সকাল থেকে বসে আছি। আজ আমাদের ব্লাড আর সোয়াব স্যাম্পেল নিতে আসার কথা। গোটা ক্যাম্প থমথমে হয়ে আছে। খবর পেলাম ব্যারাক ১ এর সামনে অস্থায়ী টেবিল পাতা হয়েছে। সেখানে এসে বসেছেন আপাদমস্তক পলিথিন মোড়া দুই ডাক্তার। হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক, চোখে চশমা। আবাসিকরা একে একে লাইন করে সেই টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের রক্ত ও লালার স্যাম্পেল নেওয়া হচ্ছে। ১, ২ করে ব্যারাক ১২-র সামনে যখন টেবিল এসে দাঁড়ালো, ঘড়ির কাঁটা ১২ঃ৩০ টা ছুঁই ছুঁই। আমরাও লাইনে দাঁড়ালাম। লাইন এক এক করে এগোচ্ছে, আর আমি এক পা এক পা করে পিছিয়ে যাচ্ছি স্মৃতির অলিগলি ধরে।
তারিখটা ঠিক মনে পড়ছে না। ২৫ বা ২৬ শে জানুয়ারি হবে। উহানে গৃহবন্দী হয়ে বসে আছি। জানলার বাইরে আলো নিভে গেলে বুঝতে অনন্ত রাত্রি নামছে শহরে। চেয়ার টেবিলের নিরুত্তাপ স্থৈর্য দেখে হিংসে হচ্ছে। মাঝে মধ্যে ফোনে দু’একটা কথা। উদ্বিগ্ন বাবা মা, আত্মীয় পরিজন এবং বন্ধুবান্ধবদের দুশ্চিন্তা নিরসনের চেষ্টা করে চলেছি যথা সাধ্য। ফোন ফুরিয়ে গেলে, নিজেকে শান্ত রাখার পরীক্ষা নিরীক্ষায় ডুবে যেতাম। এরমই একটা সময় সেদিন ফোনটা এসেছিলো।
– Hello? Are you Srimoy Bhattacharya?
– Yes??
– Okay, Good. I am calling from Indian Embassy, Beijing. How are you now?
– Oh! Yes Sir!! I am okay. Any update about our evacuation?
– No, not yet. We are trying our best. Actually, we are collecting the name and exact location of Indians in Wuhan.
– Okay. Myself Srimoy Bhattacharya…
– That I know. Tell me your exact location.
– Yes, Yes.. I am in Central China Normal University campus.
– Okay. Let me ask you something. Are you a bong?
– Yes I am. I am from Kolkata.
– Kolkata! কলকাতার কোথায়?
– বিরাটি, বিরাটি স্যার।
– তাই নাকি! আমার বাড়িতো দমদম। বলুন কেমন আছেন? কবে এসেছেন চিনে?
নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সব চিন্তা যেন এক মূহুর্তে ছুমন্তর। এই দুঃসময়ে,পরিষ্কার বাংলায় কেউ আমার কুশল জানতে চাইছেন, তাও আবার নিরুদ্বিগ্ন গলায়! ভাবতেই পারছিনা। চোখ ভিজে যাচ্ছে কেন!
– আমি এই ২০১৯ এর ডিসেম্বর এই এসেছি, গবেষণা সূত্রে। আর এসেই তো…
– শুনুন,চিন্তা করবেন না আর একদম। আপাতত ওটা আমাদের কাঁধে ছেড়ে দিন। আমরা তো আছি নাকি? যখন যেকোনও দরকারে নির্দ্বিধায় ফোন করবেন।
– কি বলে যে আপনাকে ধন্য…
– কিচ্ছু বলতে হবে না। আমাদের শুধু একটাই চিন্তা এখন। আপনারা প্রত্যেকে নিরোগ অবস্থায় দেশে ফিরুন। আপাতত আর কিচ্ছু চাইনা। চিন্তা করবেন না। আমরা আছি।
লিখে বোঝানো যাবেনা, সেই ফোনের অনুভূতি। দেশে ফেরার অলীক স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার রূপকথা শোনাচ্ছিলো, বেজিং এ কর্মরত দমদম জংশন।
-নেক্সট। আরে জলদি আইয়ে। ক্যায়া আপ লোগ দিন ভর সোচতে রহেতে হ্যায়! লাঞ্চ টাইম হো গ্যায়া। জলদি আইয়ে। পহেলে ব্লাড, উঁহা যাইয়ে…
গিয়ে দাঁড়ালাম পরীক্ষকের সামনে। কনুই এর ওপরে শক্ত করে ব্যান্ড বেঁধে মুঠো শক্ত করতে বললেন। আমি মন বেঁধে নিলাম আঁটোসাটো।