বামপন্থী হলেও অতিবামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে আমার বিস্তর দূরত্ব, যদিও তাঁদের মধ্যেও আমার বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব রয়েছেন, পরিচিতজন তো অনেক। নির্বাচন আসামাত্র তাঁদের ‘লেসার এভিল’ তত্ব ভাসিয়ে তোলাটা আমার চোখে প্রবল বিরক্তিকর, সেই সুবাদে কিছু বন্ধুর সঙ্গে দূরত্বও বেড়েছে – তদুপরি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নামে উত্তরাধুনিক ভাবনার চোঁয়া ঢেঁকুর হিসেবে এঁদের কেউ কেউ একধরনের ‘রিলেটিভিজম’-এ বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন, অর্থাৎ যেকোনও বিষয়েই যেকোনও মত-কেই এঁদের কেউ কেউ গ্রাহ্য মত হিসেবে ভাবতে ভালোবাসেন, যার মধ্যে দিয়ে অবিজ্ঞান ও ছদ্মবিজ্ঞান প্রশ্রয় পায়, এ-ও বিরক্তির কম কারণ নয়। তবু এঁরা যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দাবিদাওয়ার কথা যেমন নির্ভীকভাবে সামনে আনতে পারেন, কোনও হিসেবনিকেশের প্রশ্ন মাথায় না রেখেই অকুতোভয় হয়ে প্রতিবাদে সামিল হতে পারেন – তা সত্যিই গভীর শ্রদ্ধা জাগায়।
তবে আজ যে বিষয় নিয়ে নিজের প্রতিবাদটুকু সোশ্যাল মিডিয়ায় লিপিবদ্ধ করতে চাইছি, সেখানে এসব কথা একেবারেই ধান ভানতে শিবের গীত টাইপের অবান্তর।
কেননা, বইপড়া আমাদের শিক্ষাকে ক্রমশ ঋদ্ধ করবে, নতুন নতুন ভাবনায় জারিত করবে, মনের গভীরে নতুন নতুন প্রশ্ন জাগিয়ে তুলবে, না-বুঝতে-পারা বিষয়কে বুঝতে উদ্বুদ্ধ করবে – যা কিনা আমাদের উত্তরোত্তর আরও বেশি করে বইয়ের দিকে নিয়ে যাবে – শুনেছি, এমনটাই নাকি হওয়ার কথা।
যেকারণে শাসকরা নাগরিকের বই পড়া নিয়ে চিরকালই চিন্তিত। সম্ভবত একটু মোটাদাগের কাজকর্মে বিশ্বাস করতেন বলেই, হিটলার বই পুড়িয়েছিলেন – নইলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণের চমৎকার ব্যবস্থা আছে। যেখানে ঠিক কী ধরনের বই পড়লে মানুষ ফালতু ঝামেলায় জড়াতে চাইবে না – বা, জড়াতে চাইলেও শাসকের হয়েই কাজটা করবে – কী বই পড়লে বই পড়াটাকে স্রেফ বিনোদন হিসেবে ভাবার অভ্যেস তৈরি হতে পারে – বা কী ধরনের বই পড়লে বেশ কিছু অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়ামি মনের মধ্যে গেঁড়ে বসে – এবং স্রেফ এসব ধরনের বইয়ে বাজার ছেয়ে ফেলা গেলেই দু-চারটে বিপরীত মতের বইকেও ছাড়পত্র দিলে সরকারের চাপের কিছু নেই, কেননা কয়েক লক্ষ বইয়ের ভিড়ে চার-পাঁচখানা সেরকম বই কারও নজরে পড়বে, এমন সম্ভাবনা একেবারেই নেই – সুতরাং, বিপরীত মতের বইয়ের ‘বিপদ’ সামলে ওঠার হাজারো পদ্ধতি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছেই রয়েছে, খামোখা বই পুড়িয়ে লোককে ইয়ে করার মানে হয় না। বইমেলা বা বইয়ের দোকানের অধিকাংশ বইয়ের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
তো বাকি মূলধারার প্রকাশনা ও বইপত্রের কথা বাদই দিন, এভাবেই তথাকথিত ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কেন্দ্র’ হিসেবে পরিচিত লিটল ম্যাগাজিন সমূহ বিপজ্জনক বিষয়াদি পরিত্যাগপূর্বক ‘সারস্বত চর্চা’-য় ব্রতী হয়ে উঠেছেন। সেই সারস্বত চর্চার বিনিময়-মূল্য প্রায়শই অত্যন্ত চড়া – সে নিয়ে কথা উঠলেই আইনক্সে সিনেমার টিকিটের দাম বা শপিংমলে পিজা-র দামের উদাহরণ শোনা যায় – অর্থাৎ লিটল ম্যাগাজিনের টার্গেট রিডার, ইদানীং, নিয়মিত শপিংমল মাল্টিপ্লেক্সগামী উচ্চমধ্যবিত্ত-ই – ভাবলেই রোমাঞ্চ হয়, তাই না? এমতাবস্থায় স্থানীয় সামাজিক বিষয় নিয়ে সংখ্যা যদিবা প্রকাশ পায়, সে-ও সময়ের নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত – অর্থাৎ নিদেনপক্ষে বছর-পনেরর পুরনো বিষয় নিয়ে আলোচনা, যাতে বর্তমান সরকার খামোখা চটে না যান – অথবা নিরাপদ ভৌগোলিক দূরত্বে ন্যস্ত, ধরুন গুজরাট বা ইউপি-র সমাজরাজনীতি বিষয়ে সুগভীর আলোচনা ইত্যাদি।
এমতাবস্থায় ফুটপাতের বাচ্চারা, যারা কিনা নিজেরাই আবাসচ্যুত, যাদের কিনা নিজেদেরই মাথার ‘পরে ছাদ নেই – আমাদের মতো আরামপ্রদ সামাজিক অবস্থানের মানুষের তুলনায় যারা কিনা প্যালেস্তাইনের বাচ্চাদের কষ্টটা অনেক নিবিড়ভাবে অনুভব করতে সক্ষম, কেননা ওদেশে যদি বোমা এসে বাড়িটি নিশ্চিহ্ন করে দেয় তো এই গণতন্ত্রের দেশে সে কাজ করার জন্য রয়েছে ‘উন্নয়ন’ – তারা যখন নিজেদের ভাবনা নিয়ে ছবি আঁকে, বই ছাপিয়ে বিক্রি করে, তখন ব্যাপারটা অনেকের পক্ষেই খুব অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।
এই যেমন, পরশুদিন, বইমেলায় ইসকন-এর অসুবিধে হচ্ছিল। অসুবিধে হচ্ছিল আশেপাশের আরও দু-একটি স্টলেও।
ঠিক যেমন দিনকয়েক আগেই, অনুরূপ অসুবিধের কারণেই, মনফকিরা-র স্টলে ভাঙচুর চালিয়ে যায় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের বেশ কিছু সদস্য।
পুলিশ, চিরকালই, মানুষের অসুবিধে দূর করতে ব্রতী। মনফকিরা-র স্টলে ভাঙচুর নিয়ে তাঁরা পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি, কেননা সেক্ষেত্রে অসুবিধে হয়েছিল সুকুমারমতি হিন্দুত্ববাদীদের – সেক্ষেত্রে পুলিশ যে মনফকিরা-র লোকজনকেই গ্রেফতার করেননি, এ তাঁদের পরম সৌভাগ্য। কিন্তু ইসকন ও তার কাছাকাছি স্টলের মানুষের অসুবিধে তো পুলিশ সহ্য করতে পারেন না! সুতরাং কাগজ পেতে বই-ছবি নিয়ে বসা বাচ্চাদের সত্ত্বর তুলে দেওয়া হয় – তাদের সঙ্গে থাকা বড়দের গিল্ড আপিসে আটকে রাখা হয়। এই সময়েই – ইংরেজিতে যাকে inopportune moment বলা যেতে পারে – অতিবামপন্থী সংগঠনের কিছু মানুষ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির মতো বিপজ্জনক দাবি নিয়ে মিছিল করছিলেন। সম্ভবত গতিজাড্যের কারণেই পুলিশ তাঁদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, লাঠি ইত্যাদির সঙ্গে একজনকে কামড়েও দেয়, মহিলা পুলিশ অকুলান ছিল বলে পুরুষ পুলিশই মেয়েদের গায়ে হাতটাত দেয়, পরিশেষে গ্রেফতার করে। বাকিরা ছাড়া পেলেও দুজন এখনও পুলিশ হেফাজতে।
এমতাবস্থায় সংখ্যাগুরু সংস্কৃতিমনস্ক বইপ্রেমী যে এমন ঘটনাক্রমে বিচলিত হবেন না, সে নিয়ে বিস্মিত হওয়ার মানে হয় না। ফুডকোর্টে ধাক্কাধাক্কি ভিড়ের মধ্যেও যে এসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে ন্যূনতম চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে না, সেও প্রত্যাশিত।
এমনকি, ঘটনাটি ঘটছিল যে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের খুব কাছেই, লিটল ম্যাগাজিনের অভিমুখ-বদলের এই নতুন সময়ে যে সেখান থেকেও বিশেষ কেউ উঠে এসে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করবেন না, তা নিয়েও কি হতবাক হওয়ার কিছু যুক্তি আছে?
তো কথাটা হলো, একদিকে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের তরফে মেলার স্টলে ভাঙচুর, আরেকদিকে রাজ্য পুলিশের তরফে এই – দুশ্চিন্তার কিছু নেই, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দেড়শতম বইটি আগামী বইমেলায় এসে যাবে – আদতে যখন মেনেই নিয়েছেন, যে, দুপক্ষই এভিল, তখন লেসার আর গ্রেটার হিসেব করে লাভ কিছু আছে কি? বড় বিপদকে আটকানোর জন্য আপাতত ক্ষমতাশালী ছোট বিপদের পাশে থাকার যুক্তি খুবই ভালো – কিন্তু তথাকথিত ক্ষমতাশালী ‘ছোট বিপদ’-এর ক্ষমতা যে কখন কোনদিকে ধাবিত হবে…
ভয়ের ব্যাপার হলো, আজকাল কেউই যেন কোনও কিছু নিয়ে বিচলিত হয় না। ছোট বা বড়, সব ব্যাপারেই, কেমন একটা মেনে নেওয়ার প্রবণতা। মানিয়ে নেওয়ার অভ্যেস। এই রাজ্যে এত বড় বড় অনাচারের ঘটনা ঘটেছে, যে, সেখানে একটি মেলার একদিনের ঘটনা নিয়ে এত কথা লেখার মানে-ই হয় না।
তবু বইমেলা তো, শুনেছি, সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির বড় গর্বের ব্যাপার। অন্য প্রদেশের থেকে বিভিন্ন দিকে পিছিয়ে গেলেও এই একটি ব্যাপার – আমাদের ‘কালচার’-প্রেম – এখনও অনেক বাঙালির শ্লাঘার বিষয়। সেখানেও যখন জুতোর বাড়ি খেলেন, তখনও কিছু বলবেন না!!!