সকালের পাতলা ঘুম ভেদ করে কথাগুলো কানে এসে পৌঁছোলো। বেশ জম্পেশ একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। সব কেমন ঘোঁট পাকিয়ে গেল। আবার কানে এল, সেই এক চিৎকার- গ্যাস! গ্যাস!
এমনিতেই ক’দিন ধরে বিচ্ছিরি সর্দিকাশি-জ্বরের মরশুম চলছে। হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা নেই। এক একটা বিছানায় দু-তিনজন করে বাচ্চা ভর্তি হচ্ছে। সব বাচ্চার শ্বাসকষ্ট, জ্বর। চেম্বারেও পাঁচ-ছ’ঘন্টা একটানা শুধু সর্দিকাশির চিকিৎসা করে যাচ্ছি। অবস্থা এমনই যে, কাউকে ‘কী হয়েছে’ জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে না। সরাসরি জিজ্ঞেস করছি, “কতদিন ধরে সর্দিকাশি? জ্বর কবে থেকে?” ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতেও কয়েকজনের প্রেস্ক্রিপশন লিখে দিচ্ছি। বুকে স্টেথো বসালেই ‘শোঁ-শোঁ, চড়বড়’ আওয়াজ। অনেককেই ‘গ্যাস’ দিয়ে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এইসব করতে করতে প্রায় ‘গ্যাসের ডাক্তার’ হয়ে উঠেছি। সকালের ঘুম ভেঙে ‘গ্যাস, গ্যাস’ শুনে সেরকম কিছু হবে বলেই ভেবেছিলাম।
কিন্তু না! হঠাৎ পায়ে প্রবল টান অনুভব করে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। বুঝলাম, এ গ্যাস সে গ্যাস নয়। পিয়ালী সকাল সকাল রান্না বসিয়েছে। গ্যাস সিলিন্ডারের ওপরের নব ঠিকমতো লাগছে না। তাই এই আপদকালীন তলব। ঘুম চোখে উঠে টলতে টলতে গিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। চট করে চোখ-মুখ ধুয়ে চশমাটা চোখে লাগাচ্ছি, পিয়ালী বললো, নব লেগে গেছে! যেটা এতক্ষণ হচ্ছিল না, এবার হ’ল। বুঝতেই পারছেন, ভালো কাজ করার জন্য গুণীজনের উপস্থিতিটুকুই যথেষ্ট।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে হাসপাতাল যাত্রা। রোগী থইথই ওয়ার্ডে ঢুকলেই সামনে, পেছনে, পাশ থেকে বিভিন্ন অভাব অভিযোগ উঠে আসে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ, “কাশি কমছে না!” কী করে বোঝাই, কাশিটা ম্যাজিকের মতো কমে যাওয়ার বিষয় নয়। কমতে কিছুদিন লাগবেই। সর্দিকাশির রোগীতে এমনভাবে ওয়ার্ড ভরে থাকে যে, ভাবনাচিন্তা করার মতো জটিল রোগীদের ভালো করে সময় দেওয়া যায় না।
ওই ন’বছরের মেয়েটার কথাই বলি। এতদিন বাইরে কোথাও থেকে খিঁচুনির ওষুধ চলছিল। গতবার ভর্তির সময়ই বলে দিয়েছিলাম, এবার অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই ভিডিও তুলে রাখতে। রোগের ইতিহাস নেওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, এটা খিঁচুনির রোগ নয়। খিঁচুনি যেমন হয় তার সাথে মেলানো যাচ্ছিল না। প্রায় সপ্তাহ দুয়েক বাদে আবার ভর্তি হ’ল। এবার ভিডিওসহ। খিঁচুনি যে নয়, সেটা পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে। চোখ দুটো চেপে বন্ধ করা। এবার ভালো করে রোগের ইতিহাস জানলাম। বাবা অন্য কোথাও নতুন সংসার পেতেছে। বাচ্চা মেয়েটার সাথে ফোনে অব্দি যোগাযোগ রাখে না। কখনো সখনো ফোন করলেও চট করে রেখে দেয়। মেয়ের মনে অভিমান, রাগ জমতে জমতে শারীরিক লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়। কোঁকড়ানো চুল, বড় টানা চোখের মিষ্টি মেয়েটা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, “জানো ডাক্তারবাবু, আব্বু আমার সাথে একটু ভালো করে কথা বললেই আমি ঠিক হয়ে যাবো। আর আমার কোনও কষ্ট হবে না। তুমি আব্বুকে বলে দিতে পারবে?” পাশে মেয়েটির মা চোখ মুছছেন। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করে, মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে দায়িত্ব সঁপে, মুখ নিচু করে পালাই। অস্বস্তির বোঝা কাঁধে চেপে বসে। প্রতি মুহূর্তে বুঝতে শিখি, স্টেথোস্কোপ বইতে পারা ভীষণ কঠিন।
নেফ্রোটিক সিন্ড্রোমের বাচ্চাটার কথা বলি। এই রোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বারবার ফিরে ফিরে আসে। বিভিন্ন ধরনের স্টেরয়েড কোর্স চলে। তার হিসেব গুছিয়ে রাখতে না পারলে কোনও চিকিৎসকের পক্ষেই সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। বাচ্চার বাড়ির লোকজন পড়াশোনা না জানলে এই রোগের চিকিৎসা করা ভীষণ কঠিন। রোগ ফিরে ফিরে এলে, এর ওর পরামর্শে বাচ্চা শুধু এক ডাক্তার থেকে আরেক ডাক্তারের কাছে ছুটতেই থাকে। রোগের ইতিহাস না জানা থাকলে আর রোগীর জন্য বরাদ্দ সময় দু’মিনিট হ’লে কোনও চিকিৎসকের পক্ষেই সঠিক ওষুধ লেখা সম্ভব নয়। এর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। এবার খাতাপত্র কিনিয়ে পেচ্ছাবের প্রোটিন বেরিয়ে যাওয়ার হিসেব বুঝিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। তার জন্য প্রোটিন মাপা শিখতে হবে, লিখে রাখতে হবে। খাতা-কলম আর প্রোটিন মাপার কার্ড আনতে দিয়েছি এক সপ্তাহ হ’ল। এখনো এসে পৌঁছোয় নি। একে এত সর্দিকাশি দেখতে দেখতে হাঁফিয়ে যাচ্ছি তার ওপর এসব দেখলে বিরক্তি আসাই স্বাভাবিক। রেগে গিয়ে দু’কথা শুনিয়ে দিয়েছি। বাচ্চার সাথে ঠাকুমা। ঠাকুমা’র চোখে জল। আবার ইতিহাস শোনার পালা। বাচ্চার মামাবাড়ির দাদু’র দুই বিয়ে। আগের পক্ষে দুই ছেলে। তারা আলাদা থাকে। বাচ্চার মা দ্বিতীয়পক্ষের। কাজেই মামাবাড়ির দরজা বন্ধ। বাচ্চার বাবা ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ মানুষ, হাঁটাচলা ভালো করতে পারেন না। মায়ের ওপরেই সংসারের ভার। সেভাবে অক্ষরজ্ঞান প্রায় কারোরই নেই। ঠাকুমা’র সাথে নাতনি হাসপাতালে। তাহলে কে জিনিসপত্র জোগাড় করবে? কে খাতায় লেখা শিখবে? উত্তর- নেই। সমাধান- নেই। কে বলে শুধু ওষুধে রোগ সারে?
এরপর অজস্র বুকের নানান তীব্রতার শোঁশোঁ, চড়বড় শুনতে শুনতে থ্যালাসেমিয়া ঘরে এলাম। প্রথম বিছানার মেয়েটা জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছে। হিমোগ্লোবিন ২.৬। থ্যালাসেমিয়া রোগ ধরা পড়ার পরেও কারও পরামর্শে বিভিন্ন হাবিজাবি চিকিৎসা চলেছে। রক্ত পায়নি। এখন প্রায় ধুঁকতে ধুঁকতে ভর্তি হয়েছে। বাড়ির লোকজনকে থ্যালাসেমিয়া সারিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে হাজার হাজার টাকার অশ্বডিম্ব গেলানো চলছিল। এদেশে সবই সম্ভব।
জীবনের গল্প শুনতে শুনতে আরেকটা দিন কেটে যায়।
(ওয়ার্ডে তখন দরদরিয়ে ঘামছি। বাচ্চাটার জামায় ‘হেব্বি গরম লাগছে’ লেখাটা দেখে আমারও হেব্বি লেগেছিল। এই ছোট্ট জিনিসগুলোয় মজা খুঁজে নিতে শিখলেই জীবন রঙিন। নইলে সব একঘেয়ে, পানসে। ওর মায়ের অনুমতি নিয়েই ছবিটা তোলা।)