চারিদিকে বেশ স্বস্তির ছাপ, কোভিড বিজয়ের হাসি আর কোভিড সাবধানতার গণবিসর্জন। মোদ্দা কথা “করোনা ফুটুক (‘ফুটে যাক’ অর্থে) না ফুটুক আজ বসন্ত” টাইপ অ্যাটিচিউড নিয়ে আমরা সবাই বিন্দাস। কারণ বসন্ত এসে গেছে, থুড়ি, ভ্যাকসিন এসে গেছে। কার আর ভালো লাগে এতদিন ধরে মাস্ক-টাস্ক পরে দূরত্ববিধির ঝক্কি সামলাতে! সত্যি বলতে কি আমারও ভালো লাগে না। তবে এই ভালো লাগালাগির আর ভ্যাকসিনানন্দে লাফালাফির বাইরে গিয়ে ভাবতে বসলে মনটা একটু আতঙ্কিত হয়ে ওঠে বৈকি! তবে মাইকে যে সবসময় ‘অযথা আতঙ্কিত’ হতে বারণ করার আবেদন! আসলে অযথা আতঙ্ক আর যুক্তিসঙ্গত সমীহ এক নয়, এ দুটোকে গুলিয়ে ফেললেই ঘোরতর সমস্যা। প্রথমটা অতিমারীর সময় বর্জনীয় আর দ্বিতীয়টা অবশ্য প্রয়োজনীয়। কারণ এই বিজ্ঞানমনস্ক সমীহ আর সতর্কতাই এই ধরণের অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রধান হাতিয়ার। আসলে ভয়টা প্রকারান্তরে বিষণ্ণতাকে প্রলম্বিত করলেও, ভবিষ্যত বিপদকে প্রতিহত করারও ক্ষমতা রাখে।
বিষধরের ফণা:
আমাদের দেশে কোভিভ-১৯ এর ঢেউ আছড়ে পড়েছে প্যাণ্ডেমিকের শুরুতে নয়, বেশ কিছুদিন পরে এবং প্রথম ঢেউয়ের ওঠানামাটাও নানা কারণে বেশ ধীরস্থিরভাবে চলেছে প্রায় একবছর ধরে। কিন্ত ততদিনে বিশ্বের অনেক দেশে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তরঙ্গও শেষ হবার মুখে। তাই অতীত অতিমারীর ইতিহাস ঘাঁটাঘাটি না করে, এই বর্তমান অতিমারীর হাতেগরম তথ্য দেখলেই বোঝা সম্ভব যে এই পর্যায়ক্রমিক ঢেউয়ের হাত থেকে কোনোদেশেরই নিস্তার নেই। এই তরঙ্গের পর তরঙ্গকে রুখে দিতে যেমন পারেনি কোভিড নিয়ে একেবারে ল্যাজেগোবরে অবস্থায় থাকা মহাপরাক্রমশালী অ্যামেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তেমনই পারেনি সেদেশের উত্তর সীমান্তে জুড়ে অবস্থিত বেশ সফলভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকারী দেশ কানাডা বা অল্প সময়ের মধ্যে কার্ভ ফ্ল্যাট করে দেওয়ার নজর কাড়া দক্ষতার দক্ষিণ কোরিয়াও। [ছবি – ১, ছবি -২, ছবি- ৩]
সুতরাং এটাই ভবিতব্য, এটাকে অস্বীকার করে এগোতে গেলে প্রতিরোধের প্রস্তুতি আর খেলার ছকটাই যাবে আদ্যোপান্ত ঘেঁটে। অন্যদের দিকে তাকানোর দরকারও বোধহয় আর নেই, শেষ কয়েকদিনের কোভিড সংক্রমণের গ্রাফ দেখলেই বোঝা যাবে বিষধর আবার ফণা তুলতে শুরু করেছে [ছবি- ৪]।
হার্ড ইম্যুনিটির মিথ:
মিথ্যে ছড়ায় আগুনের মতো, মিথ ছড়ায় দাবানলের মতো। ভারতে সংক্রমণের মাত্রা একটু কমতে না করতেই কে জানে কোত্থেকে হার্ড ইম্যুনিটির একখানা নিটোল গল্প উড়ে এসে জনমানসে গভীরভাবে জুড়ে বসল! কিন্ত বাস্তব তথ্য আলাদা; হার্ড ইম্যুনিটির জন্যে যত শতাংশ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ এবং তৎপরবর্তী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির প্রয়োজন, আই সি এম আর স্টাডি অনুসারে জনগণের মধ্যে কোভিড ইনফেকশন রেটের পরিসংখ্যান তার তুলনায় অনেক, অনেক কম। আর হার্ড ইম্যুনিটি তৈরি হলেও মিউটেশনে পরিবর্তিত ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে সেটা আদৌ কতটা প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারবে, সে প্রশ্ন তো রয়েই যায়। তাই মিথের এই মিথ্যে প্রচার মানুষের মনে অযথা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, যার হাত ধরে এসেছে গা ছাড়া মনোভাব। আর এই গণমনোভাবে, এই ইলেশনে আক্রান্ত আমরা সবাই; নেতা থেকে অভিনেতা, বুদ্ধিজীবী থেকে শ্রমজীবী, ডাক্তার থেকে মোক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে ফ্রন্টলাইন কর্মী, ইয়াং জেনারেশন থেকে সিনিয়র সিটিজেন, সবাই। আর এই গল্পের গরুকে গাছে তুলে বাস্তবকে যত বেশি অস্বীকার করব, কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ততবেশি পেছিয়ে পড়ব আমরা।
অলীক ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’:
“ভারতবর্ষের মানুষের সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, তাই এদেশে কোভিডের বাড়াবাড়ি আর হবে না।” “ভারতবাসীর জিনের গঠন কোভিড সংক্রমণেকে রুখে দিয়ে প্রায় পকেটে পুরে ফেলেছে।” “ভ্যাকসিন এসে গেছে, তাই করোনা এখন হাতের মুঠোয়।” ইত্যাদি, ইত্যাদি অসত্যের ওয়েভ আলোর থেকেও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে ভিত্তিহীন ধারণার ওয়েব তৈরি করেছে। নতুন বছরে পা দিয়ে সবার তাই খুশি-খুশি ভাব এবং সচেতনতার অভাব। অথচ বাস্তব হল এই সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি থেকেও থাকে, সেই ক্ষমতাকে পরাজিত করে আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত এক কোটি দশ লক্ষের বেশি মানুষ সরকারিভাবে সংক্রমিত হয়েছেন, মারা গেছেন এক লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজারের বেশি মানুষ। এই পরিসংখ্যান কিছুই নয়? ভারতবর্ষে সমস্যা তেমন বেশি কিছু নয় বলে উদ্বাহু নৃত্য করব!
“কতটা কান পাতলে পরে কান্না শোনা যাবে?
কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে,
বড্ড বেশী মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে?”
প্রতিদিনই কোন না কোন পরিচিত মানুষের হসপিট্যাল গমন, টিভি নিউজে মৃত্যুর বিপুল পরিসংখ্যান, প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন স্বাস্থ্যকর্মীর বা ফ্রন্টলাইন কর্মীর মৃত্যু, একই দিনে কোলকাতাতেই তিনজন ডাক্তারের জীবনহানি, সেসব এত সহজে ভুলে যাবার মতো নির্বুদ্ধিতা আমরা করব! আর কে না জানে, প্রথম ঢেউয়ের থেকে দ্বিতীয়-তৃতীয় ঢেউ অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিশালী! (ছবিগুলো দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।)
ভারতবর্ষীয়দের জিনের গঠনের সঙ্গে কোভিড সংক্রমণ ও মৃত্যুহারের সরাসরি সম্পর্ক এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তার থেকেও বড় কথা জিনের পরিবর্তন বা মিউটেশনের মাধ্যমে কতরকম খেলা যে দেখাতে পারে এই কোভিড ভাইরাস, সেকথা ভাবলেও শঙ্কিত হতে হয়। তখন কোথায় যাবে এসব গুল্প! সাউথ আফ্রিকান স্ট্রেইন, বৃটিশ স্ট্রেইন, ভারতীয় স্ট্রেইন, করোনার ঝুলিতে তো অস্ত্রশস্ত্রের অভাব নেই! এই তো দক্ষিণ ভারতের হায়দরাবাদ অঞ্চলেই দশ হাজারের ওপর সিম্প্টম্যাটিক বা রোগলক্ষণযুক্ত কোভিড রোগীকে আর টি – পি সি আর পরীক্ষায় ধরাই যায় নি ভাইরাসের মিউটেশনের জন্যে। যাকে ধরাই এত কঠিন, তাকে রোখার ব্যাপারে এতটা নিশ্চিত হওয়া কি অতি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে না!
একথা অস্বীকার করার কোন মানে হয় না যে আমাদের দেশে প্রথম তরঙ্গের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর মৃত্যুহার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ কম। কিন্ত সেই কম মৃত্যুহারের পেছনে ভারতীয়দের সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতা বা জেনেটিক মেক- আপের অবদান থাকলেও অন্যান্য কারণগুলোও স্পষ্ট। প্রথমত চীন, ইতালি, ইংল্যান্ড বা অ্যামেরিকায় যেসময় প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়েছিল, সেসময় রোগটার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা ছিল অপেক্ষাকৃত কম; তাই হেপারিন জাতীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা না করে ARDS গোত্রের রোগ ধরে নিয়ে সেই চিকিৎসা চলছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুহার ছিল অনেক বেশি। আমাদের দেশ কিছুটা বিশ্বব্যাপী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার স্বাভাবিক নিয়মে এবং কিছুটা শুরুতেই কঠোর লক ডাউন ঘোষণার মাধ্যমে এই মূল্যবান সময়টা অর্জন করে নিতে পেরেছিল, পেরেছিল প্রথম তরঙ্গেকে পেছিয়ে দিয়ে রোগটার গতিপ্রকৃতি কিছুটা জেনে চিকিৎসা করার সুযোগ। এরই সঙ্গে অন্তত প্রথমদিকে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা ও নির্দিষ্ট পদক্ষেপ, জনগণের সচেতনতা এবং অবশ্যই চিরকাল অসম্ভব জনসংখ্যার চাপ ও সময়ের চাপের মধ্যে কাজ করে অভ্যস্ত আমাদের দেশের দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরলস পরিশ্রম, এই কম মৃত্যুহারের পেছনে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বা উপাদান।
আর মৃত্যুহারটাই তো একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়। প্রথম তরঙ্গ যখন শীর্ষে পৌঁছেছিল তখনই হসপিট্যালের বেড স্যাচুরেশন পয়েন্টে পৌঁছে গেছিল। মাথার ওপর যখন আরো বড় ঢেউয়ের খাঁড়া ঝুলছে, তখন কী এ প্রশ্নটা আসে না যে আরো বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলে তারা চিকিৎসাটা পাবেন কী করে, তখন কি এই সঙ্গত প্রশ্নটাও উঁকি দেয় না যে সেই পরিস্থিতিতেও মৃত্যুহার কীভাবে কম রাখা যাবে?
সবচেয়ে মূল্যবান প্রশ্নটা হল, কম মৃত্যুহারের সুবিধেটা আমরা নেব, নাকি অসচেতনতা আর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের অলীক রথের সওয়ারি হয়ে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলব। সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার স্বাভাবিকভাবে আমাদেরই ওপর বর্তায়।
আর ভ্যাকসিন পাওয়ার আগে, শুধুমাত্র ভ্যাকসিনের খবরের উচ্ছাসে আপামর জনগণ যেভাবে মাস্কমুক্ত হলেন সেটাকে হারাকিরি বললে মোটেই বাড়াবাড়ি হয় না। আত্মহত্যা সবসময় তাৎক্ষণিক হয় না, ধীরে ধীরে বিপদের মুখে নিজেদের ঠেলে দেওয়াটাও আত্মহত্যারই সামিল। এপিডেমিক ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রধান উদ্দেশ্য হার্ড ইম্যুনিটি তৈরি করা। তাই দেশের সত্তর-আশি শতাংশ মানুষ টীকা না পাওয়া পর্যন্ত এই কোভিডসম্মত স্বাস্থ্যবিধি, বলাই বাহুল্য, সর্বক্ষেত্রে-সর্বস্তরে পালন করা উচিত। তার ওপর করোনা ভাইরাস চরিত্রগতভাবে আর এন এ ভাইরাস হওয়ায়, সার্স কোভ ২ এর বিপুলপরিমাণ মিউটেশন ঘটে গেছে, ক্রমাগত ঘটে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটতে চলেছে। ভাইরাসের এই চারিত্রিক পরিবর্তন যেমন রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিত্যনতুন প্রতিবন্ধক বয়ে আনছে, নতুন স্ট্রেইনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়েও অনিশ্চয়তার হেঁয়ালি তৈরি করছে। তাই ভ্যাকসিন নিয়ে অনাবশ্যক বিশ্বাসহীনতার বাতাবরণ যেমন ক্ষতিকারক, ভ্যাকসিন নিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের সুখের স্বর্গও ভীষণ বিপজ্জনক।
একথা অনস্বীকার্য যে হতাশার মধ্যেও কিছু পজিটিভ ভাবনা মানুষকে অন্ধকার সময়ের টানেল পেরোতে সাহায্য করে, কিন্ত ভিত্তিহীন ফিলগুড ফ্যাক্টর মানুষকে আরো অন্ধকারের দিকেই ঠেলে দেয়। বায়বীয় ফিল গুড ফ্যাক্টরের শোচনীয় পরিণতি ভারতবাসী আগে যে প্রত্যক্ষ করে নি তা কিন্ত নয়। আসলে অবাস্তব ভাবনার বুদবুদ ফাটতে সময় লাগে না, সেক্ষেত্রে এক লহমায় সমস্ত পজিটিভিটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। কিন্ত বাস্তব তথ্য আমাদের যে সাবধানতার পাঠ শেখায় সেটাই আমাদের দৃঢ়ভাবে পজিটিভ মানসিকতায় সম্পৃক্ত করে সচেতন আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। সেটাই আসল পজিটিভিটি, কারণ সেটাই আমাদের বাঁচার রাস্তা।
তথ্যসূত্র: worldometers.info
খুব ভালো লাগলো।