শুরুতেই ডিসক্লেইমার, লেখক আমার পরিচিত। শুধু পরিচিতাই নয়, বিশেষ স্নেহ ও প্রশ্রয়ের পাত্রী। কাজেই, যদিও সেই সম্পর্কের কথা প্রাণপণ সরিয়ে লেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পড়ার মুহূর্তে লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ছাপ পড়ে থাকতেই পারে এই পাঠপ্রতিক্রিয়ায়।
অবশ্য, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছাড়া বইখানা কি আদৌ পড়া হতো!! না না, আমাকে নাক-উঁচু আঁতেল ভেবে বসবেন না প্লিজ। আসলে পড়াশোনাটা আজকাল এমন বিষয়ভিত্তিক হয়ে গিয়েছে, গল্পের বই পড়া কমেছে খুব। আলেকালে এক-আধটা পড়া হলেও সে অধিকাংশই যাকে বলে খ্যাতিমান। তার মধ্যে “রহস্য ১২” জাতীয় নামের বই আচমকা পড়ে ফেলার সম্ভাবনা কতটুকুই বা!! অতএব, দোলন ঝলমলে হাসি মুখে বিষাণদা আমার বইটা পড়ে দেখো বলে বইখানা হাতে না ধরালে এমন আশ্চর্য বই পড়া হয়ে উঠত না, নিশ্চিত।
হ্যাঁ, আশ্চর্য শব্দটাই উপযুক্ত বিশেষণ। নিছক ভালো বা খারাপ নয়, বইখানা সত্যিই আশ্চর্য।
রহস্য ১২ – অতএব বারোখানা গল্প, এবং সেগুলো “রহস্য” গোত্রের, এটুকু অনুমান করতে পারার জন্য আপনাকে “সুশীল সমাজ”-এর অন্তর্ভুক্ত করা হবে না, সে তো বলা-ই বাহুল্য। কিন্তু এই “রহস্য” শব্দটা ভারি গোলমেলে। পুরোনো বাংলা বইয়ে অমুক “রহস্য করিয়া কহিল” বলতে যে রহস্য, রহস্য রোমাঞ্চ গল্পের রহস্যের থেকে সে রহস্য কিঞ্চিৎ দূরবর্তী। এ বইয়ের “রহস্য” আবার আরেক গোত্রের।
বাংলাভাষায় ইদানীং অলৌকিক-তন্ত্র-মন্ত্র-আধিদৈবিক লেখাপত্রর একটা বাজার তৈরি হয়েছে, শুনেছি। সত্যি বলতে কি, তার একটিও পড়া হয়নি। দোলনচাঁপা দাশগুপ্তর এই বইয়ের গল্পগুলোও অলৌকিক। সে অলৌকিকতা বাজারচলতি অলৌকিকের থেকে কতখানি ভিন্ন গোত্রের, তা বলতে পারব না – কেননা, এই যে বললাম, বাকিগুলো পড়া হয়নি। তবু, সম্ভবত ভিন্ন।
দোলনের গল্পে নিত্যনতুন পোশাক কেনার নেশায় আসক্ত মেয়েরা আচমকা স্থির হয়ে যায় শোকেসে, ম্যানিকিন রূপে। পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার নেশায় বন্ধুসান্নিধ্য ত্যাগ করে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা কিশোর আচমকা মেলার নাগরদোলায় চড়ে আবিষ্কার করে এই নাগরদোলা “টেম্পোরাল লুপ”-এর প্রবেশিকা – যেখানে ঘুরতে ঘুরতে সময় ও ঘটনার বোধ লুপ্ত হয়ে সবকিছুই পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। দোলনের গল্পে মধ্যবয়স্ক দম্পতি কালিম্পং-এর মর্গ্যান হাউসে গিয়ে… নাহ্ থাক, বইটা তো পড়বেন, নাকি আমি সবই বলে দেব!! দোলনের গল্পগুলো ‘ফ্যান্টাস্টিক’, কিন্তু সেই ফ্যান্টাসি আমাদের বাস্তবকেই ছুঁয়ে আছে। (অবশ্য কোন ফ্যান্টাসিই বা তেমন নয়!!)
জাদুবাস্তবতাকে যদি এমন এক ধারা বলে মানি, যার মধ্যে ফ্যান্টাসির এলিমেন্ট অনিবার্য, কিন্তু বাস্তবের বিশদ বিবরণের মধ্যে দিয়েই বা বাস্তবের অনুষঙ্গেই যে ফ্যান্টাসির বিস্তার, আর শেষমেশ যা বাস্তবকেই আরও নিখুঁত করে আমাদের চেনায় – সেক্ষেত্রে এই গল্পগুলো সম্ভবত ম্যাজিক রিয়্যালিস্ট। আবার, অবচেতনের ক্রিয়াকলাপকে বিবিধ রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করার অর্থে সঙ্কলনের কিছু গল্প পরাবাস্তববাদীও বটে।
কিন্তু গালভরা বিশেষণ বা শ্রেণীবিভাগ আপাতত বাদ থাকুক, আপনিই পড়ে সিদ্ধান্ত নিন, গল্পগুলো ঠিক কী বা কেমন!
প্রতিটি গল্পেরই কাহিনী চমৎকার। এক-আধখানা হয়ত অল্পবিস্তর সেন্টিমেন্টাল, কিন্তু সে আমার কাঠখোট্টা স্বভাবের জন্য মনে হচ্ছে, এমনও হতে পারে। গল্পগুলো নিয়ে আমার একটাই অনুযোগ, আরেকটু সময় নিয়ে গল্পগুলো লেখা যেতে পারত। খানিক যেন তাড়াহুড়োর ছাপ। এমন আশ্চর্য কাহিনী, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে চরিত্রগুলোর খড়ের কাঠামোয় আরেকটু যত্ন করে মাটি-রঙ-গর্জন তেল চাপানো যেত। তবে, আমার খুঁতখুঁতে ও ছিদ্রান্বেষী স্বভাবের কারণেই এমন পর্যবেক্ষণ, এমনটাও হতে পারে। বইটা পড়ুন। তারপর জানান।
রহস্য ১২
দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত
প্রণতি প্রকাশনী
দাম – ১২০ টাকা