জীবনে দীর্ঘ চলার পথে যে সমস্ত অসামান্য অসাধারণ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয়েছে, হরমোহনদা অর্থাৎ ডা: হরমোহন সিংহ তাদের মধ্যে অবশ্যই অতি বিশিষ্ট। হরমোহনদার সঙ্গে পরিচয় সম্ভবতঃ ‘৮২ সালে।হরমোহনদা তখন বর্ধমানের দাপুটে নেতা। এর পরে একেবারে ‘৮৫ সালে, যখন কাটোয়া হাসপাতালে join করি।
কাটোয়ায় আমি আসতে চাই নি। আগের পোস্টিং কান্দি থেকে আমি কার্শিয়াং যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলাম। হরমোহনদাই আমার বন্ধু প্রভাত ভড়ের মাধ্যমে আমাকে রাজি করিয়ে কাটোয়ায় নিয়ে আসেন। সেই থেকে টানা ৩৭ বছর নানা ঘাত প্রতিঘাত পেড়িয়ে হরমোহনদার সঙ্গে সম্পর্ক.. কমরেড, অনুজ, অতি নিকট আত্মীয় (আত্মার সঙ্গে যার সম্পর্ক সেই তো আত্মীয়, রক্তের সম্পর্ক নাই বা রইলো)। একবার, হরমোহনদার সঙ্গে ওনার এক পরিচিতের বাড়িতে গেছি। ভদ্রলোক জিগ্যেস করলেন, ‘ছেলে’? হরমোহনদা তৎক্ষণাৎ জবাব, ‘হ্যাঁ, তাই বলতে পারো’।
আমার রাজনৈতিক জীবনে নেতা কম দেখিনি। ‘৭৭এ বামফ্রন্ট সরকার আসার পর, মূলত ৭৭-৮০ সালের মধ্যে বিভিন্ন কারণে রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বড় অংশের কাছাকাছি আসতে হয় খানিকটা বাধ্য হয়েই। যদিও এর প্রতিক্রিয়া আমার ক্ষেত্রে খুব উৎসাহজনক ছিল তা নয়। তাই, ‘৮২ সালে কোলকাতা ছেড়ে চলে আসাটা আমার একদিক থেকে ভালোই লেগেছিলো। কিন্তু, কাটোয়ায় এসে এমন অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয় যাঁরা আপনা থেকেই সম্ভ্রম আদায় করে নেন। বস্তুতঃ, সেই সময়ে বর্ধমান জেলার বিভিন্ন অংশে একাধিক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ..’galaxies of leaders’। তাঁদের মধ্যেও হরমোহন সিংহ ছিলেন অনন্য।
হরমোহনদার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল অফুরন্ত energy বা উৎসাহ ও জীবনীশক্তি। কোনও একটা জিনিস মাথায় একবার ঢুকলেই হলো। রাইটার্স বিল্ডিঙের তৎকালীন আমলাদের অনেকের সঙ্গেই হরমোহনদার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই যুগে ব্যুরোক্রেসীর মধ্যে অনেকেই যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতেন বা করতে ভালো বাসতেন। হরমোহনদাকে তাঁরা সব সময়েই নানা রকম project-এর খবর দিতেন। একটা কথা ইদানীং কালে শুনছি(বিশেষতঃ মারা যাবার পরে), হরমোহন সিংহ ছিলেন আধুনিক কাটোয়ার রূপকার। আমি সত্যিই কিছুটা বিভ্রান্ত ..কাটোয়াকে কী আদৌ আধুনিক শহর বলা যায়? আর, হরমোহনদা তো সবে কাটোয়ার বিভিন্ন প্রকল্প শুরু করেছিলেন, যা তাঁর ক্ষমতা থেকে অপসারণের পরে বিশেষ অগ্রগতি লাভ করেনি।
তাঁর সম্বন্ধে একটা বড় অভিযোগ ছিল তিনি কাটোয়ায় সব প্রকল্প নিয়ে আসছেন, যার জন্য অন্যান্য অঞ্চল বঞ্চিত হচ্ছে। হরমোহনদা কিন্তু যে সব সময় কোনও নির্দিষ্ট blueprint ধরে চলতেন তা নয়। যখনই মনে হয়েছে কোনও বিষয়ে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারি বরাদ্দ পাওয়া সম্ভব, সাথে সাথেই expert-দের সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করে দিয়েছেন৷ একটা কাজ করতে করতেই পরের কাজে পৌঁছে যেতেন। কিন্তু প্রত্যেকটা কাজের খোঁজ রাখতেন খুটিনাটি সমেত। পরবর্তী কালে যখন আনন্দ নিকেতন তৈরি করেছেন, তখনও সেই ভাবে একটার পর একটা প্রকল্পের সূচনা করেছেন। আর, অসম্ভব ক্ষমতা ছিল মানুষকে রাজি করিয়ে অর্থ সংস্থান করতে।
বলতেন,’আরে লোকে টাকা দিতে চায়,তোমাকে শুধু ঠিকভাবে আর ঠিক কাজে চাইতে হবে’। এক্ষেত্রে, রাজনীতির পক্ষে বিপক্ষে কোনও ব্যাপারই ছিল না। বহু আপাতবিরোধী সম্পন্ন মানুষকে দেখেছি, এক কথায় রাজি হয়ে যেতে। ভাবার কোনও কারণ নেই, সেটা ভয় দেখিয়ে বা কোনও সুবিধা আদায়ের জন্য।
আসলে, হরমোহনদার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল সব ধরণের মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার, খোলামেলা মিশতে পারতেন দলমতনির্বিশেষে। কথা বলতেন সোজা সরলভাবে কোনও রাজনৈতিক ভাষ্যে নয়। তবে, তখন শুধু হরমোহনদাই নন, অনেককেই দেখেছি অনায়াস দক্ষতায় মানুষের সঙ্গে মিশতে বা জনসংযোগ বজায় রাখতে অতি স্বাভাবিক ছন্দে..তার জন্য আলাদা করে কোনও কর্মসূচি ঘোষণা করতে হতো না।
সর্বদা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝটপট কাজ করার অদম্য উৎসাহটাই ছিল হরমোহনদার প্রধান USP..। আবার, সেটাই হলো হরমোহনদার রাজনৈতিক জীবনের আরও নির্দিষ্ট করে বললে পার্টি পরিসরের যবনিকা পতন বা সমাপ্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ factor।
হরমোহনদার বিরুদ্ধে পার্টি যে show cause letter-টা দেয়, তার মূল অভিযোগই ছিল পার্টি শৃঙ্খলা না মানা এবং নিজের মতো চলা। হরমোহনদা শুধু তখন কেন, পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হবার পরেও কোনও দিন পুরোনো পার্টির বিরুদ্ধে কোনও খারাপ মন্তব্য করেন নি। বস্তুতঃ আমৃত্যু পার্টির সঙ্গে মনেপ্রাণে জড়িয়ে ছিলেন ওতোপ্রতোভাবে। উনি খুব তাত্বিকভাবে ঋদ্ধ ছিলেন না, রাজনীতি করতেন হৃদয় দিয়ে। বামপন্থার স্বর্ণযুগেও কিন্তু অনেক মানুষই মস্তিষ্কের থেকে হৃদয়টাই বেশী ব্যবহার করতেন। তবে, ব্যক্তি মানুষের হৃদয়ের খোঁজ রাখা তো আর পার্টির সামগ্ৰিক কাজের মধ্যে পড়ে না, তাই আক্ষেপ করে আর কী লাভ??
হরমোহনদার show cause letter-এর উত্তর হিসাবে লেখা প্রথম draft টা বাতিল করে সুন্দর করে সাজিয়ে লেখেন অশোক মিত্র, বিদ্যুৎ সচিব মুরশেদের ‘Are you a gentleman’ এই প্রশ্নের উত্তরে যিনি এক সময়ে অনায়াসে বলেছিলেন, ‘I am a communist’..। কিন্তু, স্বল্প আলাপেও বলবো, জীবনে অতো আপাদমস্তক ভদ্রলোক আমি খুব কম দেখেছি। পরবর্তী কালেও তাঁর সঙ্গে হরমোহনদার সম্পর্ক একই রকম হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল যখন অনেক বিখ্যাত মানুষ (যারা এক সময়ে হরমোহনদার অতি ঘনিষ্ঠ ছিলেন) হরমোহনদাকে বাস্তবিক ভাবে এড়িয়েই চলতেন। যাহোক, অশোক মিত্রের অসাধারণ কৌশলী উত্তরও হরমোহন সিংহের পার্টিগত রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি রোধ করতে ব্যর্থ হয়!!
সব কাজেরই নিশ্চয়ই মূল্যায়ণ প্রয়োজন, আর সেক্ষেত্রে তার আশু ও দূরবর্তী (in the long run) ফলাফলগুলি অবশ্যই অতীব গুরুত্বপূর্ণ। হরমোহন সিংহের বহিষ্কারের এই আশু ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল কী বামপন্থী প্রভাব ও কার্যকলাপের জন্য যথেষ্ট positive বা শুভ বার্তা বহন করে?? এটা ঠিক, পার্টি তো তার বাইরের লোকের কাছে জবাবদিহি করবে না। আর, পার্টি তার কোনও কর্মীর প্রতি কী মনোভাব নেবে, সেটা সম্পূর্ণতই তার নিজস্ব বিষয়। আমজনতার তো মাথা ঘামানোর কথা নয়……!! আসলে, জনতার মাথা ঘামানোর একটাই কারণ যে, ২০১১ সালে এদের প্রতিস্থাপিত করে রাজ্য রাজনীতির চাবিকাঠি যাদের হাতে গেছে, মানুষের জীবনকে তারা আর কতো দুর্বিষহ করে তুলবে, সেটাই মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। এটা ঠিকই এদের উত্থানের পিছনে জাতীয়, আন্তর্জাতিক শক্তি সমূহের মদত ছিল, কিন্তু অস্বীকার করা যাবে কি যে কাজের দীর্ঘসূত্রিতা, সিদ্ধান্তহীনতা, মানুষ থেকে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা ও দাম্ভিকতা সেই রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রবলভাবে অনুঘটকের কাজ করেছে..মসৃণ করেছে চরম সুবিধাবাদী এক অতি অশুভ শক্তির ক্ষমতা দখলের পথকে???
কালের নিয়মে নিশ্চয়ই এদেরও সরতে হবে, কিন্তু সেটা কতটা ক্ষতির পর সেটাই সম্পূর্ণ অজানা।
হরমোহন সিংহ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার পরেও ডা: জ্ঞান শীল, ডা:সুখময় ভট্টাচার্য এবং নিজের পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন ‘আনন্দ নিকেতন’। প্রকল্পের দৈনন্দিন কাজে অসম্ভব দায়িত্ব নেন কান্দরার অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির বিধায়ক এক সময়ের কিংবদন্তি সংগঠক শ্রীমোহন ঠাকুর, প্রাক্তন ভূমি ও রাজস্ব দফতরের প্রাক্তন আধিকারিক অরুণ গুহ, প্রাক্তন তথ্য আধিকারিক রবীন ঘোষ দস্তিদার, সুনীল ঘোষ, শুভাশীষ সিংহ..আরও পরে সুব্রত সিংহ। বেশ কয়েকজন ডাক্তার প্রায় পুরো সময়টাতেই যুক্ত থাকেন এই কর্মকাণ্ডে, যাদের মধ্যে প্রয়াত ডা: অরবিন্দ পাল অবশ্যই অগ্রগণ্য। খাজুরডিহিতে মানসিক প্রতিবন্ধীদের হোম, বৃদ্ধাবাস, ক্যানসার চিকিৎসা, দন্ত চিকিৎসা, কারিগরি শিক্ষা, লাইব্রেরীসমেত multiple facilities-এর সমাহার তৈরি হয়। এই বিষয়ে তিনি অবশ্যই সফল….নিঃসন্দেহে। কিন্তু, সামগ্রিক ভাবে রাজ্য ও বিশেষ করে কাটোয়া মহকুমাকে তাঁর যা contribute করার কথা (বা, সক্ষমতা) ছিল তার proper utilisation বা সম্পূর্ণ কার্যকরী প্রয়োগ হলো কতটুকু? হরমোহনদার সঙ্গে পার্টির সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরেও বামপন্থীরা ক্ষমতায় ছিল কুড়ি বছরেরও বেশী সময়। হরমোহন সিংহের মতো অসাধারণ কর্মবীর ও অসম্ভব উদ্যোগী মানুষকে কী আরও ব্যাপক ও গভীর ভাবে ব্যবহার করা যেত না??
ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা NGO-র মাধ্যমে মানুষের কাছে নিশ্চয়ই যাওয়া সম্ভব, কিন্তু তা কখনোই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বিকল্প হতে পারে না..সহায়তা করতে পারে খুব বেশী হলে……। অবশ্য আমাদের দেশে ব্যক্তি বা human resource-এর proper utilisation আর কবে হয়েছে..সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র এদের ভূমিকা প্রায়শঃই এই বিষয়ে সাধারণ ভাবে ঋণাত্মকই !!!
শেষ করবো দুটো কথা বলে…….
ডাক্তারদের কর্মক্ষেত্রে hooliganism-এর সম্মুখীন হওয়া তো নতুন ঘটনা নয়, আগেও ছিল…. যদিও বর্তমানে তার চারিত্রিক ধরণ, সংখ্যা এবং ultimately প্রতিবাদে ডাক্তার ও তাদের সংগঠনের ভূমিকায় যথেষ্ট পার্থক্য আছে। তবে সব জমানাতেই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিধায়ক ও রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা থাকে দ্ব্যর্থবোধক এবং অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি দুষ্কৃতীদের পক্ষেই…..এবং সেটা বিধায়ক ডাক্তার হলেও৷ উত্তর বঙ্গে থাকার সময় এক ডাক্তার বিধায়ককে পেয়েছিলাম, হাসপাতালের ডাক্তারদের বিরোধিতায় যার নিষ্ঠা ছিল অবিচল। হরমোহনদা এ বিষয়ে ছিলেন অসাধারণ ভাবে ব্যতিক্রমী। যখনই খবর পেয়েছেন, তৎক্ষণাৎ চলে এসেছেন৷ কখনও বা একা mob-এর সম্মুখীন হয়েছেন, ভয় ডর চিরকালই অবশ্য একটু কমই ছিল।
কাটোয়া থেকে চলে এসেছি ত্রিশ বছরেরও বেশী হয়ে গেছে কিন্তু, হরমোহনদার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। অসম্ভব স্মরণশক্তি ছিল, এমনকি brain stroke-এর পরেও। নিজেই ফোন করতেন, ইদানীং কালে অবশ্য কারুর সাহায্য নিয়ে। গত কয়েকমাস কথা ফোনে বুঝতে (হয়তো বা ওনার বলতেও) অসুবিধা হতো, speaker দিয়ে মন দিয়ে শুনতে হতো। কিন্তু, আন্তরিকতার ছোঁয়াটা সেই একই রকম, সেখানে কোনও হেরফের নেই।
বিভিন্ন কারণে বেশ কিছুদিন ‘আনন্দ নিকেতন’-এ যাওয়া হয়নি। শেষ যেবার গেছি, উঠে আসার সময়ে হাতটা ধরেই রয়েছেন….বলছেন ‘থেকে যাও’।আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না কি করবো..অশক্ত হাত থেকে আমার হাতটা ছাড়িয়ে নেবো? চুপচাপ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললাম, ‘হরমোহনদা ছাড়ুন, আমি আবার আসবো’। আস্তে আস্তে হাতটা ছেড়ে দিয়েছেন স্বভাবসুলভ স্মিত হাস্যমুখে …