শীত কমে যেতেই রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে শ্বাসকষ্টের সমস্যাগুলো বেশ বাড়ছে। দশটার সময় হেলতে-দুলতে চেম্বারে ঢোকা সম্ভব হচ্ছে না। সাড়ে ন’টার আগেই ঢুকে যাচ্ছি। তারপর একটানা রোগী দেখা। আমার পুরোনো রোগীরা আমার কাজ অনেকটা কমিয়ে দিয়েছেন। চেম্বারের ভেতর থেকে বাইরের গল্পগুজবের টুকরো টুকরো কথা শুনতে পাই। ছ’মাস বয়সের পর কোন কোম্পানির গুঁড়ো খাবার শুরু করা উচিত সেই সংক্রান্ত কথা উঠলে আমার পুরোনো রোগীদের বাবা-মা’রা অর্ধেক কথার উত্তর দিয়ে দিচ্ছেন, “ডাক্তারবাবু বাইরের জিনিস দিতে বারণ করেন। বাড়িতে বানানো খিচুড়ি দিন না। আমরাও দিই। আমার বাচ্চা ওই খেয়েই খুব ভালো আছে। প্যাকেটের জিনিসের দাম বেশি, পুষ্টিও ঠিক হয় না।” যে কথাগুলো বারবার বলি সেগুলো মুখে মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছে দেখে ভালো লাগে। বিজ্ঞাপনী চমকের উল্টো দিকে সাঁতার কেটে যতটা যাওয়া যায়…
ঘাড় গুঁজে পরপর রোগী দেখতে থাকি। মাঝে বারদুয়েক মিনিট দশেকের বিরতি। সেটা বাদ দিলে একটানা বকবক করে যাই। ঘন্টা চার-পাঁচেক খাটাখাটুনির পর মাথা আর হাত দুটোই ঝিমঝিম করতে থাকে। কত যে হরেক কিসিমের সমস্যা সেসব লিখে রাখলে আরও একখানা মহাভারত হয়ে যেত। শুধু প্রথম ছ’মাসে বুকের দুধ খাওয়ানোর কথা বলতে গিয়েই কত রকমের গল্প! বাচ্চার মা বা বাড়ির লোক কারও মনে হ’ল ‘বুকের দুধ হচ্ছে না’… ব্যাস! পরের দিন থেকে প্যাকেট কেটে দুধ গোলানো শুরু হয়ে গেল। এর মাঝে কোনও ‘কী, কেন, কীভাবে’ নেই। অথচ, বাইরের দুধ শুরু করার আগে দু’শবার ভাবা উচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অকারণে বাইরের দুধ খাওয়ানো হয়। কারও কিচ্ছু বলার নেই! আবার কত রকমের দুধ খাওয়ানোর রেসিপি! ‘কীভাবে দুধ বানাচ্ছেন’ জানতে চাইলে উত্তর আসে, ‘ওই তো পাতলা করে’ বা ‘অল্প করে দিই আরকী’ এরকম। ‘কতটা জলে কতটা দুধ মেশাচ্ছেন’ জানতে চাইলে মাঝেমাঝেই দেখা যায়, নির্দিষ্ট পরিমাপ নয়, আন্দাজে দুধ মেশানো হচ্ছে। সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চা প্রত্যেকবার দুধ খাওয়ার পরেই অল্প অল্প পায়খানা করে দিতে পারে। সেগুলো আদৌ পেট খারাপের পাতলা পায়খানার দলে পড়ে না। অথচ তার জন্য ‘বুকের দুধ সহ্য হচ্ছে না’ বলে রোল্যাকের সাথে গ্লুকোডি মিশিয়ে খাওয়ানো চলছে। আরও কত রকমের ঘাঁটাঘাঁটি প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। অথচ, শুধু সামান্য স্বাস্থ্য-সচেতনতা দরকার ছিল। এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে কিন্তু খুব ধীরে। একজন মা জানালেন, “নার্সিং হোম থেকে জন্মের পরেই প্যাকেটের দুধ লিখে দিয়েছিল। আমি দিই নি। আমার বাচ্চা চনমনে আছে। বুকের দুধ টানছে। কেন বাইরের দুধ দেবো?” মাস্কে মুখ ঢাকা থাকে। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা জয়ের হাসিটা কেউ দেখতে পায় না। এক কথা ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলে যদ্দি জগদ্দল পাথরটা সামান্যও নাড়ানো যায়, সেটুকুই জিত।
“মেয়ে হয়েছে বলে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাচ্চাকে দেখতেও আসেনি। সে না আসুক। আমরাই মানুষ করবো। শরীর খারাপ হ’লে আপনি তো আছেনই। বাচ্চাটার একটা নাম দিন না ডাক্তারবাবু…” অজান্তেই চশমার কাচে বাষ্প জমে। প্রফেশনাল মুখোশের ওপারে আবেগকে বেশি জায়গা দিতে নেই। তবু প্রেসক্রিপশন লিখতে গিয়ে থমকে যাই। দুটো রোগ সারানো ছাড়া কীই বা পারি? তবু এতখানি বিশ্বাস! কী যোগ্যতা আমার? ভাবতে ভাবতেই একরাশ মনখারাপ ভিড় করে। এখনো কন্যাসন্তান উপেক্ষিতা। ‘ছেলে’ উপহার দিতে না পারাকে রীতিমতো দোষের চোখে ধরা হয়। দায় চাপানো হয় মায়ের ঘাড়ে। আজও, এখনও।
সেসবের রেশ কাটতে না কাটতেই চেম্বারে একসাথে দু’জন মা দুটো বাচ্চাকে নিয়ে একসাথে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এলেন। তাঁরা একই বাড়ির। একসাথেই দু’জন ঢুকবেন! এভাবে একসাথে দু’জনকে দেখিনা। জোরাজুরি থেকে প্রায় অনুনয় বিনয়ের পর্যায়ে পৌঁছোতে আর এই অধ্যায় প্রলম্বিত করলাম না। বাইরে এখনো জনা দশ-বারো রোগী বসে আছেন। ঘড়ির কাঁটা একটা পেরিয়েছে। তাড়াতাড়ি কলম চালাচ্ছি। এবং, খানিকক্ষণ আলাপচারিতার পর বুঝলাম প্রায় সমবয়সী দুটি বাচ্চার ‘মা’ সম্পর্কে মা-মেয়ে। ছেলে হয়নি বলে মোটামুটি পারিবারিক ফুটবল টিম বানানো চলেছে। এতদিন বাদে ছেলে হয়েছে দেখে সবার স্বস্তি। ওদিকে ততদিনে মেয়ের বিয়ে হয়ে তারও বাচ্চা হয়ে গেছে। এবার সমবয়সী মামা-ভাগ্নি একসাথে বড় হবে!
চেম্বার শেষ করে, স্নান-খাওয়া সারতে সারতে প্রায় তিনটে। আরশি আজ যেমন-খুশি-সাজো প্রতিযোগিতায় নামছে। দাদু পরামর্শ দিয়েছে সরস্বতী সাজাতে। পিয়ালী সাজাতে বসেছে। আমি কাগজ কেটে বীণা বানাচ্ছি। হাঁসের মতো দেখতে বেলুনের ওপর সাদা কাগজ চিটিয়ে সরস্বতীর বাহন বানাচ্ছি। সব দেখেশুনে আরশি উত্তেজনায় ফুটছে। প্রথম প্রতিযোগিতায় নামা বলা কথা!
সাজগোজ সেরে কীভাবে ঘন্টাদুয়েক স্থির বসে ছিল, এটাই আশ্চর্যের। কখনো মাথার পরচুলা, কখনো হাতের জরির সাজ কুটকুট করে উঠছে। আমরা পালা করে চুলকে দিচ্ছি। সাত-আটবার ধেবড়ে যাওয়া লিপস্টিক ঠিক করতে হ’ল। পা কোথায় রাখবে সেটা ঠিক করতে না পেরে যেভাবে বেলুন-হাঁসের পিঠে পা রাখছিল তাতে হাঁসটা সত্যি সত্যি প্যাঁক-প্যাঁক করে উঠলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।
অবশেষে ভালো খবর পাওয়া গেল৷ আরশি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। ছোটোবেলায় আমি প্রচুর পুরস্কার পেয়েছি। আজ মেয়ের হাত ধরে আবার নতুন করে ছোটোবেলাটাই ফিরে পেলাম যেন। আরশি খুব আনন্দ করেছে। পুরস্কার হাতে নিয়ে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরেছে।