আর কয়েকজন মাত্র রোগী আসতে বাকি আছে – তারপর হাতুড়েবুড়ো পেশীমানব গজানন মাশ্চাকট মশায়ের বাড়ি ওনার গিন্নিকে দেখতে যাবেন। মনোজের দোকানে এক কাপ উষদুষ্ণ ক্যামেলিয়া সিনেনসিস পান করে চমৎকার চিত্তে নিজের খুপরিতে সেঁধাতে গিয়ে বুড়ো আঁৎকে উঠলেন। একজন রোগী এসে গ্যাছে। একজন হ্যাংলাপ্যাংলা মাঝবয়সী লোক টেবিল চেপে ধরে পরিত্রাহি চিৎকার করছেন “ওরে বাবারে ওরে মারে মরে গেলাম রে আমাকে বাঁচাও রে ..ওরে আমায় চেপে ধর রে”।
পাশে ওনার অপ্রস্তুত এবং থতমত বৌ কাঁচুমাচু দাঁড়িয়ে আছেন।
হাতুড়ে সটান ওনাকে চেপে ধরলেন। “ধরেছি”
তবুও হ্যাংলা ভদ্রলোকের চ্যাঁচানি চলতে থাকে। একঘেয়ে সুরে বলে যেতে থাকেন “ঘুরছে ঘুরছে মাথা ঘুরছে” তারপরেই ওয়্যাক ওয়্যাক করে বমি করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে থাকেন। ” হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ ঘর মেঝে টেবিল চেয়ার দেওয়াল সব স—–ব বনবনবনবন… ওয়্যাক ওয়্যাক”
হাতুড়ে সমনোযোগে ভদ্রলোককে দেখে বললেন ” কৈ মাথা তো স্থিরই আছে। ঘুরছে কৈ?”
ভদ্রলোক চ্যাঁচাতেই থাকেন “ঘুরছে মাথা ঘুরছে, মাথা ঘুরছে,মাথা ঘুরছে”
ওনার পুনঃপৌনিক মাথা ঘোরার মধ্যেই ওনার গোলগাল গিন্নি বলেন “খালি খালি চ্যাঁচাচ্ছে আর ওয়্যাক ওয়্যাক করছে যাকে বলে কাঠবমি”
হাতুড়ে আওড়ান “কাঠবমি বমি নয় আসলেতে পাখি সে….” তারপর সপ্রশ্ন বলেন “আপনাকে তো শুইয়ে পরীক্ষা করা যাবে না তাই না? শোওয়ালেই হাহাকার করতে থাকবেন…”
ভদ্রলোক সায় দ্যান “হ্যাঁ খুব চ্যাঁচাবো… আসলে শুলে ভয়ংকর মাথা ঘোরে ওয়্যাক ওয়্যাক….”
তারপর হাতুড়ে বলেন “ও মশয় -ছোটবেলায় কোনোদিন বনবনবনবন করে ঘুরেছিলেন?”
ভদ্রলোক উচ্চৈঃস্বরে বলেন “হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ”
হাতুড়ে মুচকি হাসেন “ঘোরার পরে দাঁড়িয়ে পড়লে কি হয়?”
এবার গোলগাল গিন্নি বললেন “বাঁই বাঁই করে মাথা ঘোরে”
ভদ্রলোক সংশোধনী পেশ করেন “বনবন করে”
“কিন্তু ক্যানো?”
“সেকি ক্যানো? জানিনা তো…” দুজনের তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া।
হাতুড়ে মধুর মধুর হাসি হাসেন “ধরে নেওয়া যাক আপনার কানের এ্যাকদম ভিতরবাগে একটা হাড্ডি দিয়ে তৈরি বল আছে…”
“আছে …..তাতে মাথা ঘোরার কি?”
“ধরা যাক সেই বলের মধ্যে জলবৎ একটা তরল পদার্থ আছে”
খ্যাংড়াকাঠি ভদ্রলোক ব্যাঁকা হাসি হেসে বলেন “ধরলাম”
“আপনি যখন ঘোরেন তখন ঐ হাড্ডি দিয়ে তৈরি বল আর ওর ভেতরের জল দুটোই ঘোরে আর থামার পরে ….” হাতুড়ে বাংলা আটশো তেত্রিশ পর্বে চলা সিরিয়ালের মতো সাসপেন্স রাখেন।
গোলগাল গিন্নি বলেন “থামার পরে?”
“হাড্ডি থেমে যায় কিন্তু জল যতক্ষণ ঘুরতে থাকে ততক্ষণ মাথা ঘুরতে থাকে”
রোগী বলে “বনবনবনবন” তারপর হুঁশ আসে “কিন্তু এখন তো আমি ঘুরিনি কিন্তু মাথা ঘুরছে ক্যানো?”
হাতুড়ে সিগারেট বের করে কেদার খানের স্টাইলে টেবিলে ঠুকতে থাকেন কিন্তু ধরান না “এখন ঐ ঘোরাঘুরির খবর নিয়ে যাওয়ার নার্ভগুলো সব শর্ট সার্কিট হয়ে গ্যাছে। ওষুধ খেলে কমবে কিন্তু ইএনটি দেখিয়ে বাকি চিকিৎসা করতে হবে। তবে সেরে যাওয়ার চান্স কম, মাঝে মাঝেই হবে।”
“আর বমি?”
“ঐ বলটার পাশেই আছে ভমিটিং সেন্টার আর সুপিরিয়র স্যালাইভারি নিউক্লিয়াস ফলে বমিও হয় মুখে আর পাকস্থলীর ভেতরে রসও বেরোয়, সেটাই বমিতে ওঠে আর বাঙালি বলে বুকের কফ ওঠে…” হাতুড়ে গীগী করে হাসেন তারপর খসখস করে হিজিবিজি কিছু লিখে দিলেন- যাই লিখুক একটা ওষুধতো বটে। হাতুড়ে ঘোষণা করলেন ” এটা বিনাইন পজিশনাল পারক্সিস্মাল ভার্টিগো আপনি ইএনটি দ্যাখান । ”
এরপর যে এলো তার সঙ্গিনীর কপালে বেগনে রংয়ের মস্ত একটা টিপ যাকে টিপকপালী বল। সঙ্গে একজন মধ্যবয়স্কপুং। “হাতুড়েদা ও হাতুড়েদা গত সাতদিন আগে মাঝরাতে আমার বরের মাথা ঘুরে গ্যাছে”
হাতুড়ে চমৎকার হয়ে গেলেন “কাকে দেখে?”
“না না এমনি এমনি, মাঝরাতে টয়লেট করতে গিয়ে…”
“ঘুম থেকে উঠে?”
লাজুক ভদ্রলোক নতমুখে বসে রৈলেন। মহিলা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন “না তো কী? ফুটবল খেলছিলো?”
হাতুড়ে কিঞ্চিৎ থতভম্ভ হলেন।
“জানেন? সব রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে……”
মুখফোঁড় হাতুড়ে বললেন “কিন্তু সবই নর্ম্যাল তাই তো?”
মহিলা কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ কাঁচুমুখ হয়ে বললেন “হাঁ হাঁ কিন্তু আপনি কি করে….?”
হাতুড়ে একটুখানি তুম্বো ন্যান “জানতে হয় নৈলে পিছিয়ে পড়তে হয়”
“তাইলে কী?”
“মিকচুরেশন সীনকোপ”
“এ্যাঁ? সেটা কিগো?”
“এটা একটা ভেসোভেগাল সীনকোপ….”
ভদ্রমহিলার চোখ গোলগোল হয়ে যায় “ভেসোভ্যা…..” ভদ্রমহিলা ভেবলিয়ে যান
“অনেকক্ষণ পটিতে বসে থাকলে বা কুটনো কুটে উঠে দাঁড়ালে মাঝে মাঝে অল্প কিছুক্ষণের জন্য চোখ অন্ধকার হয়ে যায় না?”
ভদ্রলোক বলেন “হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ আমার পায়খানা করে উঠলে হয় কিন্তু ক্যানো হয়?”
“সহজ ভাষায় বলি ক্যামন? হার্ট ছাড়াও আমাদের শরীরের মাসলগুলো রক্ত চলাচলে সাহায্য করে তাই অপারেশন করার সময় অজ্ঞান করলে সব মাংসপেশী ঢিলে হয়ে যায় তখন প্রেসার খুব কমে যায়। এখানে প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভও কিছুটা দায়ী। নার্ভ খুব জটিল- এটা ….জটিল বিষয়টা এখন বাদ থাক। তারমধ্যে ক্যাফ মাসলকে পেরিফেরাল হার্ট বলা হয়। অনেকক্ষণ শুয়ে থাকলে বা বিশ্রামে থাকলে অথবা যদি কারও শরীর দুর্বল থাকে বা অনেক ক্ষণ না খেয়ে থাকে … ইত্যাদি ইত্যাদি এই মাসলগুলো ঠিক ঠাক কাজ করে না। তখন যেহেতু প্রেসার কমে রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হয় তাই ব্রেনে অক্সিজেন কমে যায় ফলে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। এর চিকিৎসা হচ্ছে ব্যায়াম করা আর টিপটো মানে ব্যালেরিনাদের মতো পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে হাঁটা।” এ্যাতো কিছু বলে হাতুড়ে হাঁফসিয়ে যান। ঢকঢক করে সরাসরি এক বোতল পান করেন।
“আর হ্যাঁ এটা কিন্তু মাথা ঘোরা নয় এটাকে ব্ল্যাক আউট বলে”
আর মধ্যবয়স্ক পুং “ব্যালেরিনা ব্যালেরিনা” বলতে বলতে আর মিচিক মিচিক হাসতে হাসতে বেরিয়ে যান।
এরপর দুজন গাঁগঞ্জের মানুষ এলেন। “আইগ্গা আমরা বাঁকুড়ার থেকে এল্যম বট্যে”
“বাঁকুড়ার কোথায়?”
“আইগ্গা গঙ্গাজলহাটি”
“আমার দেশ বিল্যাতোড় (বেলিয়াতোড়)”
“হ্য দুগ্গাপুর যেত্যা মাজামাজি পড়ে বট্যে” দেশের লোক পেয়ে হাতুড়ে দৃশ্যতই খুশি।
“আইগ্গা হাঁটতে গেলেই মাথাটো ঘুরাইছে – চোখে আঁধার দেখছে…”
“কতো দিন ধরে?”
“সে বহুৎ দিন হইয়্যাঁছে গ্য”
হাতুড়ে বিজ্ঞজনোচিত মন্তব্য করেন “পেস মেকার লাগবে। কৈ কি কি রিপোর্ট হয়েছে… রিপোর্ট দেখি ….”
লোকটা অতি বিনীতভাবে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে সব রিপোর্ট বার করে দ্যায়। “ইকো নর্ম্যাল – ইসিজি নর্ম্যাল – সিটি স্ক্যান নর্ম্যাল …… হল্টার হয়নি? হল্টার মনিটরিং?”
লোকটা বলে “ও হ্যাঁ ভিতর বাগে আছে বটে দাড়াও দিচ্ছি”
হাতুড়ে একটা একটা করে পাতা উল্টোয় -সব নর্ম্যাল। এবার সদা হাসিহাসি হাতুড়ের মুখ লোডশেডিংয়ের মতো অন্ধকার হয়ে যায়। তার মানে পেসমেকার লাগবে না! লোকটাকে টেবিলে শুইয়ে উল্টেপাল্টে ঠুকেঠুকে দেখে হতাশ হয়ে চেয়ারে ধপাস হলেন। কিছুই পাননি। হিস্টেরিয়া?
কিন্তু একবার পড়ে লোকটার কপাল ফেটেছে দাঁত পড়েছে …. হিস্টেরিয়ায় তো এসব হয় না! হাতুড়ে ভাবার জন্য পিসিমাকে ডাক দ্যান (উনি কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ওনার সুন্দরী রিসেপশনিস্টকে পিসিমা বলেন- এরমধ্যে রাজনীতি খুঁজবেন না প্লিজ)
“পিসিমা একটা ক্যামেলিয়া সিনেনসিস নিয়ে আয় তো….একটু বুদ্ধি খ্যালাই”
ক্যামেলিয়া সিনেনসিস শেষ করে টাক ফাক চুলকিয়ে বললেন “ক্যারোটিড ডপলার করুন – সম্ভবতঃ কমন ক্যারোটিডে ময়লা জমে বন্ধ হয়ে গেছে…” ওরা পাশের ক্লিনিক থেকে ডপলার করে আনতে আনতে হাতুড়ে ওনার পরম বন্ধু হাবুদার সঙ্গে একটু তাম্রকূট সেবন করে দুঃখ সুখের গল্পও করে ফেললেন। রিপোর্ট দেখে হাতুড়ে খুশ। দুটো ক্যারোটিডই প্রায় বন্ধ। ক্যারোটিড আর্টারি মাথায় রক্ত নিয়ে যায়… তাই হাঁটতে গেলেই ব্রেনে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে আর লোকটা অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। উনি রোগীকে এনআরএসে ওনার এক অগ্রজপ্রতীমের কাছে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হন।
এবার হাতুড়ে চললেন পেশীমানব গজানন মাশ্চাকটের বাড়ি। পেশীমানবের বাড়ি একটা মস্ত পুকুর পাড়ে। দিব্য স্কুটার ঘটঘটিয়ে চলছিলেন হঠাৎ একটা হুঙ্কার শুনে দাঁড়ালেন “এই যে খুড়ো স্কুটার পাশের পাড়ায় রেখে আসুন”
উনি নামতেই কয়েকজন পক্ককেশ লম্বোদর তরুণ তরুণী এসে একটা পোস্টার দেখালো। লেখা আছে বহিরাগত গাড়ি রাখা নিষিদ্ধ। হাতুড়ে থমথম করে ভাবতে লাগলেন “তাহলে কি এনআরসি চালু হয়ে গেছে? তাহলে কি …” ভাবতে ভাবতে ওনার মাথাও তাজ্ঝিম মাজ্ঝিম করে ঘূর্ণায়মান হলো চোখে অন্ধকার দেখলেন এবং অবশেষে পতন ও মূর্ছা। শুনতে পেলেন কেউ বলছে “বুড়োটাকে হাসপাতালে নিয়ে চ”
আরেকজন বললো “তারপর কিচু হলে বুড়োর মুকে আগুন দেবে কে? এ্যাঁ? বলি আগুন কে দেবে মুখে?”
প্রথম জন বললো “তাইলে….?”
দ্বিতীয়জন “চ্চ এটাকে পুকুরে ফেলে দি”
হাতুড়ের বাকি জ্ঞানটুকুও চলে গ্যালো। সবাই মিলে চ্যাংদোলা করে হাতুড়েকে জলাঞ্জলি দিতে চললো।
ইতি ঘূর্ণনাদ্য খৎম।
হা হা! অসামান্য
আমি আপ্লুত
দারুন।
ধন্যবাদ
দারুন দারুন
আমি ভীষণ খুব
খুশি ।