচার করবো না কেন? তাঁকে যাঁরা মেনে চলেন তাঁরা নিশ্চয়ই খারাপ দিকগুলোকে আদর্শ মানছেন না। তাহলে সমস্যা কোথায়? যতক্ষণ কোনও মতাদর্শ সমাজের সরাসরি ক্ষতি করছে না, ততক্ষণ মানুষের বিশ্বাসকে আঘাত করার অধিকার কেউ কাউকে দেয়নি। একজন মানুষ ওই পরাধীন ভারতে থেকে সাদা চামড়ার ঔদ্ধত্যের সামনে বুক চিতিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছেন, শুধু এটুকুর জন্যই কুর্ণিশ জানানো যায়। জাতিভেদ প্রথার কালো অন্ধকারের সামনে (অন্তত একবার) তিনি সাম্যের আলোটুকু ধরার কথা বলছেন, সেটাও বা কম কী? তাঁর দ্বিচারিতার বিরোধিতা করবো। একশোবার করবো। কিন্তু তাঁর কৃতিত্বটাও মানবো। মানতেই হবে। আর হ্যাঁ, মানুষকে তাঁর সময়ের সাপেক্ষে বিচার করতে হয়। অতদিন আগের কথা ছাড়ুন। নিজের বছর দশেক আগের পোষাক কিংবা কথাবার্তা দেখলেই আপনার হাস্যকর লাগবে, এটাই সত্যি। তবু সেই সময়টা মিথ্যে নয়। আজকের দিনে তার গুরুত্ব না থাকলেও তাকে অস্বীকার করা মুশকিল। যেভাবে শ্রীচৈতন্য আমার কাছে বিপ্লবের আরেক নাম। ওই যুগে দাঁড়িয়ে ব্রাহ্মণ থেকে অন্ত্যজ সবাইকে একই নামগানের সুরে বাঁধতে পারাকে বিপ্লব ছাড়া আর কী বলবো? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ‘হরিনামে মুক্তি’কে হাস্যকর লাগবে হয়তো। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের সময়টা ভাবুন। সুধী, সমালোচনার আগে সময়টা ভাবুন।
কাউকে ভালো বা খারাপ যাই বলুন, সেটা সামগ্রিকতার বিচারে বলুন। যুক্তি দিয়ে বলুন। নিজের মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে গালাগালি বা পাতি বাংলায় ‘ছ্যাবলামি’র আশ্রয় নিতে হ’লে, সেটা আপনার বক্তব্যের যুক্তিহীনতার প্রকাশ। ক’দিন আগেই রবি ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার জয় সম্পর্কিত একটি অশ্লীল মিম দেখেছিলাম। ঘটনাচক্রে তিনি আমার বন্ধু-তালিকায় ছিলেন। আমার আপত্তি জানিয়ে তাঁকে বন্ধু-তালিকা থেকে ছেঁটে দিই। আমার বক্তব্য পরিষ্কার- রবি ঠাকুরের যাবতীয় পর্বতপ্রমাণ সৃষ্টি সত্ত্বেও তাঁকে আপনার খারাপ লাগতেই পারে। তাতে দোষের কিছু নেই। কেন খারাপ লাগে, সে বিষয়ে যুক্তিনির্ভর কিছু লিখলে আপনাকে সাধুবাদ জানাবো (সে যতই আমি রবি ঠাকুরের অন্ধভক্ত হই)। সেটা না করে কিছু দৃষ্টিকটু মিম ছড়িয়ে দিলে বোঝা যায়, আপনিও একবর্ণও রবি ঠাকুর পড়েননি, শোনেননি। আমার এই অবস্থান যে কোনও মানুষের জন্যই একই। ‘তোমাকে চাই’ লিখেছেন বলে সুমনের ব্যক্তি-জীবনের বিচ্যুতি মেনে নেবো না আবার বিচ্যুতির কালো দাগ আছে বলে তাঁর সৃষ্টিকে অস্বীকার করবো না। মানুষকে ‘ভগবান’ না বানানোর চেষ্টা করলেই হ’ল। নিজেও দেখেছি, জোর করে কিছু পরিবর্তন করতে গেলে কাজ তো হয়ই না, উল্টে হীতে-বিপরীত হয়। আগে গলায় জন্ডিসের মালা দেখলে রোগী দেখার আগে খুলে আসতে বলতাম। দেখলাম, তাতে আমার সামনে খুলে দিয়ে পরে বাইরে গিয়ে ঠিক যে কে সেই। তাই এখন অন্য রাস্তা নিই। বলি, তাবিজ-কবচে খুব বিশ্বাস থাকলে বিছানার পাশে রাখুন বা দরজায় ঝুলিয়ে দিন। আর একদম খুলতে পারলে সবচেয়ে ভালো। বুঝিয়ে বলি, কেন তাবিজ-কবচ শুধুই অন্ধবিশ্বাস। তাতে বরং কাজ অনেক ভালো হয়। দশজনের মধ্যে অন্তত দু’জন খুলেই ফেলেন। তাবিজ-মাদুলির নোংরা থেকে বাচ্চার চামড়ার সংক্রমণ হওয়াটা অনেকটা আটকায়। এসব হরেক ভাবনা-চিন্তা নিয়ে ক্রমাগত দুলতে থাকি। প্রতিদিন একটু একটু করে চিন্তাভাবনার সাদা-কালো সরে যায়। জেতার জন্য দু’পা পিছিয়ে আসাকে হেরে যাওয়া বলে না। সেটা আসলে জেতারই কৌশল।
‘সেই সময়’ উপন্যাসটা শুরু করেছি। এতরকম কাজের মাঝে খুব ধীরে ধীরে পড়া এগোচ্ছে। চোখের সামনে ইতিহাসকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখছি। রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠছেন বিদ্যাসাগর, মধুসূদন… কোনও কিছুর বিনিময়েই এসব দেখার চোখ বিকিয়ে দিতে পারবো না। প্রফেশনাল চাপের কাছে মাথা না নামিয়ে নিজের মতো থাকার চেষ্টা করছি। এমনিতেই আমি যেভাবে রোগী দেখি তাতে বেশ সময় লাগে। কোনোদিন রোগীর সংখ্যা একটু বেশি হয়ে গেলে কষ্ট হয়। বুধবার যখন শালবনী-চন্দ্রকোণার চেম্বার সেরে বেরোচ্ছি, মাথা আর হাত দুটোই বোঁ বোঁ করছে। খুব বেশি গুরুতর সমস্যা নেই এরকম পাঁচ-সাতজনকে ফেরাতে হয়েছে। সারাদিন ঘাড় গুঁজে যন্ত্রের মতো রোগী দেখা আমার ধাতে সইবে না। নিজের ভাবনাচিন্তার পুরোটা দিতে না পারলে সেরকম আধাখ্যাঁচড়া কাজ না করাই ভালো। বরং, ফেরার পথে বুক ভরে শ্বাস নেবো। ধোঁওয়া ধোঁওয়া দিগন্তে স্বপ্নের মতো লাল অস্তগামী সূর্য। মাঠের পর মাঠ সবুজ। আলুচাষ হচ্ছে। কী এক মায়া জড়ানো সন্ধ্যে নামে। ইতিউতি জেগে ওঠে একটা-দুটো তারা। সূর্য ততক্ষণে অস্ত গেছে। আকাশে কর্মক্লান্ত দিনের শেষ রঙটুকুর খেলা। দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে গরুর গাড়ি, শালবন, গুমটি চায়ের দোকান… পিছিয়ে যাচ্ছে ছাতার মতো দেখতে বড় গাছটা… পিছিয়ে যাচ্ছে কংসাবতীর অগভীর জল…
হঠাৎই ধাক্কার মতো ছুটে এল খবরটা! শ্যামলদা নেই! শ্যামলদা শালবনী হাসপাতালে আমার সহকর্মী ছিল। ডাক্তার-টাক্তার পরের কথা, শ্যামলদার মতো মানুষ নিতান্তই দুর্লভ। কখনো রাগতে দেখিনি। ছ’বছর আগে যখন বন্ড সার্ভিস নিয়ে শালবনী হাসপাতালে যোগ দিই তখন আমিই প্রথম বাচ্চাদের ডাক্তার। মনে আছে সেদিন প্রথম শ্যামলদা’র সাথে ডিউটি। দাদা বলেছিল, “দ্যাখ অনেকদিন আগে পেডিয়াট্রিক্সে হাউসস্টাফশিপ করেছিলাম। সব ভুলে গেছি। ডোজ-টোজ ভুল হ’লে ঠিক করে দিস।” অনেক পাশ করা বাচ্চাদের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনেও হাস্যকর ডোজের ভুল দেখেছি। অথচ, ডোজ লিখতে শ্যামলদা’র ভুল দেখিনি। এত আন্তরিকতার সাথে রোগীর সাথে ব্যবহারও খুব কমজনই করে। গলাটা পায়রার মতো ফুলিয়ে ‘কী হ’ল, কী হয়েছে?’ আর ‘বলো মা, কী সমস্যা’ এই দুটো কথায় যে অনেকটা তফাত… শ্যামলদা’র নামের পেছনে ডিগ্রির লম্বা লেজ ছিল না কিন্তু আরও অনেককিছু ছিল যার জন্য শ্যামলদা আমার চোখে অনেক বড় ডাক্তার, অনেক বড় মানুষ। যদিও সবই আজ স্মৃতি।
কারো জন্য কিচ্ছু বদলায় না। সবই আগের মতোই চলছে। আমি যে উপযুক্ত জেনারেল ফিজিশিয়ানকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তার বলি, সেটা নিয়েও বিতর্ক হয়। একজন বলেছিলেন, ‘পাতি এমবিবিএস’ আবার ডাক্তার হ’ল নাকি? এ যেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে অধ্যাপকের চেয়ে ভালো বলা। বলেছি, প্রশ্নটা ভালো-খারাপের নয়। প্রশ্নটা গুরুত্বের। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আর অধ্যাপক, দুজনকেই দরকার। তাঁরা একে অন্যের পরিপূরক। এবং, আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাজটা আরও অনেক কঠিন। ভিত শক্তপোক্ত না হ’লে উঁচু বাড়ি দাঁড়াবে কী করে? ঠিক যেভাবে সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের জন্য এমবিবিএস ডাক্তারকেই দরকার। আবার বিশেষ রোগের চিকিৎসার জন্য স্পেশালিষ্ট ডাক্তার লাগবে।
এত কথা, এত চিন্তা, এত পড়াশোনা সামলে-সুমলে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই আবার রাত হয়ে যায়। দিনগুলো বড্ড ছোটো লাগছে আজকাল।
খুব ভাল লাগল। আমি মনে করি আমাদের সবার ব্রেনের সব অংশ সমান ভাবে সক্রিয় নয়, মানে সক্রিয়তায় কম বেশি থাকে। সেই পার্থক্য থেকে ব্যক্তিত্বও আলাদা হয়। যেমন কারও কারও যুক্তি ভাব প্রবল আবার কারও অনুভূতির প্রাবল্য বেশি। আপনার মন নরম, অনুভূতিপ্রবণ। প্রকৃতির তরঙ্গ আপনাকে স্পর্শ করে। তাই অন্য ভাবে ভাবতে পারেন। লিখে যান।