মানুষ যে কত ভাবে নিজেকে মনে রাখাতে চায় সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। মনে রাখানোটা যে খুব জরুরি তা কিন্তু নয়। এমনিতেই অধিকাংশ মানুষই বুদ্ধিজীবী নয়, বড়জোর বুদ্ধিকেবি হতে পারে আমার মতো।
কিছুই মনে থাকে না তাদের। অন্য লোকের সুনাম বা কেচ্ছা দূরের কথা নিজের বাপের নামও সাত চক্রে পড়ে যে ইতিমধ্যেই খগেন হয়ে গেছে আর সংসার তাকে বাপের আসল নাম ভুলিয়েও দিচ্ছে তাইই সে খেয়াল করতে পারে না।
কিন্তু ওই যে, মনে মনে লোভ। লোকে যেন মনে রাখে। শুধু কি রবি ঠাকুর? মাইকেল ইস্তক এই ব্যাপারে ইয়ে করে গেছেন। সেই যে গো,
“সেই ধন্য নরকুলে,
লোকে যারে নাহি ভুলে,
মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্ব্বজন;”
তবু কেউই মনে রাখে না।
এহ বাহ্য। লোকেরা পাণ্ডুর মুখে চেষ্টা চালিয়ে যায় নিজেকে মনে রাখানোর।
এই অবধি লিখে ইতিউতি তাকিয়ে সতর্ক দেখে নিই। পাণ্ডুর লিখতে গিয়ে বানান ভুল হয়ে প এর জায়গায় গ বসে গেল কিনা। একবার এক সম্পাদককে পাণ্ডুলিপি পাঠাতে গিয়ে এই ভুলটি ঘটেছিল বলে জুতোপেটা খেয়েছিলুম। এই যেমন ইদানিং ফের খেয়েছি প্লেজিয়ারিজমের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে। যাক গে সে কথা, ওই মনে করানোর গল্পটা বলি।
আজ শ্যামলেন্দুর সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা হল। বিনবিনে ঘাম, প্যাচপেচে গরম। তারই মধ্যে আড্ডা। তিনি বহুদর্শী মানুষ। কত না চরিত্র দেখেছেন। তার মধ্যে নীলুদা’র কথা বললেন।
ওঁর জবানিতেই বলি। “নীলুদা’কে পেয়েছিলাম পার্ক-স্ট্রিট ব্র্যাঞ্চে। টিফিন পিরিয়ডে নীলুদা’র সঙ্গে বেরিয়েছি। কিছু-মিছু টিফিন করে ফিরব। ওই অঞ্চলে স্বাস্থ্যকর খাবার বলতে একমাত্র পাওয়া যায় কাটা ফল, যদিও কর্পোরেশন আর ভদ্রজন জানে কাটা ফল ঘোর অস্বাস্থ্যকর, কিন্তু বাকি খাবার অস্বাস্থ্যকরতর। তাই কাটা ফল।
আর তা’ছাড়া ওজন সংক্রান্ত একটা গোপন প্রতিজ্ঞায়ও এই ফল খাবার প্রেরণা।
তো মিউজিক ওয়ার্ল্ডের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা আড়াআড়ি ঢুকে গেছে, সেইখানে এই কাটাফলওয়ালারা বসে। সে দিক পানে যাচ্ছি। হাতে সময় সীমিত। দেরি হলে ব্র্যাঞ্চে ফিরে কাস্টমার আর ম্যানেজারের খিস্তির স্যান্ডউইচের মাঝে পুর হতে হবে। তাই তাড়াও খুব।
ওইখানে ওই ফুটেই বেশ কিছু হকার বসে জামা কাপড় বেচতে। তারা প্রবল ডাকাডাকি করছে।
দেখি তাদের মধ্যে এক টি-শার্ট বিক্রেতা, নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত সে। তার পসরার ওপর শুয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমুচ্ছে। মাথার নীচে পিঠের নীচে ছড়ানো টি-শার্টের সমুদ্র। তার মধ্যেই রাজকীয় নিদ্রা।
নীলুদা’ খুব আগ্রহ করে লোকটার সামনে দাঁড়াল। তাকে ঠেলাঠেলি করে, পেটে কোঁচড়ে গুঁতো মেরে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা যখন করছে, আমি তাড়া দিয়ে বললাম, – আহ্হা, করচোটা কী? শার্ট কিনবে তো এই তো আশে পাশে একশটা লোক চেঁচাচ্ছে। ও’দের থেকে কেনো!’
নির্বিকার নীলুদা’ ওকেই ঠেলেঠুলে তুলল।
অর্ধশয়ান বেচারার মাথার নীচে যে গাঁটরি তার থেকেই নাকি নীলুদা’র সাইজের এক জামা বার করতে হবে। কাজেই বাধ্য হয়ে বেচারাকে পুরো বডি তুলে উঠতে হল।
ওই গাটরি থেকে একটা লজঝর মার্কা ঝ্যালঝেলে টি-শার্ট পছন্দ করে দাম শুধোল নীলুদা’। সদ্য ঘুম ভাঙা সেই মহাবিরক্ত তেরিয়া লোকটি দাম বলল তিনশ টাকা।
ওই অঞ্চলে এমনিতেই ফুটপাতে জিনিস কেনার দস্তুর হচ্ছে হাফ দামের বেশি কদাপি না। যেমন এইটেই দরাদরি শুরু হবে একশ পঁচিশ থেকে, তারপর কিনতে হবে দেড়শ’য়, ডাহা লস তাতেও… যদিও।
আমি দরাদরি শুরু করতে যাব এমন সময়, নীলুদা’ গম্ভীর ভাবে ফস করে পকেট থেকে পাঁচশ টাকার নোট বার করে টাকা ফেরত নিয়ে ফের পকেটে রেখে, শার্টের প্যাকেটটা (প্যাকেট তো না, ফিনফিনে পলিথিনের ব্যাগ) নিয়ে ফেরার রাস্তা ধরল।
হ্যাঁ, তাড়াতাড়িই ফিরতে হবে। টিফিন টাইম শেষের পথে।
হন্ত দন্ত আমি শুধোলাম, – তাই বলে নীলুদা’ তুমি এই ফালতু শার্টটা মানে দরাদরি না করেই… এটা এটা পরবে তুমি?
নীলুদা বলল, – রোববার মর্নিং ওয়াকে পরব। তা’ছাড়া সামনেই দোল। তখন ইউটিলাইজ করব।
– কিন্তু কেন, নীলুদা’?
নীলুদা’ তার স্বভাবসিদ্ধ তাচ্ছিল্য মাখানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, – ওরে মূর্খ, এই যে ওকে কাতুকুতু দিয়ে জাগিয়ে, কষ্ট করে, রাগিয়ে দিয়ে এককথায় এ’টা কিনলাম মানে ঠকলাম, ও সারাজীবন এ’টা মনে রাখবে। এ’রকম একটা গাধার কথা ও জীবনে ভুলবে না।”
এই হল মনে রাখানোর গল্প।
যেমন শ্যামলেন্দুই কি ভুলতে পারবেন, ওঁর মুখ থেকে সদ্য শোনা গল্প, আভেন ফ্রেশ বলে চালিয়ে দেবার মানে টুকে লেখার এই অপকর্মটা?
পোস্ট করতে করতে গুন গুন করে উঠছে সুর।
এই কথাটি মনে রেখো…