“এই অঞ্চলটা আমার পরিচিত হয়ে গ্যাছে” উক্তিটা বাঁকুড়ার সদ্য বদলি হয়ে আসা এক মহিলা অফিসারের। সাধারণের হিসেবে যৌবন উত্তীর্ণা, অবিবাহিতা। কালো চুলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা রং মেখে’ প্রজ্ঞা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ওর নাম হয়তো বা শিলাবতী। আসল নাম জানানোর কিঞ্চিৎ অসুবিধে আছে, সেটা গোপনই থাক।
গাড়ির চালক আমাদের বৃদ্ধ ডাক্তার। বাতাসে তার দাড়ি ওড়ে।মৃদু হেসে প্রশ্ন করে “আমি যেমন পরিচিত, সেরকম?”
মাথার এলো চুল বিন্যস্ত করে শিলাবতী বলে “না না,তুমি তো শুধু মাত্র পরিচিত নও….আরো বেশী…”
মেদিনীপুর শহর ছাড়িয়ে গাড়ি সিধু কানহোর মূর্তি পেছনে ফেলে গাড়ি আপন বেগে চলতে থাকে। ক্রমশঃ চোখে জয়পুরের জঙ্গলের আভাস আসে। ধানক্ষেতের পরে পরে শাল পিয়াল, শিমূল আর শিরিষের গাছ। অন্য সময় বুড়ো গাড়ি পেগ্যাসাসের মতো উড়ে চলে। আজ বহু বছর পর এই মাঘী শালবনের রৌদ্রছায়া মেখে বুড়ো চলেছে। গরীব মানুষ যেভাবে মালাই চমচম খায়-একটু চেটে তারপর অনেকক্ষণ সেই অপূর্ব দেবভোগ্য সুখাদ্যকে দেখে’ দেখে’-তেমনি করে’ই গাড়ি চলছে ধীর গতিতে। জঙ্গলের মাঝে হঠাৎ সর্ষে হলদে সবুজ ফুলের ঝাঁক ছাড়িয়ে, পড়ন্ত বেলায় ছোট ছোট গ্রাম, খোঁচা খোঁচা দাড়ির মতো কেটে নেওয়া ধানগাছের গোড়া পাশে ফেলে’ চলেছে।
“হয়তো পরিচয়ের পর এই রুক্ষ, কঠোর উদাসী ভূমির প্রেমে পড়বে তুমি। হয়তো আবার বদলি হলে শুধু স্মৃতিতে এই অনুর্বর টিলাময় পৃথিবীর কথা মনে পড়বে..…” বুড়ো ড্যাশবোর্ড থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে’ একটা সিগারেট নেওয়ার চেষ্টা করে। গাড়ি চালানোর সময় সিগারেট ধরানো বেশ ঝামেলার কাজ। শিলাবতী প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করে শিখাহীন লাইটারে ধরিয়ে জ্বলন্ত সিগারেট বুড়োর হাতে ধরিয়ে দ্যায়। দেখে’ প্রসাধনহীনা মনে হলেও, সিগারেটের ফিল্টারে লেগে থাকা ওষ্ঠরঞ্জনীর গাঢ় বাদামি রং বলে দ্যায়-না তা আসলে নয়, রং লেগেছে কোমল ঠোঁটে। এখন রাস্তার ওপর ছায়া আর গোধূলির আলো মিশে গ্যাছে।
“অথচ আমরা এই মাটিতে জন্মেছি, এই বাতাস এই ঘন তীব্র আকাশ; গ্রীষ্মের হঠাৎ ঘূর্ণি বাতাসে পাক খাওয়া ধুলো,পাতায় যে ছেলেমানুষী খেলা আছে তা উত্তর আমেরিকার টর্নেডোর মতো ভয়াবহ নয়, তবু তারই মতো।একটা কী য্যানো আনন্দে পাতা,ধুলো সব উড়ে যেতে চায়। এর প্রেমে পড়া যায় না….”
শিলাবতী আড় চোখে তাকিয়ে বলে “কেন গো? বড্ড কঠোর, মেয়েলিপনা-হীন নির্মম বলে’?”
বুড়ো জানালার বাইরে হাত নিতেই হাওয়ার ঝাপটে সিগারেটের ছাই উড়ে যায়। গোঁফ দাড়ির জঙ্গলে একটা দুষ্টু হাসি খেলে যায়। “না”
“তবে?”
বুড়োর ডান হাতে সিগারেট। সেটা ঠোঁটে ওঠে। বাঁ হাতের গাড়ির গতি পঞ্চম মাত্রায় নিয়ে যায়। গাড়ি আরও নিঃশব্দে শালবন পেরিয়ে চলে। “তবে? এ যে আমাদের মা। এর কোলে আমাদের শৈশব, কৈশোর…..বিকেলে, গরমের ছুটিতে মাদুরে শুয়ে থাকতাম….ভেজা মাদুর…..ঘুম ভাঙাতো পাশের পাড়ার ঘাড় ফোলানো মোরগ, কার্নিশে বসে’ থাকা তিনটে শালিক; বলতো ওঠ রে বোকা বিকেল হয়ে গ্যাছে…..;প্রতিটি জায়গার ঋতু, কাল, সময়, প্রকৃতি অনুযায়ী আলাদা আলাদা রূপ, শব্দ, বর্ণ হয়। শুধু পরিচয় হলে হয় না।চোখের ফাঁক দিয়ে হৃদয়ে গেঁথে নিতে হয়”
“ঠিক বোঝা গ্যালো না” শিলাইয়ের কন্ঠস্বর বিষ্ময়মিশ্রিত।
সেদিন শুক্লা পঞ্চমীর সন্ধ্যা। ছেলে মেয়েরা কলকল করতে করতে রাস্তা ভরাট করে চলেছে। বুড়ো কনুইয়ের চাপে হর্ন বাজায়। সবাই অনিচ্ছায় রাস্তা ছেড়ে দ্যায়। পৃথিবীতে আসল রংটুকু লাগে মেয়েদের উপস্থিতিতে। হলুদ, লাল, সাদা-লালের বিচিত্র বর্ণময় এক ঝাঁক প্রজাপতির মতো মেয়েদের উপস্থিতি। ছেলেগুলো বড়ো একরঙা। সাদা কালো। মেয়েদের সবার মাথায় খোঁপা। খোঁপা ঘিরে সাদা গোঁড়েমালার মতো কাপড়ের বাঁধন।
“শিলাই দ্যাখো, সদ্য কিশোরী মেয়েরা সদ্য কিশোরী বুকগুলো আঁচলের ফাঁকে বার করে’ ঘোষণা করছে দ্যাখো গো আগামী বসন্ত, আমরাও বসন্তের ছোঁয়া পেয়েছি….তাই না?”
শিলাবতী অন্য মনে বলে “ওরা জামার ভেতরে অন্য কিছু ঢুকিয়ে রেখেছে”
তারপর তার শ্যামামুখখানি লজ্জার রংয়ে রাঙিয়ে নিশ্চুপ হয়ে’ নিজের বুকের আঁচল ঠিক করার ছল করে।
তখন আকাশ সন্ধ্যার আলোয় ভরা।কোথাও একটা ময়ূর ডাকে।
“আচ্ছা বুড়ো দুপাশের ঐ গাছগুলোর কিছু পাতা হলুদ আর কিছু পাতা অন্ধকারের মতো গাঢ় সবুজ কেন?”
হাওয়ার ঝাপটা লাগে বুড়োর মুখে-শিলাবতী নদীর ঠান্ডা জলের মতো মনে হয় য্যানো। “সুন্দরী,ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখো, ওরা এবার শীতের হাওয়ায় ডানা মেলে উড়ে যাবে। তাই ওরা গাঢ় রং ঝরিয়ে হালকা হচ্ছে। য্যামনটি শীতের দেশে মেপল পাতারা কমলা হয়ে’ যায়। তারপর….”
বুড়ো সিগারেটের প্যাকেটে বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিতে, শিলাবতী ডান হাত দিয়ে বুড়োর বাঁ হাতটা চেপে ধরে। “তারপর…?”
“তারপর? তারপর উড়ে এসে মাটির বুকে লুটিয়ে পড়বে। এটাই ঋতুর খেলা, প্রকৃতির নিয়ম।”
ঘন নীল পীচ রাস্তায় ছড়ানো ঝরা পাতা মচমচ করে ভারী চাকার তলায় পিষে যায়। হাহা করে’ হাওয়া হেসে ওঠে। ঝরা পাতারা খড়মড় করে’ বেজে ওঠে।
“এরপর কী হবে?”
“এরপর শুকনো ডালে সাদাটে সবুজ পাতারা ডাল ভরে’ তুলবে। সূর্য একটু বেশী করে’ আলো ঢালবে-আলোর স্পর্শে পাতারা হলদে সবুজ হয়ে উঠবে।”
“কিরকম অদ্ভুত দেখতে লাগছে-দ্যাখো অই রুক্ষ উঁচু নিচু ঢেউ খ্যালা মাটি, শুকিয়ে যাওয়া ঘাসবন, দূরে দূরে নিষ্পত্র গাছেরা….কয়েকটা গালফোলা বেঁটে তালগাছ…”
“ঠিক য্যানো আফ্রিকার জঙ্গল। আমি ছোটবেলায় ঐ তালগাছগুলোকে বাওয়াব গাছ বলে ভেবে নিয়ে টারজান সাজতাম…”
শিলাবতী অনেকগুলো বাসন টুংটাং করে’ ভেঙে ছড়িয়ে হাসতে থাকে
“বাওয়াব তো মস্তো বড়ো গাছ। পেটের কাছটা মোটা…”
বাল্যের গোপন স্বপ্নের কথা বলে’ বুড়ো বোধহয় লজ্জা পায়। চুপ করে’ গাড়ি চালাতে থাকে। এদিকে একটা ছোট্ট নিকোনো তকতকে গ্রাম এসে হাজির।
“শিলাবতী ঐ দ্যাখো বিচালির গাদা আর ওটা হলো ধানের মরাই”
“কোনটা আবার কি?”
“আরে যেটা মায়ের মাথার এলো খোঁপার মতো-আলুথালু সেটা খড়ের গাদা আর যেটা প্রেমিকার খোঁপা-বিনুনি দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা- ওটা ধানের মরাই”
গাড়ি তার চারপায়ে ঝরা পাতা দ্রুত পদে দলে’ একটা ফরেস্ট বাংলোতে এসে থামে।
নিজের ঘরে এসে চেয়ারে বসে’ বুড়ো একটা সিগারেট ধরায়। ঘন জঙ্গলের মাঝে একটা কাঁকড় বেছানো রাস্তা। সেটা এসে শেষ হয়েছে এই বাংলোয়। কেয়ারটেকার মুকেশ এসে চা দিয়ে গ্যালো। সন্ধ্যাবাতাসের ঠান্ডা আমেজ এসে’ পর্দা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শালবনের ফাঁকে ফাঁকে দুই খানা তারা দ্যাখা যায়। পাশের ঘরে শিলাবতী। ঘরের নাম সুবর্ণরেখা। বুড়ো নিজের ঘরের নাম জানে না। শিলাবতী বারান্দায় এসে বসলো “কৈ গো বুড়ো? চা নিয়ে বারান্দায় বসো না?”
পিরিচ পেয়ালা রেখে দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বুড়ো আকাশ পাতাল ভাবছিলো।
“জানো? এখানে হাতী আসে। যদি আজ আবার হাতীর পাল আসে, কী মজা হয়, না?”
বুড়ো মনে মনে বললো ‘মজাই বটে। জবর মজা’
এমন সময় বুকের ধুকধুকি থামিয়ে দেওয়া একটা দীর্ঘ-হাহারব শোনা গ্যালো। সেটা থামার আগেই চারপাশে অনেক অনেক সবুজ জ্বলন্ত চোখ ঝকমক করে উঠলো। প্রতিটি ঝোপঝাড় ভেদ করে’ অরণ্যের সেই আর্তনাদ মোমবাতির শিখাকে নিষ্কম্প স্থির করে রাখলো। শিলাবতী বুড়োর পাঞ্জাবির হাতা খামচে ধরে’ বললো “এগুলো কী ডাকছে?”
“এগুলো সব হাতীর ডাক” বলে বুড়ো শেয়ালদের চমকে দিয়ে অট্টহাসি হেসে উঠলো।
রাত গভীরতর হয়। শিলাবতীর কথা ঝিঁঝিঁর ডাকে ঢাকা পড়ে যায়। কাল প্যাঁচা ভুৎ ভুতুম বলে ডাকতে থাকে। বিজলিহীন রাত্রি তারায় তারায় দীপ্ত শিখার কাঁপাকাঁপা আলোয় নিবিড় হয়ে ওঠে। আগে রেডিওতে গান বাজতো।এখন এফএমের তরঙ্গ এখানে এই গহীনে পৌঁছয় না। বুড়ো বলতে থাকে
“হয়তো আমার শরীরে আদিম মানুষের রক্ত আছে। আদিম মানুষ হলো আদিবাসীরা। ওদের গান আছে, মাদল আছে, হাঁড়িয়ার নেশা আছে। জীবন ধারণের ব্যবস্থা হলেই তারা এক আদিম সুরে, ওদের দুর্বোধ্য ভাষায় গান গায়।নাচে মাদলের তালে তালে। সেই একঘেঁয়ে সুরের মাদকতা রক্তের গভীরে একবার ঢুকলো তো হয়ে গ্যালো। সারা জীবন সেই নেশায় ছুটে বেড়াতে হবে”
“তুমি সেই সুর শুনেছো বুড়ো?”
“যখন ছোটো ছিলাম, তখন বাড়ির পাশে ছিলো সাঁওতাল পাড়া। সন্ধ্যায় তারা নেশা করতো। না, বোধহয় ভুল বললাম। সেই সুর আর ছন্দের নেশা কাটাতে হাঁড়িয়া খেতো। ছেলেরা মেয়েরা কনুইয়ে কনুই ধরে’ নাচতো। হয়তো সেই রাতে সমাজ সম্পর্ক নেশার স্রোতে ভেসে যেতো।”
শিলাবতী গালে হাত দ্যায় “ওমাআ, তারপর অশান্তি হতো না?”
বুড়োর চোখে হাসি ঝিলিক দ্যায়। “নারী হলো প্রকৃতি। জল আকাশ, বাতাস, মাটি কি কারো নিজস্ব হতে পারে? এগুলো তো পৃথিবীর নিজের জিনিস।এতে কারও অধিকার নেই। আমাদের আদি পূর্বপুরুষ যে বাতাসে শ্বাস নিয়েছে, যে ঘন নীল আকাশের নিচে রমণ করেছে-আমাদের উত্তর পুরুষও য্যানো তাকেই পায়। অবিকৃত। তাই পৃথিবীর মতোই সম্পর্কের কোনও অধিকার হয় না। এদের ওপর অধিকার ফলানো হচ্ছে পৃথিবীকে ধ্বংস করা, প্রকৃতিকে ধ্বংস করা। আমি তোমাকে ভালবাসি, তুমি আমাকে। এখানে ভালবাসাটুকু অনিঃশেষ। অধিকারবোধ ভালবাসাকে ধ্বংস করে-জন্মের শোধ ধ্বংস করে’ দ্যায়।”
শিলাবতী পুরুষের আঙ্গুলগুলি আঙ্গুলে জড়ায়। দূর থেকে ডাক আসে
“মেমসাহেব, খাবার বানাঁয়ে রেখেছি”
অপূর্ব লেখা। পড়তে পড়তে ওই অরণ্যে হারিয়ে গেলাম যেন! প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার যে আকুতি রয়েছে এই লেখায় তা মনের ভিতর পর্যন্ত স্পর্শ করে যায়। লেখককে অনেক ধন্যবাদ অসাধারণ এই লেখাটির জন্য।