রাত্রি গভীর হলে হাসপাতালও স্তব্ধ হয়ে আসে|ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশ্রাম নেয় পরিজন| পলিব্যাগের বালিশ বানিয়ে অপেক্ষায় কাটিয়ে দেয় নির্ঘুম|কেউ কেউ কোয়াটারের দিকে উদাসী চাঁদের পানে চেয়ে গুনগুন করে, বিড়ি ধরায়|হুটহাট গেটম্যান চিৎকার করে|আইসিইউ পাঁচের বাড়ির লোক|….আইসিইউ পাঁচের বাড়ির লোক|….
আধোঘুম মানুষগুলির কেউ একটা ধড়ফড়িয়ে ওঠে|ত্রস্ত উঠে যায়|আশংকায়|ঘোলাটে আলোয় পাশ ফিরে শুয়ে থাকে বাকিরা|কেউ কেউ ফিসফাস করে|বুড়াডা সন্ধ্যার থিকাই খারাপ|ফাঁকা হওয়া আইসিইউ বেডের দখল নিতে ছটফট করে ওঠে কয়েকজন|কাঙ্খিত ওই দুর্মূল্য একটা বেড হয়তো দিতে পারে জেনারেল ওয়ার্ডে ধুঁকতে থাকা কোনও জীবন|
এরকম অনেক হাসপাতালে রাত কেটেছে আমার|ডাক্তার হিসেবে তো বটেই|হ্যাঁ|রুগীর আত্মীয় হিসেবেও|দেখেছি পরিজনদের ধুলোমাখা অপেক্ষা|পলিথিনের বিছানা পেতে শুয়ে থাকা লোকগুলোর বাড়ি অনেক দূরে|দিনের পর দিন তারা শুয়ে থাকে খোলা আকাশের নীচে|অপেক্ষা করে|একজন ফিরে গেলে বাড়ি থেকে আরেকজন আসে|আসতেই থাকে|পালা করে|যদি রাতে দরকার হয় কিছু|যদি ওষুধ লাগে কোনও|কুয়াশার শীতে তাঁরা আগুন জ্বালে ছোট করে|তাপ পোহায়|নিজেদের গল্পগুলি,উপেক্ষাগুলি একটু একটু ভাগ করে নেয়|গরমের রাত জুড়ে পায়চারী করে|বর্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে পোটলা পুটলি সহ|ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অপেক্ষা আচ্ছাদনে|রাত বাড়ে|জল ঝড় উপেক্ষা করে কেউ কেউ ছুটে যায় ডাক এলে|কেউ কেউ স্লিপ হাতে ওষুধ নিয়ে আসে|ভিজতে ভিজতে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আসে কুকুর|কেউ একটা তাড়া দেয়|ছপ ছপ জল|টাপুর টুপুর বৃষ্টির শব্দ তীক্ষ্ণতায় চিরে দিয়ে কেউ কাঁদে|প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রনায় গুমরে গুমরে ওঠে কারো কারো বোবা কান্নারা|আমি এসব দেখি|হাসপাতালের ওয়েটিং রুমগুলি আমার অদ্ভুত লাগে|বড় অদ্ভুত|
এইরকম এক বৃষ্টির রাতে তাকে দেখেছিলাম সি এন এম সির সার্জারি বিল্ডিং-এর সামনের ছাউনিতে|একটা পোটলার মত কিছু কোলে বসে থাকতো সে|বয়েস বড়জোর সাতাশ আঠাশ|কিংবা কিছুটা কম|অভাবের থাবা বয়েস বাড়িয়ে দেয়|এমনিতে মামুলি একটা দৃশ্য|অথচ গেটের পাশের চায়ের দোকানে রাতদুপুরে গলা ভেজানোয় আমাদের যাতায়াতের পথে প্রতিদিন বসে থাকা একজন অপেক্ষা মানুষ, একই ভাবে, একই ভঙ্গিমায়, একই অসহায়তায়, স্থাণুবৎ, হয়তো কিছুটা বেমানান ছিল|তাই মনে থেকে গিয়েছিল|খুব ছোট অথচ স্পষ্ট অক্ষরে|তার সাথে, হ্যাঁ তারই সাথে দেখা হয়েছিল আবারও দিন সাতেক পর|আমি তখন হাউসস্টাফ হিসেবে পেডিয়াট্রিক্স-এ ডিউটিতে|সেই অল্প বয়েসী আলুথালু মা|কোলের পোটলা থেকে বের করে আনা একটা নমাসের পাঁচ কেজির বাচ্চা দেখিয়ে বলেছিল : জ্বর|দেখে দিন না, বাবু|
আরে তুমিই ওখানে রোজ রোজ বসে থাকো না!সার্জারির সামনে! রাত্রি বেলা|
তখনি গল্প জানা যায়| বাড়ি তার কাকদ্বীপের কাছের কোনও গ্রামে|জটিল হাঁটুর রোগে মাস হয়ে গেল অর্থপেডিক্স-এ ভর্তি তার স্বামী| প্রথম প্রথম পাড়া প্রতিবেশী,আত্মীয়রা এসেছে| সময় বাড়তে থাকলে কমতে কমতে শেষ হয়েছে সেসব|নয় মাসের বাচ্চাকে নিয়ে সেই এখন পরে আছে হাসপাতালে| একাই|দিনের বেলা টুকটাক কাজ থাকে|ওষুধ আনতে হয়| দুবেলা দেখে আসে|বাকি সময় অপেক্ষা|হ্যাঁ| নয়মাসের শিশু নিয়ে অপেক্ষা|অচেনা শহরে|একাকী|আজ বাচ্চাটার জ্বর| তাই সে এসেছে|
তৎক্ষণাৎ ভর্তি করেছিলাম বাচ্চাটাকে|হয়তো দরকার ছিল না|ওষুধেই হয়ে যেত|কিন্তু একাকী শহরে মাথার উপর একটা ছাদ আর দুবেলা নিশ্চিন্ত খাবার একজন মা, একটা ন’মাসের শিশুর জন্য তার দরকারটাও কম কিছু নয়|
গল্পটা শুনে পরদিন রাউন্ডে মহাপাত্র স্যার হেসেছিলেন|মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি|একটা মেঝের বিছানায় বেশ কিছুদিন সে ছিল|
রাত গভীর হলে হাসপাতাল স্তব্ধ হয়ে আসে|চলমান ড্রিপ, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর এসবের বাইরেও কেমন একটা সারাদিনের কলরব মুখরতা, মুছে টুছে ফেলে শান্ত হয়ে কিছুটা ঝিমোয় হাসপাতাল|ব্যস্ততা কি থাকে না? থাকেই তো|ইমার্জেন্সির সামনেটায় এম্বুলেন্সের ব্যস্ততা থাকে, ইমার্জেন্সি ওটির বাইরে ভেতরে উদ্বেগের ওঠাপরা থাকে, টান ওঠা রুগীর সিপিআর-এর ঘামে ভেজা প্রচেষ্টাগুলি থাকে|তবুও এসবের বাইরেও ওয়েটিং রুমের সিমেন্টের বেঞ্চে অপেক্ষায় ক্লান্ত কেউ চুপ করে বসে থাকে|কেউ গল্প করে, কেউবা লিখে রাখে প্রিয় কোনও নাম দেওয়ালে দেওয়ালে|
এসব লেখা আমি পড়ি|গল্প খুঁজে পাই, ঠিক যেভাবে ক্লাস নাইনের বাথরুমের দেওয়ালে লেখা থাকতো মণিকর্ণিকা প্লাস অনিমেষ, সেভাবেই অসমাপ্ত গল্পের মত কেউ একটা লিখে রেখে গেছে …লাভ ইউ মা …খরখরে দেওয়াল প্লাস্টারে ইটের টুকরোয় লেখা|হয়তো সে অপেক্ষায় ছিল|এখানেই|হয়তো তার মা তখন আইসিইউ-এর ভেন্টিলেটর-এ|জীবনের শেষ কিছুক্ষণ কাটাচ্ছে|যান্ত্রিক বেঁচে থাকার ধোঁয়া ধোঁয়া জীবনটুকু নিয়ে সন্ততির স্বপ্ন দেখছে মস্তিষ্কের ঘোলাটে কর্টেক্সে|আর তার সন্তান সারাজীবনের টুকুরমুকুর স্মৃতি একটু একটু ঘাটতে ঘাটতে অপেক্ষায়, আশায় লিখে রাখছে অগোছালো ভাবে|বহু ব্যবহৃত, অথচ স্পষ্ট ..লাভ ইউ মা|
হাসপাতালের এসব অপেক্ষমান পরিজনদের সাথে অনেকসময় ধরে গল্প করতাম আমি|এম্নি এম্নি গল্প|কত রকম মানুষ|নিজেদের শেষটুকু শেষ করে নিঃস্ব হয়ে যায় কেউ .., প্রিয়জনের ভালো হবার আশায়|কেউ হয়|কেউ হয়না|কারো কারো সাদা কাপড়ে মোড়া শরীরের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে পরিজন|রুদ্ধবাক|দিশাহীন|কেউ কেউ ভালো হয়ে ফিরে যাবার আগে, আমাদের বিদায় জানায়|চকচকে উজ্জ্বল স্বপ্নালু পরিজন পরিবৃত হয়ে|আবার নিজস্ব পৃথিবীতে ফিরে যাবার নিদারুন লোভে|তার পৃথিবী|তার বিছানা|বারান্দার টব|উঠোনের জবা গাছ|প্রতিবেশীর কেমন আছেন ..এইসব এইসব কুটুর মুটুর সাংসারিক শব্দগন্ধে জড়িয়ে মরিয়ে যেতে|
আমি এইসব ভালোবাসা, এইসব তুলোট খুচরো বেচেঁ থাকা গুলি চাখতে ভালোবাসি।
ইচ্ছে করে দৌড়ে চলে যাই অজানা হাসপাতালের সমস্ত ওয়েটিং রুমে|ঐসব অপেক্ষার সাথে, ঐসব নিদ্রাহীন বসে থাকার পাশে,..বসি|গল্প করি|যা ইচ্ছে|ঐসব দেওয়াল অক্ষরের পাশে লিখে দিয়ে আসি …
মা ভালো আছে রে|এই তো আর দুদিন পরেই ছুটি, ইউরিনের রিপোর্ট টা আসুক …আর দুদিন পরেই …
মন ছুঁয়ে যাওয়া ‘কবিতা’। অসাধারণ লেখা। ধূসর পাণ্ডুলিপি দেখতে পেলাম। হয়তো প্রত্যেকের প্রত্যক্ষ অনুভূতি ছড়িয়ে রয়েছে লেখা জুড়ে।
খুব ভালো লাগলো। আমাদের অভিজ্ঞতাটা কম-বেশী সবার সমান অন্তত যারা নিজেরা পরিজনদের কে নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি হসপিটাল বা নার্সিংহোমে কাটিয়েছেন। কিন্তু আমাদের অনুভূতি, মানসিক অবস্থা, আর্থ সামাজিকতা কি ভাবে একজন ডাক্তারের চোখেও ধরা পড়ে, তাদেরও অনুভূতির প্রকাশ পায়, সেটা এই লেখাটার মধ্যে খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। ধন্যবাদ ডক্টর বাবু।
অসাধারন। লেখাটা এতটা ই প্র আঞ্জল হাসপাতালে রাত কাটানো মানুষগুলোর জীবন আলেখ্য স্পষ্ট অনুভব করা যায়। যার হাসপাতালের সামান্য অভিঞ্গতা আছে তার কাছে অডিও ভিসুয়াল মনে হবে। ডাক্ত আর বাবু একজন অসম্ভব ভালো মনের স ঙবেদনশীল মানুষ হিসাবে প্রতিভাত হন। প্রনাম নেবেন।
(বানান ভুল ,—— সৌজন্য কি বোড্।।।)
আগেই পড়েছি। এই নিয়ে তিনবার পড়লাম। অত্যন্ত শক্তিশালী লেখা। যেন আমাদেরই কাহিনী! এরকম লিখতে পারলে গর্বিত হতাম।
প্রত্যেকটা লেখা চেটে পুটে খাই।
Dr. Soumendu Nag আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ এই অসাধারন লেখাটির জন্যে।
একজন Medical Professional হিসাবে এই সমস্ত কিছুর অভিজ্ঞতা আমার আছে, কিন্তু আপনার লেখাটি পরতে পরতে মনে হল, আমি যেন ঠিক হাসপাতালের waiting area কেই বসে আছি।
অত্যন্ত শক্তিশালী লেখা। আরো কিছু পাওয়ার আশায় রইলাম