তাঁর মৃত্যুতে শোক পাওয়া ধরাগলায় স্মৃতিচারণ করছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা লেফট আর্ম অর্থোডক্স স্পিনার, যিনি ঘটনাচক্রে একজন পাঞ্জাবি শিখ। “আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি। খুব খুব প্রিয় বন্ধু ছিলেন আমার, আমার প্রথম ক্যাপ্টেন। উনি ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম ‘নেতা’ যিনি ড্রেসিংরুমে বলতেন, তোমরা দিল্লি, পাঞ্জাব, মাদ্রাজ কলকাতার জন্য খেলছ না, খেলছ ভারতের জন্য। তোমরা সবাই ভারতীয়।”
বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এই কথাটা আমরা শুনে শুনে হেজে গেছি। বলা যত সহজ কাজে করাটা ততটাই কঠিন। সেই কঠিন কাজটা করেছিলেন ওই তরুণ ক্যাপ্টেন যার অল্প বয়সে ক্যাপ্টেন হওয়ার রেকর্ডটা এই সেদিন ভেঙে দিলো কোন এক তাতেনদা তাইবু।
প্লুরালিটিকে জমাট বাঁধা রূপ রস দেওয়া এই মানুষটি আজ বেঁচে থাকলে এই সহিষ্ণু বহুত্ববাদকে বাতিল করে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান গড়ে ওঠার চক্রান্ত কে দেখলে কি বলতেন কে জানে। অসহিষ্ণুরা তাঁকে হয়তো তাঁর ধর্ম পরিচয়ের কথা মাথায় রেখে ক্যাপ্টেন হতেই দিত না।
গোটা টেস্ট কেরিয়ারে ৬টা টেস্ট সেঞ্চুরি দিয়ে এই ক্যাপ্টেনকে মাপতে যাওয়া ভুল হবে যাঁর ডান চোখটা দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর মনের জোরে যে মানুষটা আবার ক্রিকেটের ময়দানে ফেরত এসেছিলেন। মাপতে গেলে ফিরে যেতে হবে ১৯৬৮ এর অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে।
জ্যাক ফিঙ্গলটনের ভাষায়, “ভারতের শুরুটা খুব খারাপ হয়েছিল। ২৫ রানে পাঁচ উইকেট। এমন সময় ক্যাপ্টেনের প্রবেশ। ট্র্যাজিক চরিত্রের মতো। হ্যামস্ট্রিং এ টান ধরায় জখম পাটা টানতে টানতে। কিছুক্ষনের মধ্যে ৪৭ রানে ৬ ইউকেট। অস্ট্রেলিয়া যাই ভেবে থাকুক, ভারতের ক্যাপ্টেন অন্য কিছু ভেবেছিলেন। ক্যারেক্টার, ইন্টালিজেন্স, রেসপেকটিবিলিটি। অস্ট্রেলিয়ার বোলিং এর ঘেটি ধরে আদায় করে নিলেন ক্যাপ্টেন”।
ফিঙ্গলটন তো কেবল ক্রীড়া সাংবাদিক নন, প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়া টেস্ট প্লেয়ারও। তাই আর পাঁচ জন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের মতো এই লড়াকু মনোভাবকে শ্রদ্ধা করতে জানতেন।
ফিঙ্গলটন তো মাঠের বাইরে বসে দেখেছিলেন, সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছিলেন যিনি তাঁর নাম অজিত ওয়াদেকার। ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডকে হারানো ক্যাপ্টেন, ঘটনাচক্রে যিনি একজন মারাঠি হিন্দু। উনি সেদিন তাঁর ক্যাপ্টেনের রানার হওয়ার সুবাদে স্কোয়ার লেগে দাঁড়িয়ে দু চোখ ভরে দেখেছিলেন তার ক্যাপ্টেনের সেই অবিশ্বাস্য ইনিংস। তাঁর ভাষায়, “এডিলেডের প্রথম টেস্টটা আমরা হেরে গেছি। জানাই ছিল যে এমসিজিতে প্রাণবন্ত উইকেট হবে। দেখলাম পিচ এত সবুজ যে মাঠের সাথে আলাদা করা মুশকিল। মেঘলা আকাশ। মাঝে মধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বল দু দিকে সুইং করছে। ক্যাপ্টেনের হাতে কোনো অপশন ছিল না। স্পিনারদের দিয়ে ফোর্থ ইনিংসে বল করাতে হবে। তাই ব্যাটের সিদ্ধান্ত। বাধ্য হয়ে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে টিমের ব্যাটিং এর ওই হাল। একটা চাপা রাগ, অসহায়, আমাদের হাতে ফাস্ট বোলার থাকলে আমরা বোলিংই নিতাম। ম্যাকেনজি এন্ড কোম্পানির ওই বোলিং এর বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর একটা অস্ত্র ফুটওয়ার্ক তখন ক্যাপ্টেনের নাগালে নেই। জখম পা। তাই কেবল তাঁর অসীম সাহস আর টেকনিক অবলম্বন করে লড়ে যেতে লাগলেন ক্যাপ্টেন। ৭৫টা অমূল্য রান বেরিয়ে আসলো তাঁর ব্যাট থেকে।”
একটা পা আর একটা চোখ নিয়ে সেই লড়াই যেকোনো ভারতীয় ব্যাটসম্যান এর সর্বকালের সেরা ইনিংসের তালিকায় জায়গা করে নেবে। ইনিংস শেষে বেরিয়ে আসছেন মাঠ ছেড়ে প্যাভিলিয়নের পথে দু’জনে। জখম পা টানতে টানতে ক্যাপ্টেন আর সঙ্গে তাঁর রানার। ওয়াদেকার বিড়বিড় করে বলছেন, “আমি সৌভাগ্যবান এমন একটা ইনিংস দেখতে পেলাম। আমি তোমার জন্য গর্বিত, ক্যাপ্টেন।”
এমসিজি-তে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেওয়া হাজার কয়েক সাদা চামড়ার মানুষ এর সাথে একই ভাবে হাততালি দিচ্ছে তাদের ক্যাপ্টেনের জন্য গর্বিত কিছু বাদামি চামড়ার মানুষ। উই লাভ ইউ ক্যাপ্টেন। হ্যাটস অফ। টুপি খুলে সেলাম। আমরা ভারতীয়।
ভারত নামের এই দেশটাকে ভালোবেসে এক পায়ে এক চোখে লড়াকু ইনিংস খেলা সেই ক্যাপ্টেন যেন কোনোদিন তার ধর্ম পরিচয়ের জন্য তার দেশের মানুষের শ্রদ্ধা থেকে বঞ্চিত না হয়। দেশটা যেন মৃত্যু উপত্যকা না হয়। নইলে আর কোনো মনসুর আলী খান পতৌদিকে কোনোদিন পাবে না এই ভারত।
জন্মদিনে ভালোবাসা নেবেন প্যাট।