ভারতের মানেসর ক্যাম্পে পৌঁছোনোর প্রথম কয়েক ঘন্টা খুবই অসংলগ্ন, এলোমেলো। বাস থেকে নেমে, মিলিটারি নির্দেশ মেনে লাইন করে সবাই ঢুকে পড়ছে যে যার ব্যারাকে। একেকটা ব্যারাকে বাইশ জন করে। আমরা হতভম্ব এই ব্যবস্থায়। উহানে থাকতেই জেনে ছিলাম এই রোগ নাকি ছড়ায় হিউম্যান কন্টাক্টে। তাই ফ্লাইটে ওঠা অব্দি চেষ্টা করেছিলাম নিজেদের মধ্যে ‘নিরাপদ’ দূরত্ব বজায় রাখার। কিন্তু এখানে তো তার কোন সুযোগই নেই। অগত্যা মনের মধ্যে একরাশ সন্দেহ, ভয়, দ্বিধা নিয়েই যে যার বিছানায় ছড়িয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। তখনও কেউ জানিনা আমরা ভাইরাস আক্রান্ত কিনা। নিজেদের মানববোমা মনে হচ্ছিলো। এই এতো জন যে একই ঘরে থাকছি, তাদের যে কোন একজন যদি আক্রান্ত হন, বাকিরাও ছাড় পাবেনা, এই ভয় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো প্রত্যেককে। যে ডাইনিং হলে দুপুর এবং রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিলো, সেখানকার লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েও এই একই দুশ্চিন্তা ঘিরে রাখছিলো আমাদের। বুঝতে পারছিলাম আমাদের হাতে আর কিছু নেই।
প্রতিদিন দুপুরে খাওয়ার আগে প্রত্যেক ব্যারাক এর থার্মাল চেক হতো। সবাই পাশাপাশি লাইন করে দাঁড়াতাম। উর্দিধারি ডাক্তারের দল এসে, মেশিন দিয়ে প্রত্যেকের টেম্পারেচার মেপে নিতেন। জানতে চাইতেন শারীরিক ভাবে কেউ কোন রকম কোন অসুস্থতা বোধ করছে কিনা। এভাবেই কেটে গেলো প্রথম দু’তিন দিন। কানাঘুষো খবর আসছে ইতমধ্যেই চার জনের নাকি জ্বর-জ্বর এসছে। তাঁদেরকে নাকি নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে পরবর্তী চেকআপের জন্য। উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায় ক্রমাগত আমাদের অস্থিরতা বাড়ছিলো। যাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো, তাঁরা কি তাহলে আক্রান্ত? এর পরের দিন থার্মাল চেকআপ এর সময় জানতে পারলাম আমাদের প্রত্যেকের ব্লাড এবং থ্রোট সোয়াব টেস্ট হবে আগামীকাল। একটা মেডিক্যাল টিম আসবে, যাঁরা এই ক্যাম্পে থাকা প্রত্যেকের ব্লাড এবং থ্রোট সোয়াব স্যাম্পেল নিয়ে যাবেন পরীক্ষা করার জন্য।
এখনও মনে করলে গায়ে কাঁটা দেয়, সেদিন রাতে আমরা কেউ ঘুমোতে পারিনি। আগামীকাল পরীক্ষা, তার দুদিনের মধ্যে রেজাল্ট। আমাদের প্রত্যেককে সুস্থ থাকতে হবে, এক জনের রিপোর্ট পজেটিভ এলেই বাকিদের শরীরে সংক্রমণের আশঙ্কা এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যাবে। সকালের অপেক্ষায় দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি সেই রাতে।