প্রাথমিক কথা
মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক, দার্শনিক এবং জীবনবোধের বিশিষ্টতা এমন সর্বব্যাপী যে তাঁর এ দিকগুলোকে নিয়ে চর্চা অনেক উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক এবং দার্শনিকেরা করেছেন। এদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে দুটি বিষয় সহজেই চোখে পড়ে – প্রথম, তাঁর ধারণায় ও বীক্ষণে অহিংসার স্থান এবং দ্বিতীয়, তাঁর লেখা “হিন্দ-স্বরাজ” পুস্তিকাটি ও এ পুস্তিকায় নিহিত ধারণার ব্যাপ্তি। তুলনায় গান্ধীর বোধে মেডিসিনের দৃষ্টিকোণ থেকে চিকিৎসা, দেহ, দেশজ চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা কম। শুধু গান্ধী হিসেবেই এখনও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত যাঁকে নিয়ে আলোচনা করছি এ প্রবন্ধে তিনি তাঁর “আত্মচরিত”-এর (An Autobiography OR The Story of My Experiments with Truth, সম্পাঃ মহাদেব দেশাই) ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে জানাচ্ছেন যে তাঁর যখন ১৬ বছর বয়স সেসময়ে ফিসচুলা এবং আরও কিছু শারীরিক জটিলতায় মৃত্যুপথযাত্রী পিতৃদেবের পরিচর্যাকারী (nurse) হিসেবে তাঁর নতুন ভূমিকা নির্ধারিত হচ্ছে। এরপরে আমরা দেখি তাঁর প্রথম পুত্র হরিলালের জন্মের সময়েও তিনি প্রায় একমাত্র বা প্রধান নার্স হিসেবে কিভাবে নিজের ভূমিকা পালন করেছেন। সেকথা বিশেষভাবে উল্লেখও করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন একটি ছোট হাসপাতালে তিনি নিজেকে যুক্ত করেছিলেন – I found time to serve in the small hospital … It consisted in ascertaining the patient’s complaints, laying the facts before the doctor and dispensing the prescriptions. It brought me in close touch with suffering Indians, most of them indentured Tamil, Telugu or North India men. The experience stood me in good stead, when during the Boer War I offered my services for nursing the sick and wounded soldiers. The question of the rearing of children had been ever before me. I had two sons born in South Africa, and my service in the hospital was useful in solving the question of their upbringing. (সংকলিত রচনাবলী ৩৯, পৃঃ ১৬৪। পরবর্তীতে শুধু র. বলে উল্লেখ করা হবে।)
যাহোক, তাঁর বাবার পরিচর্যার মধ্যে ছিলো ফিসচুলার (fistula) ক্ষতের ড্রেসিং করা এবং বাড়িতে বাবার জন্য কিছু ওষুধ তৈরি করে দেওয়া। আমরা পরবর্তীতে দেখবো গেরস্থালী ওষুধ বা home remedies-এর একটি লক্ষ্যণীয় ভূমিকা রয়েছে মেডিসিন, চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত গান্ধীর নিজস্ব বোধে এবং চিন্তায়। তাঁর বাবার ক্ষেত্রে আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসকেরা তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা করেছিলেন এবং ব্যর্থ হয়েছিলেন। হাকিমরা বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টার এবং অন্যান্য চেষ্টা করে ব্যর্থ। ইংরেজ চিকিৎসকেরাও বাদ জাননি। তারা শেষ চেষ্টা হিসেবে অপারেশনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু গান্ধী পরিবারের পারিবারিক চিকিৎসকের আপত্তিতে অপারেশন হয়নি। গান্ধীর পরবর্তীতে মনে হয়েছে যদি সেসময় অপারেশন করা হত তাহলে ফিসচুলার ক্ষত দ্রুত সেরে যেত। বাবার মৃত্যু এবং একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা ও এর ফলাফল তাঁর জীবনে কতগুলো গভীর ছাপ রেখে গেল। একদিকে, পশ্চিমী চিকিৎসায় পরিচ্ছন্নতার (cleanliness) বিশিষ্ট অবস্থান; অন্যদিকে, সার্জারির ঔৎকর্ষ যা আয়ুর্বেদ বা হাকিমী চিকিৎসায় লভ্য ছিলোনা একেবারেই। এমনকি পশ্চিমী চিকিৎসায় পরিচ্ছন্নতা বা শুদ্ধতার ধারণার সাথে গান্ধী নিজেদের বৈষ্ণবীয় অবস্থানের সাথে সাযুজ্য পেয়েছেন – “quite consistent with Vaishnavism”। এক্ষেত্রে তাঁর পুরো বক্তব্যটি বেশ কৌতুহলীদ্দীপক। তিনি জানাচ্ছেন – Such cleanliness is quite essential no doubt, but Western medical science had taught us that all the functions, including a bath, can be done in bed with the strictest regard to cleanliness, and without the slightest discomfort to the patient, the bed always remaining spotlessly clean. I should regard such cleanliness as quite consistent with Vaishnavism. (Autobiography, p. 15)
নজর করার বিষয় হল গান্ধীর আত্মচরিতের এই অধ্যায়টির নাম – “My Father’s Death and My Double Shame”. কেন এমন অদ্ভুত শিরোনাম? কেনই বা তিনি দুবার লজ্জায় ভুগলেন? প্রথম কারণ হল বাবার মৃত্যুর দিন রাত ১০-৩০ থেকে ১১টা অব্দি তিনি বাবাকে ম্যাসাজ করে দিচ্ছিলেন। এসময়ে তাঁর কাকা এসে তাঁকে অব্যাহতি দেন, তিনি বাবার পরিচর্যা করা থেকে বিরত হন (যদিও এটাই ছিল তাঁর শেষ পরিচর্যা)। এরপরে তিনি স্ত্রী গমনে যান, ঘুমন্ত স্ত্রীকে জাগিয়ে তোলেন। স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক জৈবিক মিলনের মুহূর্তের পরেই তাঁর দরজায় আঘাত করে জানানো হয় বাবার মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনা তাঁর কাছে অসংশোধনীয় লজ্জার ছিল – “The shame … was this of my carnal desire even at the critical hour of my father’s death, which demanded wakeful service. It is a blot I have never been able to efface or forget …” (Autobiography, p. 15) প্রথম জীবনে “দ্বিগুণ লজ্জা”-র এই ঘটনা তাঁর জীবনের পরবর্তী প্রবাহে ব্রহ্মচর্য নিয়ে সুতীব্র আবিষ্টতাকে অনেকটা ব্যাখ্যা করতে পারে বোধ করি। শুধুমাত্র “অপ্রয়োজনীয়” যৌন সংসর্গই নয় ব্রহ্মচর্য ও ব্রহ্মচারীদের নিয়ে তাঁর মতামত এতদূর অবধি ছিল যে ব্রহ্মচারীরা ন্যূনতম প্রয়োজন ছাড়া অন্য সমস্তকিছু পরিহার করবে, এড়িয়ে চলবে। “এমনকি নুন বা হলুদের মতো সামগ্রীও বর্জন করবে। যদি একান্ত অবশ্যম্ভাবী কোন প্রয়োজন হয় তাহলে মেডিসিন হিসেবে এদের গ্রহণ করবে, ছ’টি স্বাদের রসনা পরিতৃপ্তির জন্য নয়”। (র. ৭৯, পৃঃ ৭৩)
গান্ধীর জীবনে carnal desire বা কামুকতার বিপরীতে স্থাপিত হয়েছিল ব্রহ্মচর্যের অবস্থান। তাঁর ধারণায় ছিল বিবাহ চলবে। কিন্তু সেখানে কোন কামভাব থাকা চলবেনা। সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সাথে মিলিত হবে। এখানে কেউ যদি পিতৃতান্ত্রিক, ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে চালু সংস্কৃত শ্লোক – পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা-র অনুলিপি খুঁজে পান তাহলে খুব দোষ দেওয়া যাবেনা। গান্ধীর নিজের বয়ানে – “বিবাহিত দম্পতি ব্রহ্মচারি হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্য যদি তারা সন্তানের জন্মলাভ ব্যতীত (except for the purposes of procreation) অন্য কোন সময়ে যৌন সঙ্গমের কথা না ভাবে”। (Key to Health, 1948, p. 31) এরপরেই বলছেন – “একটি কর্তব্য হিসেবে যৌন সঙ্গম হয়ে গেলে আবার লিপ্ত হবার আকাঙ্খা কখনোই উদ্দীপিত হবে না”। (পূর্বোক্ত) প্রসঙ্গত, পাঠকেরা অনেকেই তপন রায়চৌধুরীর গবেষণাপত্র “Love in a Colonial Climate: Marriage, Sex and Romance in Nineteenth-Century Bengal” (Modern Asian Studies, May, 2000) পড়ে থাকবেন। সেখানে রায়চৌধুরী দেখিয়েছেন ১৮৬০-এর গোড়া থেকে বাংলা সাহিত্যে রোম্যান্টিক ভালোবাসার গল্প একটি সর্বব্যাপী বিষয়বস্তু ছিল। কিন্তু উল্টো চিত্রই প্রাধান্যকারী জায়গায় ছিল – “In a system under which a girl married into a family rather than simply another young person, her conjugal experience was indistinguishable from her experience of family life. In that context, her life passed through clearly marked stages, each with its specific duties, expectations and distinctive emotional colouring. The first few years after marriage were spent in the role of a new bride.” (p. 361) গান্ধীর স্ত্রীর ক্ষেত্রেও এ মূল্যায়ন প্রযোজ্য।
আধুনিক মেডিসিন এবং গান্ধীর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বেশ বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে আশিস নন্দীর Savage Freud and Other Essays on Possible and Retrievable Selves গ্রন্থের Medicine and Its Nonmodern Critics অধ্যায়ে। আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করা যায়। দুটি প্রবন্ধই ইকনমিক অ্যন্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথমটি, শম্ভু প্রসাদের লেখা “Towards and Understanding of Gandhi’s Views on Science” (EPW, Sep. 29 – Oct. 5, 2001) এবং দ্বিতীয়টি প্রশান্ত খাত্রির “Bio-medicalisation and Gandhi’s Vision of Health: Observations from Sevagram” (EPW, March 7, 2015)। এছাড়া গান্ধীর দেহ ও স্বাস্থ্যের বোধ এবং তাঁর এ বোধকে কিভাবে “স্বরাজ”-এর ধারণা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে অন্বিত করেছিলেন এ সম্পর্কগুলো বোঝার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক হল জোসেফ অল্টারের লেখা Gandhi’s Body: Sex, Diet and the Politics of Nationalism (2000)। অল্টারের আরেকটি প্রবন্ধও “Nature Cure and Ayurveda: Nationalism, Viscerality and Bio-ecology in India” (Body & Society জার্নালের মার্চ ১১, ২০১৪, সংখ্যায় প্রকাশিত, পৃঃ ১-২৬) গুরুত্ব দাবী করে। ভেবে দেখার মতো কইলপিল্লাই জে চার্লসের লেখা Gandhi’s Views on Health (Journal of Religion and Health, vol. 18, no. 1 (January 1979), pp. 60-73)। অন্য আরেক প্রেক্ষিত থেকে দেখেছেন পরমা রায় তাঁর “Meat-Eating, Masculinity, and Renunciation in India: A Gandhian Grammar of Diet (Gender and History, vol. 14, no. 1, April 2002, pp. 62-91)।
শেষোক্ত প্রবন্ধটিতে পরমা রায় একটি কৌতুকপ্রদ মন্তব্য করেছেন – “Gandhi was almost … indeed notorious for his experiments in alimentation and elimination as for those in celibacy and nonviolent political action.” এ প্রবন্ধের অন্যত্র আরেকটি অনুধাবনযোগ্য পর্যবেক্ষণ রয়েছে পরমার – “The focus on ingestion/abstinence as parabolic form in Gandhi’s autobiographical and civic projects allows us – precisely through its reading of quotidian and the eccentric – to highlight the gendered implications of Gandhi’s preoccupation with his body and with the bodies that he sought to reform.”
জোসেফ অল্টার তাঁর “Nature Cure and Ayurveda” প্রবন্ধে কিছু চিন্তাউদ্রেককারী পর্যবেক্ষণ রেখেছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে যে গান্ধী অনুসৃত এবং অনুসরণীয় বলে “নেচার কিউর”-এর যে ধারণা গান্ধী এনেছিলেন তাকে যদি শারীরিকতা বা viscerality-র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় তাহলে – “visceral relationship between the body and the environment can profoundly contradict the supposedly logical relationship among culture, health and medicine in the imagination of a community and in the political ideology of state nationalism.” এখানে affectively শব্দটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের অবস্থান থেকে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ, গান্ধীর বিশ্বাসে স্থিত নেচার কিউর বা প্রাকৃতিক নিরাময়ের ধারণা কে “imagination of community” এবং “political ideology of state nationalism”-এর যা যৌক্তিক ভাষ্য আমরা স্বভাবত গ্রহণ করি তার থেকে ভিন্ন আরেকটি ভাষ্য নির্মাণ সম্ভব বলে অল্টার অন্তত দাবী করছেন। অল্টার বলছেন – “The feeling of health and well-being that is produced through nature cure is a visceral sense of being reintegrated into the natural world … nature cure allowed for the embodiment of sentiments that are intimately linked to a sense of being rooted in the elemental environment of a place – in this case, India”। পরে তাঁর ব্যাখ্যাকে আরো প্রসারিত করছেন – “nature cure effects a sublime link between the body and ecology and how this produces a kind of affective nationalism that is at once idealistic, personal and intimate, and also sensory and very down to earth.” পেনসিলভানিয়া বিশ্বাবিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক অল্টার নেচার কিউর-কে প্রায় দৈবী স্তরে উন্নীত করে ফেললেন “a sublime link between the body and ecology” এ কথাগুলোর মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয় একটি নতুন শব্দবন্ধ তৈরি করলেন affective nationalism যা একই সঙ্গে আদর্শগত (idealistic), ব্যক্তিগত এবং ইন্দ্রিয়গতভাবে সংবেদনশীল (sensory)।
নির্বিচারে, কিছু চাঞ্চল্যকর শব্দ বা neologism-এর অভিঘাতে সার্বজনীন করে তোলা (universalized) এরকম বক্তব্য কি মেনে নেওয়া সম্ভব? ক্ষুদিরামের মতো কিশোর যখন “দেশমাতা”-র জন্য ফাঁসীর দড়ি গলায় নেয় সেটা কি বৌদ্ধিক জাতীয়তাবাদ কিংবা অল্টারের ভাষায় “affective nationalism” যা একই সাথে “personal and intimate, and also sensory and very down to earth”? আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে কানাই-সত্যেনের ফাঁসীর আদেশ শুনে তাঁদের শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া। ওঁদের এই অংশগ্রহণ এবং জাতীয়তাবাদ তো শরীরীভাবে ধারণ করা ছিল, অর্থাৎ অল্টার-কথিত viscerality। আবার এদের অবস্থান একইসাথে ভীষণভাবে আদর্শগত (idealistic), ব্যক্তিগত এবং ইন্দ্রিয়গতভাবে সংবেদনশীল (sensory)। তাহলে নেচার কিউর-কে sublime স্তরে উন্নত করে গান্ধী-কথিত জাতীয়তাবাদের এরকম মহিমার স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত বাস্তব ভিত্তি সঠিকভাবে কি? কি এর আলাদা বৈশিষ্ট্য যা অন্য বিপ্লবীদের আদর্শগত অবস্থান থেকে পৃথক করেছে, গান্ধী অনুসৃত অহিংসার গোঁড়া অবস্থান ছাড়া?
আমাদের আলোচনায় আমরা পরে গান্ধীর মুখের ভাষ্যই বারবার শুনবো এবং এ ধারণাগুলোর সাথে মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করবো। কইলপিল্লাই জে চার্লস তো বলেই ফেললেন – “Gandhi was a great experimental scientist.” তাঁর প্রবন্ধে চার্লস পরবর্তীতে এর সমর্থনে বললেন – “To the villagers his constant advice was: “Bhaji Khao, chaoch pio, matti lagao” – eat vegetables, drink buttermilk, and apply mud poultice.” বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার এগুলো যদি নমুনা হয় তাহলে তো বিজ্ঞানকে সামগ্রিকভাবে নতুন করে বুঝতে হবে, অভিনবভাবে ভাবতে হয়!
[আমি পাঠকদের কাছে মার্জনাপ্রার্থী এরকম দীর্ঘ ইংরেজি উদ্ধৃতির জন্য। কিন্তু তাত্ত্বিক আলোচনার ক্ষেত্রে এ উদ্ধৃতিগুলোর বাংলা তর্জমা করাও প্রায় দুঃসাধ্য। এজন্য তর্জমা না করে ইংরেজিই রেখে দিলাম। শিক্ষিত পাঠককুল অবশ্যই বুঝে নেবেন ও আমাকে মার্জনা করবেন – এ ভরসা রাখছি।]
গান্ধী ও আধুনিক মেডিসিন নিয়ে যে আলোচনা নন্দী করেছেন তার প্রধান প্রতিপাদ্য তিনটি – প্রথম, গান্ধীর নিরামিষবাদ বা বৃত্তি (vegetarianism) ছিল ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের (individual autonomy) সন্ধানের একটি অংশ হিসেবে একজন ব্যক্তির জন্য তার দেহকে পুনরুদ্ধার করা। দ্বিতীয়ত, গান্ধী দেহ রাজনীতির ক্ষেত্রে তিন ধরনের হিংসার প্যাথলজিকাল চেহারাকে চিহ্নিত করেছেন – বর্ণভেদ প্রথা, গণিকাবৃত্তি এবং জীবিত প্রাণীর ব্যবচ্ছেদ (vivisection)। তৃতীয়ত, নন্দী যেমন বলেছেন, “Gandhi’s thought incorporated the idea of iatrogeny (ডাক্তার বা চিকিৎসা-সংক্রান্ত পদ্ধতির ফলে রোগীর যে ক্ষতি হয়) but went beyond it.” (প্রসঙ্গত, iatrogeny ও অন্যান্য অনুষঙ্গ নিয়ে লেখা আমার একটি প্রবন্ধ একক মাত্রা-র ২০১৫-র মে সংখ্যায় “উন্নত চিকিৎসা, চিকিৎসার উন্নয়ন – চিকিৎসার আবর্জনাও!” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।) নন্দীর ভাষায়, এক কথায় বলতে গেলে, “the discipline of the body served as a model for the civics of the body politic.”
কিন্তু জোসেফ অলটার গান্ধীর নিরামিষবাদকে ভিন্নভাবে দেখেছেন – “it is interesting to note that one of Gandhi’s earliest experiments with the biomorality of public health pitted the biology of race against a dietetics of vegetarianism.” (Joseph Alter, “Gandhi’s Body, Gandhi’s Truth: Nonviolence and the Biomedical Imperative of Public Health”, Journal of Asian Studies, May, 1996, pp. 301-322) অলটার তাঁর Gandhi’s Body পুস্তকে বলছেন দেহের ক্ষেত্রে (“somaticity”) গান্ধী তাঁর ব্যক্তিগত ধারণাকে প্রসারিত করেছিলেন public sphere বা সামাজিক ক্ষেত্রে। এবং এ ধারণা আদতে ছিল একটি প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় জাতীয় সমাজ বা national community-কে শুধু কল্পনায় নয়, দেহের পরিসরে স্থাপন করা হয় (“somaticized”)। তাহলে অল্টার দুটি কথা বললেন – (১) “affective nationalism” বা সেই জাতীয়তাবাদ যা visceral, এবং (২) শারীরিকতা বা somaticity-র সাথে জতীয়তাবাদের নিবিড় যোগ। অর্থাৎ, দুধরনের দুটি খুব কাছাকাছি, প্রায় সমধর্মী শব্দ – viscerality এবং somaticity – অল্টার ব্যবহার করলেন জাতীয়তাবাদকে ভিন্ন মাত্রা ও ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে যে দেখা সম্ভব তা বোঝাতে। কিন্তু অ্যাকাডেমিক ডিসকোর্সে এর খানিকটা মূল্য থাকলেও গান্ধীর দেহ ও স্বাস্থ্যের বোধ, ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং জনস্বাস্থ্য – এরকম জটিল, জরুরী এবং পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলোকে বাস্তবে ব্যাখ্যা করা ও বোঝারজন্য আদৌ কতোটা কার্যকরী এরকম ব্যাখ্যা এ নিয়ে ঘোর সংশয় আছে। আমরা গান্ধীর নিজের বয়ানেই এগুলোকে জানবো খানিক বাদে।
উন্মেষকাল
১৮৮৮ সালে লন্ডনে ব্যারিস্টার হবার জন্য পৌঁছনোর সময় থেকে গান্ধীর চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অধিকার করেছিল দেহ এবং নিরামিষ খাদ্যবিধি নিয়ে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত নিজস্ব ধারণা। যদিও এ ধারণা একান্তই নিজস্ব এমন বলাটা খুব সঙ্গত এবং তথ্যগতভাবে সৎ হবেনা। তিনি জন রাস্কিনের Unto This Last পড়েছিলেন, তলস্তয়ের চিন্তার সংস্পর্শে আসেন (“overwhelmed” by Tolstoy’s The Kingdom Is Within You, when he first read it during his initial visit to Transvaal), প্রভাব পড়ে বেন্থামের উপযোগিতাবাদের (utilitarianism) এবং রবার্ট আওয়েনের ইউটোপিয় চিন্তার। (Stanley Wolpert, Gandhi’s Passion: The Life and Legacy of Mahatma Gandhi, p. 55)।
পরবর্তীকালে (১৯০৬ থেকে ১৯০৯ সালের মধ্যে) যখন তিনি আবার লন্ডনে গিয়েছেন তখন শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা, সাভারকর প্রভৃতি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হন। সন্ত্রাসবাদ, রুশ নিহিলিজম, মার্ক্সবাদ, আইরিশ হোম রুল এবং ইতালীয় Risorgimento ইত্যাদি সমস্ত ধরনের চিন্তার প্রবাহ লন্ডনে সবলভাবে সক্রিয় ছিল। এগুলোর সাথে পরিচিতও হয়েছিলেন তিনি। অ্যান্থনি প্যারেল সম্পাদিত গান্ধীর “হিন্দ স্বরাজ”-এর ভূমিকায় প্যারেল মন্তব্য করছেন – “Even a superficial glance at Hind Swaraj will be enough to make reader realize that Gandhi had this group very much in mind when he wrote Hind Swaraj.” (p. xxv)
পরবর্তী সময়ে আরো কয়েকটি বই তাঁর স্বাস্থ্যবিধি, দেহকে ওষুধ-মুক্ত রাখা এবং দেহ-সংক্রান্ত বোধকে গভীরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। আমরা স্মরণে রাখবো ১৮৪০-এর দশক থেকে সেবাস্টিয়ান নেইপ (Sebastian Kneipp)-এর প্রভাবে জার্মানিতে nature cure বা প্রাকৃতিক নিরাময়-এর জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেবাস্টিয়ান নেইপ-এর নেতৃত্বে যে Natural Cure Movement শুরু হয়েছিলো ও দেশে তা পূর্ণতা পায় Lebensreformbewegung বা “জীবন সংস্কারের আন্দোলন”-এ। প্রাকৃতিক নিরাময়-এর জন্য আন্দোলনের প্রাথমিক অভিমুখ ছিলো প্রাকৃতিকভাবে নিরাময়, ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের এবং ক্রম-নগরায়নের (urbanization)-এর বিরোধিতা। আবার Lebensreformbewegung বা “জীবন সংস্কারের আন্দোলন”-এর প্রধান অভিমুখ ছিলো প্রশমিত জীবনযাপন (temperance), ধূমপানের বিরোধিতা, এমনকি টীকা দেবার বিরোধিতা (anti-vaccination) করা। আমরা এ জাতীয় সবকটি চারিত্র্যলক্ষণ দেখবো গান্ধীর মাঝে। নেইপের কথায় আসি। তাঁর চিন্তার মূল সূত্র ছিল ৫টি – (১) হাইড্রোথেরাপি বা জল দিয়ে চিকিৎসা, (২) ফাইটোথেরাপি বা বৃক্ষের সাহায্যে চিকিৎসা, (৩) শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম, (৪) উপযুক্ত খাদ্য ও পুষ্টি, এবং (৫) ভারসাম্য বা ব্যালান্স রক্ষা করে চলা। ১৮৯০ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হলো তাঁর বই Meine Wasser-Kur (My Water Cure)। Kneipp-এর এ বইটির ১৮টি সংস্করণ হয়েছিলো।
এ গ্রন্থটি গান্ধী পড়েছেন বলে তাঁর কোন লেখা থেকে আমরা জানতে পারিনি। কিন্তু সেসময়ে জার্মানি তথা ইউরোপ ও আমেরিকায় নেচার কিউর বিষয়টি জনসমাজের একাংশে প্রভাব বিস্তার করেছে। এর ঢেউ গান্ধীর মাঝেও পড়েছে নিঃসন্দেহে। নেচার কিউর সংক্রান্ত অন্য যেসমস্ত গ্রন্থ গান্ধী পাঠ করেছিলেন সে বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জার্মানে ১৮৯১ সালে এবং ইংরেজি অনুবাদে ১৮৯২ সালে প্রকাশিত লুই কুনের (Louis Kuhne) The New Science of Healing or the doctrine of the Oneness of all Diseases এবং ১৯১৭ সালে প্রকাশিত কুনের Neo-Naturopathy: The New Science of Healing or The Doctrine of Unity of Diseases। অ্যাডলফ জাস্টের (Adolf Just) Return to Nature! Paradise Regained (১৯১২) বইটিও তাঁকে সারা জীবন প্রভাবিত করেছেন। এমনকি তাঁর নিজস্ব জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ধারণা লক্ষ্যণীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে এ বইগুলো। Return to Nature-এর দুটি অংশ মনোযোগ দাবী করে। এক জায়গায় জাস্ট বলছেন – “To-day the people mostly turn their inner discontent against the State and its institutions.” (p. 272) এখানেই পাদটীকায় যোগ করেছেন – “Men always look for the cause of their misery outside of themselves, always they themselves to blame.” এর নির্গলিতার্থ দাঁড়ালো যে মানুষ তাদের নিজেদের অস্তিত্বের বাইরের ঘটমান কারণগুলোকে তাদের কষ্টের নিমিত্ত বলে মনে করে, কিন্তু বাস্তবে তারা নিজেরাই নিজেদের দোষের জন্য দায়ী। এ এক অদ্ভুত যৌক্তিক হেত্বাভাস এবং অভিনব যুক্তিকাঠামো যেখানে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইত্যাদি মানুষের অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণকারী সমস্ত ঘটনা পর্যবসিত হল ব্যক্তির দায়িত্বে। স্মরণে রাখবো স্বয়ং গান্ধীও “পাপ”এর অজুহাতে চৌরিচৌরার আন্দোলন একতরফাভাবে তুলে নিয়েছিলেন।
তাঁর বইয়ের আরেক জাস্ট জায়গায় বলেছেন – “Mankind to-day is without ideals; it is ever striving for material benefit.” (Return to Nature, p. 274) জাস্টের এ ধারণাকে যদি গান্ধীর পূর্ণ আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, ব্রহ্মচর্য এবং রাষ্ট্রের বাইরে বা রাষ্ট্রের সাথে সঙ্ঘাতে না গিয়ে তাঁর নিজস্ব “স্বাবলম্বন”-এর ধারণার সাথে যুক্ত করে দেখি তাহলে একটি চিন্তা এবং বোধ গড়ে ওঠার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। আমরাও গান্ধীর অহিংসা-তত্ত্ব, রাষ্ট্রের সাথে বহুক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং রাষ্ট্রের পরিবর্তে ব্যক্তিকে সামাজিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অসংখ্য বিধি দিয়ে বদলানোর ও বেঁধে ফেলার রাজনৈতিক-মতাদর্শগত চেহারা এবং চরিত্র খানিকটা হলেও বুঝতে পারি।
গান্ধী নিজে তাঁর আত্মচরিতে দুটি গভীর আবগের (passion) কথা জানিয়েছেন – (১) ব্রিটিশ সংবিধানের প্রতি তাঁর আনুগত্য, এবং (২) নার্সিং-এর জন্য তীব্র আবেগ (র. ৩৯, পৃঃ ১৪০-৪৩)। দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালে থাকার সময়ে ডঃ ল্যান্সলেট বুথের একটি ছোট হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করার জন্য তিনি “felt strongly to serve as a nurse”। তাঁর নিজের বয়ানে – “during the Boer War I offered my services for nursing the sick and wounded soldiers.” (র. ৩৯, পৃঃ ১৬৪) কইলপিল্লাই জে চার্লসের তথ্য থেকে জানতে পারি – ১৮৯৯ সালে বুয়র যুদ্ধের (Boer War) শুরুতেই গান্ধী ১১০০ ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে একটি ambulance corps গঠন করেছিলেন। এরা বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার গান্ধীকে এজন্য উপযুক্ত পুরস্কারও দেয়। ১৯০৬ সালে যখন ব্রিটিশ সরকার তথাকথিত জুলুদের বিদ্রোহ বা “Zulu Rebellion”-কে সমুচিত শিক্ষা দেবার জন্য অভিযান চালায় তখন গান্ধী আবার ambulance corps তৈরি করেছিলেন। এ দুটি যুদ্ধে ক্ষত ও অন্যান্য অসুস্থতার নার্সিং-এ গান্ধীর যথেষ্ট ভালো হাতেকলমে শিক্ষা হয়। (Koilpillai J Charles, “Gandhi’s Vision on Health”, p. 72)
আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা এখানে বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। সেসময়ে (১৯০০-র প্রথম দশকে) তারকনাথ দাস (বাংলার গুপ্ত সমিতি “অনুশীলন সমিতির”-র একলন সভ্য) কানাডা হয়ে আমেরিকায় পৌঁছন ১৯০৬ সালে। ১৯০৮-এ আবার ভ্যাঙ্কুভারে সরে এসে Free Hindustan নামে এক পেনি দামের একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে শুরু করেন। Free Hindustan-এর সম্পাদক হিসেবে অনুরোধ করায় তলস্তয় তাঁর বিখ্যাত চিঠি Letter to a Hindoo (১৯০৮) লেখেন এবং সে চিঠি প্রকাশিত হয়। এ চিঠি প্যারিস হয়ে ১৯০৯-এর ডিসেম্বরে গান্ধীর কাছে পৌঁছয়। এরপরে গান্ধী-তলস্তয় পত্র বিনিময় হয়, তলস্তয় গান্ধীকে অহিংস পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সহমত জানান। গান্ধী এ চিঠির ইংরেজি ও গুজরাতি তর্জমা করে তাঁর Indian Opinion সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন। তলস্তয়ের দৃষ্টিভঙ্গী, মনে হয়, গান্ধীর vivisection-বিরোধী অবস্থানকে আরও জোরালো করে, যার প্রভাব পড়ে তাঁর দেহ, মেডিসিন, স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ধারণায়।
এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে বিখ্যাত চিকিৎসক রাধাগোবিন্দ কর (ডঃ আর জি কর) এবং তাঁর পিতা দুর্গাদাস কর দেশজ স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে বাংলায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছিলেন। দুজনেই তাঁদের বইয়ে আধুনিক চিকিৎসার দৃষ্টিকোণ থেকে গার্হস্থ্য চিকিৎসার বিষয়টিকে দেখেছিলেন। দুর্গাদাস করের লেখা “ভৈষজ্য রত্নাবলী” গ্রন্থটির ৬ষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৭৮-এ। এতে গ্রন্থটির জনপ্রিয়তা বোঝা যায়। ডঃ আর জি কর লিখেছিলেন “ভিষক-বন্ধু” (২য় সং, ১৮৭৯) এবং “সংক্ষিপ্ত ভৈষজ্যতত্ত্ব” (১৯০৫)। তিনি ওষুধের প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুটি ভাগ করেছিলেন – “(১) র্যাশনাল বা যুক্তিসঙ্গত বা যৌক্তিক আময়িক প্রয়োগ; – (২) এম্পাইরিকাল বা বহুদর্শনসিদ্ধ (ঔষধের ক্রিয়া বিষয়ে না জানিয়া যে ঔষধ প্রয়োগ করা যায়)।” আমার বলার কথা এটুকু যে তৎকালীন ভারতবর্ষের চিকিৎসা বঞ্চিত লক্ষ কোটি জনতার কাছে কিভাবে সুলভ চিকিৎসা যা একেবারে গার্হস্থ্যস্তরে করা সম্ভব সে বিষয়ে দুর্গাদাস বা রাধাগোবিন্দ করের মতো বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ভেবেছেন। সহজ গার্হস্থ্য চিকিৎসার লক্ষ্যে প্রচুর সংখ্যক পত্র-পত্রিকা বাংলা সহ ভারতের অন্যান্য ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে নিয়মিত – একটা সময় জুড়ে। মোদ্দা কথা, আধুনিক ইউরোপীয় মেডিসিন, দেশজ আয়ুর্বেদ, ইউনানি, সিদ্ধা বা গ্রামাঞ্চলে চালু ভেষজ এবং জড়িবুটি ইত্যাদি সব ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতির সংশ্লেষণে একটি eclectic চিকিৎসার ধারণা বিভিন্ন জায়গায় ছিলো। কিন্তু এ ধারণাকে কোন চিন্তাশীল মানুষই জনস্বাস্থ্যের বিকল্প ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেননি, যেমনটা মূলত গান্ধী করেছেন অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে।
আরেকটি ঐতিহাসিক তথ্য এখানে উল্লেখ করার দাবী রাখে। আমাদের সবার জানা যে সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি পর্যটক জাঁ বাপতিস্ত ট্যাভার্নিয়ের এদেশে ১৬৩০-১৬৬৮ সাল অবধি ছিলেন, পর্যটন করেছিলেন। একাধিক খণ্ডে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী Travels in India. তাঁর পুস্তকের প্রথম খণ্ডে তিনি সাধারণ মানুষের অসুখের সাথে মোকাবিলা করার পদ্ধতি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রেখেছেন – “when the rains have fallen and it is season for collecting plants, mothers of families may be seen going out in the mornings from the towns and villages to collect simples which they know to be proper for the diseases which occur in a family.” অর্থাৎ, বর্ষাকাল শুরু হলে শহর গ্রাম সবজায়গা থেকেই পরিবারের মায়েরা সকালবেলা্তেই বেরিয়ে পড়েন প্রাকৃতিক ওষধি সংগ্রহের জন্য, যেগুলো তাদের জ্ঞানে তারা জানেন যে পারিবারিক চিকিৎসার কাজে লাগবে। (Travels in India, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৩০০-৩০১) অস্যার্থ, দেশজ গার্হস্থ্য চিকিৎসার একটি শক্তিশালী এবং নিবিড় ধারা ভারতে চালু ছিলো। কিন্তু সেটা প্রাধান্যকারী ধারা হিসেবে ছিলোনা কখনোই। ছিলো একান্তভাবে লৌকিক বিশ্বাসের ওপরে নির্ভর করে। গার্হস্থ্য চিকিৎসার বাইরে, রোগ গভীরতর হলে, মানুষ আয়ুর্বেদীয়, ইউনানি বা সিদ্ধা চিকিৎসার শরণ নিত। নেচার কিউর-এর আন্দোলন, প্রভাব এবং ধারণা অনেকটা “দাও ফিরে সে অরণ্য”-র মতো অনুষঙ্গে কয়েকটি বিশেষ ধরনের প্রাকৃতিক পদ্ধতিকে (এ চিকিৎসাধারার প্রবক্তাদের ভাষায়) চিকিৎসার একমাত্র ভাষ্য করে তুলতে চাইলো। এখানেই সমস্যা তৈরি হতে শুরু করলো – জ্ঞানতাত্ত্বিক, ব্যবহারিক এবং কার্যকারিতা ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই।
কোন নির্ভরযোগ্য, পদ্ধতিগত, নিবিড় যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে না গিয়ে প্রয়োগের জগতে কিছু ব্যক্তিগত সাফল্য এবং সেগুলোকে সার্বজনীন চরিত্র দেবার যথেষ্ট শক্তিশালী প্রয়াস এবং ক্ষমতা ছিলো নেচার কিউরের প্রবক্তাদের মাঝে। কিন্তু এ প্রয়াস সাধারণ দার্শনিক কিংবা বৈজ্ঞানিক কোন যুক্তি কাঠামোতেই tenable তথা যুক্তিসিদ্ধ বা ধরে রাখা যায় এমন দাবী করলে সে দাবী বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। কারণ, এ পরীক্ষাগুলো এতটাই ব্যক্তিগত স্তরে অভিজ্ঞতার মাঝে নিহিত যে দর্শনের সাধারণ যুক্তিক্রম ও কাঠামো দিয়ে যাচাই করে নিলে রজ্জুতে সর্পভ্রম হবার সম্ভাবনা থাকে। আবার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কথা বললে এরকম একক অভিজ্ঞতার টুকরো টুকরো এম্পিরিকাল জ্ঞান সার্বজনীন তত্ত্ব গড়ে তোলার কোন উপাদানই হতে পারে না।
স্বাস্থ্য, মেডিসিন, দেহ, জনস্বাস্থ্য – গান্ধীর বোধে
“হিন্দ স্বরাজ” গ্রন্থের ১২ নম্বর অধ্যায়ে মেডিসিন পেশা (medical profession) সম্পর্কে তাঁর মতামত – “আমি একসময়ে মেডিক্যাল পেশার অতি ভক্ত ছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল দেশের জন্য একজন ডাক্তার হব। আমি এখন আর সে ধারণা পোষণ করিনা। আমি এখন বুঝি কেন আমাদের মাঝে চিকিৎসা পেশার মানুষেরা (বৈদ্যরা) আর সম্মানজনক অবস্থানে নেই”। এরপরে বলছেন – “আমাদের বশে রাখার জন্য ইংরেজরা নিশ্চিত এবং কার্যকরীভাবে এদের ডাক্তারি পেশাকে ব্যবহার করেছে। … ডাক্তারেরা প্রায় সম্পূর্ণত আমাদের উন্মূল (unhinged) করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় অতি শিক্ষিত ডাক্তারদের তুলনায় হাতুড়েরা ভালো। …. কি করে এতসমস্ত রোগের উৎপত্তি হয়? …. ডাক্তারেরা বাইরে থেকে হস্তক্ষেপ করে সারায় এবং আমাদের পুরনো অভ্যেস ধরে রাখতে সাহায্য করে। … যদি ডাক্তারেরা বাইরে থেকে হস্তক্ষেপ না করতো তাহলে প্রকৃতি নিজের কাজ করতে পারতো। …. এজন্য ওষুধের একটি কোর্স চালু হলে অবশ্যই মনের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়।” একই ধারণা থেকে তিনি পাঠকদের বোঝান যে ডাক্তার এবং ওষুধের ওপরে নির্ভরশীলতা মানুষকে আত্মনির্ভরতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়। এরকম না ঘটলে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো, এবং এটা ঘটার জন্য আমরা আমাদের নৈতিক পাপ থেকে মুক্ত হতে পারিনা – “I have indulged in vice,1 contract a disease, a doctor cures me, the odds are that I shall repeat the vice. Had the doctor not intervened, nature would have done its work, and I would have acquired mastery over myself, would have been freed from vice, and would have become happy. (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৬৩) গান্ধীর এই বিশেষ বক্তব্যের মাঝে আশিস নন্দী আধুনিক পরিভাষায় যাকে ইংরেজিতে বলা হয় iatrogenicity (induced inadvertently by a physician or surgeon or by medical treatment or diagnostic procedures অর্থাৎ, ডাক্তার, সার্জন বা ডায়াগ্নোসিসের বা যান্ত্রিক-প্রযুক্তিগত ত্রুটির জন্য রোগীর মৃত্যু) তার বিরোধী অবস্থান দেখেছেন। এবং এটা পূর্ণত অসঙ্গতও নয়।
অস্যার্থ, দেহ হচ্ছে প্রকৃতির একটি সীমায়িত রূপ। এখানে গান্ধীর বোধে প্রকৃতি ও দেহের মধ্যে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং ভারসাম্যের অবস্থান আছে তাকে অস্বীকার করে কোন ওষুধ বা অন্য কোন উপকরণ (যা নিতান্তই প্রাকৃতিক নয়) প্রবেশ করানো চলবেনা। এখানে আমরা একটু ভালো করে নজর করতে পারি যে এরকম এক ধারণা ভারতীয় আয়ুর্বেদে অলঙ্ঘনীয়ভাবে বিদ্যমান ছিলো। আয়ুর্বেদে প্রকৃতি তথা “মহাবিশ্ব” (macrocosm) এবং মনুষ্যদেহ তথা “অণুবিশ্ব”-র (microcosm) মাঝে রক্ষিত ভারসাম্যের তাত্ত্বিক ধারণা নিয়েই চিকিৎসার অভিমুখ নির্ধারিত হয়েছে। এজন্য চরক সংহিতা-র সূত্রস্থানের ৮ম অধ্যায়ে রয়েছে – “মঙ্গলাচারশীল স্যাৎ”। বলা হয়েছে – “সর্ব্ব প্রাণীষু বন্ধুভূতঃ স্যাৎ”। (“মানুষ তুমি, সর্বদা মঙ্গলাচার যুক্ত হবে। সকল প্রাণীর সাথেই বন্ধুর মতন ব্যবহার করবে”।) গান্ধীর ৯৮ খণ্ডে প্রকাশিত বিপুল রচনাসম্ভারের মধ্যে একবার বা দু-বার চরকের উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া কখনও কোথাও আয়ুর্বেদের মূল টেক্সটের কোন উল্লেখ নেই। যা নিয়ে কথা বলেছেন তাহল ফলিত আয়ুর্বেদচর্চা যেগুলো গান্ধীর দেখা বৈদ্যরা করছে তিনি তাদের ভুলভ্রান্তি, অর্থ নিয়ে নিম্নধরনের আকাঙ্খা ইত্যাদি নিয়ে অপছন্দ ও বিরাগ ব্যক্ত করেছেন তীব্র ভাষায়। তাহলে মানুষ-প্রকৃতি ভারসাম্য রক্ষা করে চিকিৎসার বোধ এবং বোধি গান্ধী পেলেন কোথায়? পেয়েছেন ইউরোপীয় লেখকদের লেখায়, ভারতীয় দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রের মাঝে নয়। চরক সংহিতাতে বলা হয়েছে –
সমদোষঃ সমাগ্নিশ্চ সমধাতু মলক্রিয়ঃ । প্রসন্নাত্মেন্দ্রিয় মনাঃ স্বস্থ ইত্যভিধীয়তে ।। (যার ত্রিদোষ, অগ্নিবল, সপ্তধাতু ও মল ক্রিয়া অবিকৃত, এবং যার ইন্দ্রিয়সমূহ ও মন প্রসন্ন তাকেই সুস্থ বা স্বস্থ বলা হয়।)
মন এবং দেহের যুগ্ম সুস্থতায় এবং আনন্দের মাঝে প্রকৃত স্বাস্থ্য আছে এরকম ধারণা গান্ধী বারংবার ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তাঁর ধারণার উৎস দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতীয় নয়, ঘোষিতভাবে ইউরোপীয় লেখকদের কাছ থেকে আহরণ করা।
১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ (বা বলা ভালো যে গ্রন্থে তিনি তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ে এবং কিছু কিছু পর্যায়ে দেহ, স্বাস্থ্যরক্ষা, মেডিসিন, চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে যেসব ধারণা ব্যক্ত করেছেন সেসবের সংকলিত চেহারা) Key to Health-এ বলছেন – “The human body is the universe in miniature.” (p. 7) ঠিক যে কথাটি আয়ুর্বেদের তাত্ত্বিক ভিত্তিতে আমরা দেখেছি। কিন্ত তিনি একধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেন – “That which cannot be found in the body is not to be found in the universe.” দার্শনিক যুক্তির বিচারে এরকম মন্তব্য কম বিপজ্জনক নয়। দেহ যদি মহাবিশ্বের অতিক্ষুদ্র প্রতিরূপ হয় তাহলে দেহকে বর্ধিত করলে মহাবৈশ্বিক প্রতিরূপ নেবে যৌক্তিকভাবে আদৌ এটা সম্ভব নয়। এর মাঝে logical fallacy বা হেত্বাভাস এবং tautology বা দ্বিরুক্তি-দোষ রয়েছে। দেহে যা পাওয়া যাবেনা মহাবিশ্বেও তা পাওয়া যাবেনা এরকম একটি অবস্থান তখনই নেওয়া সম্ভব যখন দেহ-অতিরিক্ত কোন দৈবী শক্তির উপস্থিতিী একেবারে গোড়াতে মানুষের অস্তিত্বে আমরা স্বীকার করে নিই। আর যদি এটাকে যৌক্তিকভাবে গ্রহণ করা হয় তাহলে মানবসত্তা আর স্বরাট বা autonomous থাকেনা – একান্তভাবে ঈশ্বর বা নিয়তি-নির্ভর হয়ে পড়ে তার অস্তিত্ব। ব্যক্তি মানুষের স্বাধীন, একক সত্তার অস্তিত্ব ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এবং তত্ত্বগত বিচারে গান্ধীর চিন্তায় সম্ভবত অনুপস্থিত। তার চেতনায় কাজ করে কৌম এবং যূথের ধারণা।
আমরা পরবর্তীতে দেখবো গান্ধীর দেহ ও স্বাস্থ্য নিয়ে যে চিন্তন প্রক্রিয়া তাঁর লেখায় ধরা পড়েছে তা প্রায় সর্বাংশে আয়ুর্বেদের তাত্ত্বিক ধারণায় আছে, এবং তা প্রয়োগও হয়েছে ভারতবর্ষে ধারাবাহিকভাবে। সম্ভবত তিনি আয়ুর্বেদের ক্ল্যাসিকাল টেক্সট পড়েননি বলে ঋণ স্বীকার করতে হয়েছে ইউরোপীয় লেখকদের কাছে। আবার আয়ুর্বেদের দুর্বল ফলিত প্রয়োগ দেখে তীক্ষ্ণস্বরে তিরস্কারও করেছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করবো যে ১৯শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সেসময়ে আধুনিক মেডিসিনের যে heroic চেহারা ছিল – ক্রমাগত রক্তমোক্ষণ, জোঁক লাগানো, অ্যানেস্থেসিয়া-পূর্ব ভয়াবহ বেদনাদায়ক সার্জারি, ত্বকে ব্লিস্টার তৈরি করা এবং আরও অনেককিছু – সে চেহারা সংবেদী মানুষ এবং সাধারণ রোগীদের এক উল্লেখযোগ্য অংশকে এর থেকে মুক্তির রাস্তায়, বিকল্পের সন্ধানে যেতে বাধ্য করেছিল। স্মরণে রাখবো এরকম সময়ে আধুনিক তথা ইউরোপীয় মেডিসিনের তথাকথিত “heroic remedies” থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে হোমিওপ্যাথি এবং হ্যানিম্যানের অভ্যুদয়।
ঐতিহাসিকভাবে আধুনিক মেডিসিনের উদ্ভব এবং সর্বাধিক প্রয়োগ হয়েছিল ইউরোপে। ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মে ইউরোপেই আধুনিক মেডিসিনের হৃদয়হীন, আগ্রাসী চেহারার, এমনকি জ্ঞানতাত্ত্বিক যুক্তিকাঠামোর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিক্রিয়া এবং তাত্ত্বিক প্রতিরোধও সর্বাধিক হয়েছিল। মজার ব্যাপার হল, সেরকম সময়ে ভারতবর্ষের শিক্ষিত সমাজের এক বিরাট অংশের (জনসংখ্যার তুলনায় অঙ্গুলিমেয়) উচ্চতর শিক্ষার পীঠস্থান ছিল ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ। এজন্য এই শিক্ষিতসমাজ যত সহজে ইউরোপীয় চিন্তাপ্রবাহ রপ্ত করেছেন তত পরিমাণে ভারতীয় টেক্সট পড়েননি, সে ধরনের টেক্সটের সংস্পর্শে আসেননি বা এ জ্ঞানসম্ভারকে রপ্তও করেননি মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তিত্ব ছাড়া। ১৮৪৫ সালে মেডিক্যাল কলেজ থেকে যে প্রথম চারজন ছাত্র উচ্চশিক্ষার্থে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন তাদের একজন ভোলানাথ বোস। পরবর্তীতে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে Indian Medical Service-এর একজন চিকিৎসক হিসেবে পাঞ্জাব অভিযানে অংশগ্রহনও করেছিলেন। তিনি আধুনিক মেডিসিনের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করে ১৮৭৭ সালে দুটি পুস্তক লিখেছিলেন – A New System of Medicine, Entitled Recognizant Medicine; or, the State of the Sick এবং Principles of Rational Therapeutics. ফলে গান্ধী যেসব উৎস থেকে তাঁর যুক্তি এবং দেহ, স্বাস্থ্য (পরিবর্ধিত চেহারায় জনস্বাস্থ্য) ও মর্যালিটির ধারণা সংগ্রহ করেছেন সেগুলো ঐতিহাসিকভাবে মজুত হয়েই ছিল। তিনি ১৯১৩ সালে লিখছেন – “বিগত কুড়ি বছর ধরে আমি স্বাস্থ্যের বিষয়ে ভেবে গিয়েছি”। (র. ১১, পৃঃ ৪২৮) এখানে সেসময়ের বিচারে একটি তীক্ষ্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ছিল তাঁর। তিনি hygiene-কে মেডিসিনের সাধারণ পরিসর থেকে নির্দিষ্টভাবে পৃথক একটি বিষয় বলে বিবেচনা করেছিলেন। (পূর্বোক্ত)
গান্ধীর কাছে ইংল্যান্ড যাত্রার ক্ষেত্রেও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল স্বাস্থ্য – “first and foremost question is the question of health.” (র. ১, পৃঃ ৬৮) ইংল্যান্ডের প্রবাসজীবনে কি খাবেন (অবশ্যই নিরামিষ), কতোটা খাবেন, কিভাবে খাবেন এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ হল, এ আলোচনা করতে গিয়ে বহুক্ষেত্রেই অপরীক্ষিত (unqualified) নিজস্ব ভাবনাকে সাধারণ ধারণা হিসেবে উপস্থিত করেছেন। যেমন ফলের উপকারিতা বোঝাতে গিয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ধারণা কিংবা লোকশ্রুতি থেকে লিখছেন যে ফল রক্ত পরিষ্কার করে এবং ওষুধের বিরুদ্ধে নিশ্চিত প্রতিরক্ষা হল ফল। (র. ১, ৯৫) অপরীক্ষিত এরকম বিশেষ ধারণাকে সার্বজনীন করে তুলে জনসমাজে সার্বিক প্রতিষ্ঠা যথেষ্ট বিপজ্জনক একটি প্রবণতা। এরকম নিজস্ব ভাবনাকে সাধারণ ধারণা হিসেবে উপস্থিত করতে গিয়ে দু-এক ক্ষেত্রে ভুল তথ্যও দিয়েছেন। যেমন তাঁর সংগৃহীত রচনাবলীর ১১শ ও ১২শ এ দুই খণ্ডতে মোট ৩৫ কিস্তিতে “General Knowledge About Health” লিখেছিলেন। সেখানে মানুষের শরীর নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন ডাক্তারদের হিসেব অনুযায়ী ২৩৮টি অস্থি রয়েছে মানুষের শরীরে। (র. ১১, পৃঃ ৪৪৭) তাঁর এ হিসেব অনেকটা সুশ্রুত সংহিতা-র কাছাকাছি আসে। অথচ আধুনিক অ্যানাটমির জ্ঞান আমাদের জানায় মনুষ্য শরীরে মোট অস্থির সংখ্যা ২০৬-২০৮-এর মাঝে। এরকম আরেকটি ভুল এবং অদ্ভুত মন্তব্য করেছেন গুটি বসন্ত (small pox) নিয়ে। তাঁর ধারণায় অন্যান্য অসুখের মতো গুটি বসন্তের ক্ষেত্রেও রোগের উৎপত্তি দূষিত রক্ত থেকে – “The body throws out accumulated poison by way of eruptions.” (র. ১২, পৃঃ ১১০) এরকম উক্তি এবং বক্তব্য একধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রাধান্যের (epistemological dominance) দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। আরেককটু গভীরে নজর করলে অনুমান করা অসম্ভব নয় এরকম চরিত্রের জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রবণতা জনমানসে গুজব তৈরির সম্ভাবনাও বহন করে – এরকম সম্ভাবনা সুপ্ত থাকে, উপ্ত থাকে। শীতলা পুজো, গুটি বসন্ত এবং জনমানসের ধারণার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে গভীরে বোঝার জন্য Ralph W. Nicholas-এর “The Goddess Sitala and Epidemic Smallpox in Bengal” প্রবন্ধটি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নিকোলাসের প্রবন্ধ আমাদের সাহায্য করবে বুঝতে জনমানসে এই রোগ সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাস ও নিরাময়ের চেষ্টার মাঝে কত স্তর থাকে। গান্ধীর গুটি বসন্ত সম্পর্কে ধারণা এবং জনমানসের প্রচলিত বিশ্বাস এ দুয়ের মাঝে আমরা সাযুজ্য খুঁজে পাবো।
গুরুত্বপূর্ণ হল গান্ধী ১৯১৩ সালে যখন এ ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে একজন প্রতিষ্ঠিত জননেতা। তাঁর প্রতিটি কথার গুরুত্ব রয়েছে জনজীবনে। মানুষ শুনছে তাঁর কথা। কিন্তু জনসাধারণ যাতে ভুল না বোঝে এজন্য তাঁকে ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে যে তিনি একজন “Westernized reformer” নন। তাঁকে বলতে হচ্ছে – “There are critics who say that I am an apologist of the Western ways.” এরপরেই যোগ করছেন, “উদাহরণ হিসেবে, আয়ুর্বেদের সম্পর্কে বলা যায় আমি একদা বলেছিলাম যে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আমাদের পশ্চিমকে শেখানোর মতো রয়েছে সামান্যই, যতোটা বেশি রয়েছে শেখার ক্ষেত্রে – “we have far less to teach the West than we have to learn from it.” (র. ২৭, পৃঃ ৪১২) বিষয়টি কি এরকম যে নেচার কিউর-এর জন্য যেসব পশ্চিমী তত্ত্বের কথা তিনি বলেছেন এবং ব্রিটিশ সংবিধান সম্পর্কে তাঁর আনুগত্য ও pax Britanica নিয়ে তাঁর passion জনমানসে যে ধারণার জন্ম দিতে পারে তা দূর করার জন্য তাঁকে এ বক্তব্য স্পষ্ট করে জানাতে হচ্ছে। আবার গুটি বসন্ত নিয়ে লৌকিক ধারণাকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিতে হচ্ছে?
আমজনতার ধারণায় গুটি বসন্ত নিয়ে রয়েছে দেহ-অতিরিক্ত দৈবী শক্তির ধারণা – বাংলায় শীতলা পুজো। গান্ধীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী রোগের পরিসর ও বিস্তার দেহাভ্যন্তরে হলেও আধুনিক চিকিৎসার contagious চরিত্রের অনেকদূরে রইলো তাঁর ব্যখ্যা। প্রায় হুবহু একথাই তিনি বলেওছেন তাঁর A Guide to Health (1921) পুস্তকে। শরীরের অভ্যন্তর দূষিত হবার এবং গুটি ফুটে ওঠার যে তত্ত্ব তিনি দিয়েছেন তার প্রেক্ষিতে বলেছেন – “If this view is correct, then there is absolutely no need to be afraid of small-pox.” (p. 105) কার্যত লৌকিক ধারণারই একটি পরিশীলিত রূপ হল তাঁর এই ব্যখ্যা – যেখানে শীতলার পরিবর্তে দেহাভ্যন্তর দূষিত হবার কার্য-কারণ সম্পর্ক আছে। গুটি বসন্তের টীকা নিয়েও তিনি তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁর পর্যবেক্ষণে – “Vaccination seems to be a savage custom. It is one of the poisonous superstitions of our times the equal of which is not to be found among so-called primitive societies.” (র. ১২, পৃঃ ১১১) এরপরেই বলছেন – “Vaccination is a filthy remedy … I personally feel that in taking this vaccine we are guilty of a sacrilege.” (পূর্বোক্ত) আমরা একটু আগেই মানবসত্তার অস্তিত্বে যে দৈবীশক্তি বা divine power-এর কথা বলেছি তার সাথে মেলে “গিলটি অব আ স্যাক্রিলেজ” বা “অপবিত্রকরণের দোষে পাপী” এই শব্দবন্ধটি।
প্রশ্ন আসবে গুটি বসন্তের টীকার এরকম তীব্র বিরোধিতার তাত্ত্বিক ভিত্তি কি একান্তভাবেই গান্ধীর নিজস্ব বৌদ্ধিক জগৎ থেকে নির্মিত হচ্ছে? আমার স্পষ্ট উত্তর হচ্ছে – না। এখানেও ১৯শ শতকের ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হবে, ফিরে দেখতে হবে অ্যান্টি-ভ্যাক্সিনেশন বা টীকাবিরোধী আন্দোলন কিভাবে জন্ম নিচ্ছে এবং বিকশিত হচ্ছে ও কোন পরিণতিতে পৌঁছুচ্ছে সে বিষয়টি। অ্যান বেক (Ann Beck) সুখ্যাত জার্নাল Medical History-তে ১৯৬০-এর অক্টোবর মাসে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন “Issues in the Anti-Vaccination Movement in England”। এ প্রবন্ধে প্রবন্ধকারের পর্যবেক্ষণ ছিল – “What makes this phase in the history of British vaccination so interesting is the fact that those who wrote about vaccination, the doctors who practiced it, the officials who administered the laws, and the public that was subjected to it, were influenced in their attitudes by their political views, by religious convictions, by their own interpretations of medical theories, by dogmatic views on sanitation and by their acceptance or rejection of the new science of bacteriology.” আমরা একটু ভালো করে নজর করলে দেখবো একথাগুলো কি অদ্ভুতভাবে মিলে যায় গান্ধীর টীকাবিরোধী অবস্থানের সাথে – রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ, ধর্মীয় বিশ্বাস, নিজের মতো করে মেডিসিনের তত্ত্বের ব্যাখ্যা, স্যানিটেশন সম্পর্কে গোঁড়া ধারণা এবং রোগের জীবাণু তত্ত্বের বিরোধিতার মতো সমস্ত উপাদানই ছিল গান্ধীর চিন্তার জগতে এবং বৌদ্ধিক অবস্থানে।
এডোয়ার্ড জেনারের টীকা আবিষ্কারের পরে (১৭৯৮) ইংল্যান্ডে চালু হল প্রথম Vaccination Act (1840) – দরিদ্র এবং সমাজবিরোধীদের জন্য বিনামূল্যে টীকার ব্যবস্থা হল। ১৮৫৩-র ভ্যাক্সিনেশন অ্যাক্টে শিশুদের টীকা বাধ্যতামূলক করা হল। ১৮৬৭-তে টীকাকে সর্বস্তরের জনসাধারণের (১৪ বছরের বেশী) জন্য বাধ্যতামূলক শুধু করা হল না, না মানলে শাস্তির ব্যবস্থাও রাখা হল। ১৮৫৩-র পর থেকে এ আইনের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের বহু শহরে (বিশেষ করে শিল্পাঞ্চল সমৃদ্ধ ম্যানচেস্টারে) তীব্র হিংসাত্মক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। টীকা-বিরোধীদের প্রধান আপত্তি ছিল “infringement of personal liberty and choice”-এর ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, বাধ্যতামূলক টীকা ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একটি গণতান্ত্রিক দেশে ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তির পছন্দ এবং সিভিল লিবার্টির গোড়ায় আঘাত করছে – “These laws were a political innovaton that extended government powers into areas of traditional civil liberties in the name of public health.”। এজন্য এই অ্যাক্টগুলোর প্রতিবাদে দাঙ্গা, বিক্ষোভ, প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদ। অবশেষে ১৮৯৮-এ ইংরেজ আইনে “conscientious objector” এ ধারণাটি আনা হল যারা টীকা নিতে চায়না তাদের ক্ষেত্রে। (বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য Robert M. Wolfe and Lisa Sharp, “Anti-vaccinationists past and present”, British Medical Journal, 24 August 2002, pp. 130-32) গান্ধী তাঁর A Guide to Health-এ “conscientious objector” এ শব্দবন্ধটি (ধারণা নয় কিন্তু) ব্যবহার করছেন। এমনকি ওদেশে যে Anti-Vaccination Society গঠিত হয়েছে সে ব্যাপারেও সম্যক অবহিত ছিলেন এমনটা বোঝা যায়। (A Guide to Health, পৃঃ ১০৮) কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সিভিল লিবার্টির বিষয়টি পরাধীন, উপনিবেশিক ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে একেবারে ছেঁটে ফেললেন – হয় সজ্ঞানে, ভেবেচিন্তে যাতে pax Britanica বা তাঁর তীব্র আবেগের জায়গা ব্রিটিশ সংবিধান আক্রান্ত না হয়, কিংবা না বুঝে। আমার মনে হয় প্রথমটিই সত্যি। এর স্বপক্ষে যুক্তি হল ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষ যখন ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রশ্নে, সিভিল লিবার্টির প্রশ্নে টীকা দেবার প্রবল বিরোধিতা করছে, সেসময় গান্ধী টীকার কুফলের গোটা বিষয়টিকে অন্যত্র স্থাপন করলেন – “it is only the self-interest of doctors that stands in the way of the abolition of this inhuman practice, for the fear of losing the large incomes that they at present derive from this source blinds them to the countless evils which it brings.” (A Guide to Health, p.110) এ বক্তব্যের দরুন যেকোন ব্যক্তির এরকম মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে যে যেন টীকা দেবার মতো, গান্ধীর ভাষায়, “savage custom”, “filthy remedy” এবং “poisonous superstitions of our times”-এর মারাত্মক রীতিটি কেবলমাত্র ডাক্তারদের লোভ এবং বিপুল অর্থাগমের অনুকূল বলে রদ হচ্ছেনা, বহাল তবিয়তে টিকে আছে। অথচ “করাচি প্রাদেশিক কনফারেন্স”-এ পাঠানো মেসেজের প্রথম বাক্যটিই শুরু করছেন এভাবে – The resolution on fundamental rights is the most important resolution of the Congress. (র. ৪৭, পৃঃ ১৬৬)
কার্যত টীকা নিয়ে মতামত দেওয়া এবং কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্মসূচীর ক্ষেত্রে গান্ধীর নিজের অবস্থান জানানো এ দুয়ের মাঝে যুক্তির ক্ষেত্রে একটি প্যারাডাইম শিফট (paradigm shift) হয়ে গেল। নেতির দিকে না ইতির দিকে সেটাই হল মূল বিবেচ্য প্রশ্ন। যে নাগরিক অধিকার বা সিভিল লিবার্টি গান্ধী তথা কংগ্রেসের আন্দোলনের প্রধান ভিত্তি সেটাকে কেবলমাত্র রাজনৈতিক জগতে সীমাবদ্ধ করে ফেললেন। উল্টোটাও তো হতে পারতো – কেন সার্বজনীন টীকাকরণ করা হবেনা এ ইস্যুতে গণআন্দোলন গড়ে তোলার সম্ভাবনাও থাকতে পারতো।
তাহলে গুটি বসন্ত সারবে কি করে? এর সমাধানে গান্ধী যাত্রা করছেন nature cure-এর (Kuhne এবং Just-এর প্রদর্শিত) পথে। কিন্তু সেখানেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। তাঁর নিজস্ব বক্তব্য ও ধারণাও এর সাথে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু আয়ুর্বেদের মতো দেশীয় পদ্ধতির কথা একবারও আসেনি তাঁর আলোচনায়। হুবহু তাঁর লেখাই তুলে দিই – “When small-pox has actually appeared, the best treatment is the “Wet-Sheet-Pack”, which should be applied three times a day. It relieves the fever, and the sores heal rapidly. There is no need at all to apply oils or ointments on the sores. If possible, a mud-poultice should be applied in one or two places.” (A Guide to Health, পৃঃ ১১১) এরপরে প্রায় একদমে জানাচ্ছেন – “Instead of looking upon small-pox as a terrible disease, we should regard it as one of Nature’s best expedients for getting rid of the accumulated poison in the body, and the restoration of normal health.” আমরা এর আগে যে দৈবী শক্তির প্রসঙ্গ আলোচনা করেছি তা আরেকবার জোরদার হল গুটি বসন্তের মতো মারাত্মক, প্রাণঘাতী রোগের ক্ষেত্রেও।
গান্ধী নিজের জীবনে একাধিকবার আধুনিক সার্জারি (যেখানে আধুনিক অ্যানাটমির জ্ঞানের অবদান organ localization of pathology and disease সবিশেষ গুরুত্বসম্পন্ন) এবং মেডিসিনের সাহায্য নিয়েছেন। তাঁর অর্শ এবং অ্যপেন্ডিসাইটিসের জন্য অপারেশন হয়েছিল। ১৯২৭-এ তাঁর “a mild stroke of apoplexy” হয়েছিল। (র. ৩৩, ৪৮৯) তাঁর নিজের বক্তব্য অনুযায়ী আধুনিক মেডিসিনের গ্রহণযোগ্য দিক হচ্ছে এর “spirit of research”। (র. ১৯, পৃঃ ৩৫৮)
আয়ুর্বেদের চিকিৎসকদের পরামর্শ দিচ্ছেন – “Let our Kavirajas, Vaidyas and Hakims apply to their calling a scientific spirit that Western physicians show, let them copy the latter’s humility, let them reduce themselves to poverty in investigating the indigenous drugs and let them frankly acknowledge and assimilate that part of Western medicine which they at present do not possess.” (র. ২৭, পৃঃ ২২৩) এই অবধি বলে আবার সতর্কও করছেন – “Let them shun the irreligion of the Western scientists”। (পূর্বোক্ত) অস্যার্থ, পশ্চিমী মেডিসিনের তথাকথিত “বৈজ্ঞানিক স্পিরিট”-কে গ্রহণ করতে হবে এর আধুনিক, অ্যানাটমির জ্ঞাননির্ভর সেক্যুলার অংশকে বাদ দিয়ে। সে পরিসরে প্রবেশ করবে ভারতীয় তথা হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় অনুষঙ্গ। দ্বিচারিতা না বললেও এ এক অদ্ভুত দ্বৈততা! প্রসঙ্গত, তৎকালীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসা সম্পর্কে তাঁর তীব্র অবজ্ঞা আরেকবার বোঝা যায় – “The only thing Ayurvedic physicians can safely claim is a knowledge of some vegetable and metallic drugs of great potency which some of them succeeded in administering for disease they only guess and, therefore, often with much harm to their poor patients.” (র. ২৭, পৃঃ ২২২-২২৩)
আমার বিচারে আধুনিক মেডিসিন নিয়ে গান্ধীর আপত্তির জায়গা প্রধানত চারটি – (১) জীবদেহ ব্যবচ্ছেদ বা vivisection, (২) “অতিরিক্ত” ওষুধ নির্ভর হবার জন্য আধুনিক মেডিসিন মানুষের দেহকে গুরুত্ব দেয়, আত্মাকে (soul) উপেক্ষা করে, (৩) মেডিসিনে, বিশেষ করে পেটেন্ট মেডিসিনের ক্ষেত্রে, বিজ্ঞাপনের ব্যবহার, এবং (৪) হাসপাতালের ক্রমবৃদ্ধি এবং রমরমা। (র. ১৯, পৃঃ ৩৫৭; ২৭, পৃঃ ২২১-২৩) তাঁর ধারণানুযায়ী অনেক সংখ্যক হাসপাতাল তৈরি হওয়া সভ্য হবার কোন পরীক্ষা নয়, বরঞ্চ ঠিক এর বিপরীত ঘটনা প্রমাণ করে – “It is rather a symptom of decay … The science of sanitation is infinitely more enobling though more difficult of execution, than the science of healing.”
এমনকি হাসপাতালকে পশুদের থাকার জায়গা পিঁজরাপোলের সাথেও তুলনা করেছেন। (র. ১৯, পৃঃ ৩৫৭) “হিন্দ স্বরাজ”-এ বলছেন – “Hospitals are institutions for propagating sin.” (Hind Swaraj, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৬৩) কেন হাসপাতাল তাঁর ভাষায় “পাপের জায়গা”? এ উত্তরও তিনি দিয়েছেন – “Men take less care of their bodies, and immorality increases.” একেবারে জলের মতো সহজ করে ধর্মীয় কোন গুরুর মতো জানালেন যে মানুষ নিজের দেহের ব্যাপারে আগের চেয়ে কম যত্নশীল, এজন্য অনৈতিকতা বেড়ে চলেছে। এরকম এক যুক্তির পরিসরে হাসপাতাল হয়ে উঠছে “পাপের জায়গা”। দিল্লীতে তিব্বি কলেজের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেন – “A clean spirit must build a clean body. I am convinced that the main rules of religious conduct conserve both the spirit and the body.” (র. ১৯, পৃ” ৩৫৭) আমরা চরক সংহিতাতেও তো এরকম মূর্ছনা এবং অর্থই পেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে গান্ধীর মতো এরকম তীব্র ধর্মীয় অনুষঙ্গ ছিলোনা।
কুন এবং জাস্টের কাছ থেকে প্রধানত দুটি বিষয় গান্ধী আহরণ করেছিলেন। একটি হল “mud poultice”, আরেকটি “water bath” বা “wet-sheet packs”। তাঁর বিচারে অসম্ভব সমস্ত কাজ করে এ পদ্ধতিগুলো – mud poultice সাধারণ ফোঁড়া থেকে গুটি বসন্ত, প্রচুর তাপমাত্রার জ্বর থেকে টাইফয়েড ও মাথাব্যথা, কোষ্ঠবদ্ধতা থেকে প্লেগ এবং delirium (ভুল বকা) প্রভৃতি সমস্ত রোগের ক্ষেত্রে – সে মারণান্তক হোক বা সাধারণ হোক – কাজ করে। আবার water bath বা wet-sheet packs কাজ করে গুটি বসন্ত থেকে নিউমোনিয়া সমস্ত ক্ষেত্রেই। (র. ৭৭, পৃঃ ১-৩৮) অর্থাৎ, আধুনিক মেডিসিনের সমস্ত ওষুধ এবং চিকিৎসার ইতি ঘটলো বলা যেতে পারে। গান্ধীর উপলব্ধি – “Knowledge of common household remedies often proves a godsend in many a crisis.” গার্হস্থ্য চিকিৎসা বা home remedies নিয়ে প্রায় ঈশ্বর-প্রদত্ত বস্তু (godsend) ধরনের এ উপলব্ধি বা ধারণাকেই তিনি জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন।
সমগ্র চিকিৎসা যখন common household remedies বা গার্হস্থ্য চিকিৎসায় পর্যবসিত হয় তখন আধুনিক চিকিৎসার প্রাণশক্তি বা লক্ষ্যমুখ আর কি রইলো? আবার, অন্যদিক থেকে দেখলে, ১৯শ শতাব্দীর তৃতীয় দশক এবং ২০শ শতাব্দীর প্রথম দু’দশক বাংলা সহ ভারতের সব প্রধান ভাষাতে, যেমন তামিল, মারাঠী, পাঞ্জাবী ইত্যাদি, গার্হস্থ্য চিকিৎসা ও এর ফলাফল নিয়ে অসংখ্য পুস্তক সাধারণ মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে লেখা হয়েছে। এগুলোর সাথে গান্ধিী প্রবর্তিত পদ্ধতির নির্দিষ্ট পার্থক্য কোথায়, vivisection-এর প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে? উত্তর অস্বচ্ছ, স্বস্তিদায়ক নয় এবং পাঠককে গান্ধীর অনুসৃত পথের সপক্ষে বা স্বমতে আনার পক্ষে যথেষ্টও নয়।
শেষ কথা
গান্ধী তাঁর লেখায় খোলাখুলি জানিয়েছেন যে আয়ুর্বেদের রোগ নির্ধারণের (diagnosis) ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্বাস থাকলেও আয়ুর্বেদের চিকিৎসায় সেরে ওঠার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন, কারণ – “this diagnosis is not checked by a trustworthy practitioner under the Western system.” (র. ২৩, পৃঃ ৩৭১-৭২) অর্থাৎ, ভারতীয় আয়ুর্বেদের সামগ্রিক সাফল্য এবং কার্যকারিতা, তাঁর ধারণানুযায়ী, পাশ্চাত্যের জ্ঞানতত্ত্ব দিয়ে যাচাই হচ্ছে কিনা তার ওপরে নির্ভর করছে। একে কি খুব দেশজ বলা যাবে, যেখানে মৌলিকভাবে চিকিৎসার জন্য হাত পেতেছেন পাশ্চাত্যের নেচার কিউর-এর ওপরে? পাশ্চাত্যের ফিলটার দিয়ে যাচাই হচ্ছে দেশীয় চিকিৎসা। প্রসঙ্গত, হেকিমি চিকিৎসা বা উনানি তিব্বিকে গান্ধী কখনও বিদেশী চিকিৎসা বলেননি। শুধুমাত্র পাশ্চাত্যের মেডিসিনের irreligious চরিত্রকে ধর্ম দিয়ে সংশোধন করে নিতে চেয়েছেন। আশ্চর্যজনক হল অল্টার বা অন্য গবেষকেরা গান্ধীর বোধি ও চেতনায় প্রোথিত মেডিসিন ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে এ অস্বস্তিকর প্রসঙ্গগুলো প্রায় একেবারেই আলোচনায় আনেননি। সমগ্র বিষয়টিকে একটি sublime স্তরে উন্নীত করেছেন।
বিভিন্ন সময়ে তিনি কলকাতার অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ কলেজে, মাদ্রাজের আয়ুর্বেদিক ফার্মাসিতে, দিল্লীতে তিব্বি কলেজের উদ্বোধনে, এমনকি তৎকালীন বাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়ান্সের ছাত্রদের সম্বোধন করে এবং অন্যান্য চিকিৎসা-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছেন। কলকাতার বিশিষ্ট, খ্যাতনামা আয়ুর্বেদ চিকিৎসক গণনাথ সেনের কলকাতার বাইরে গিয়ে রোগী দেখার ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা দক্ষিণা (১৯২০-এর দশকে) নেওয়া নিয়ে ক্ষোভ এবং উষ্মা প্রকাশ করেছেন। সবকটি ক্ষেত্রেই তাঁর বক্তব্যের মূল সুর ছিল – (১) “spirit of research”-এর অভাব, (২) দেশজ মেডিসিনের করুণ অবস্থা, (৩) চিকিৎসার উচ্চমূল্য, এবং (৪) চিকিৎসকদের বিনয়ের অভাব। (র. ১৯, পৃঃ ৩৫৬-৫৮; ২৭, ৪৩-৪৬, ৩৪৪; ৩৩, ২৯০; ৩৪, ১৯৯-২০০;.৭৬, পৃঃ ১৬১-৬২। কেবলমাত্র আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ শিব শর্মার মাঝে তুলনায় খাঁটি চিকিৎসক খুঁজে পেয়েছিলেন – ৭৯, পৃঃ ৪২-৪৩) এমনকি আয়ুর্বেদকে একটি ক্ষেত্রে বিষতুল্যও বিবেচনা করেছেন – “I went on taking Ayurvedic medicines without thinking and had to suffer the consequences. I am now getting rid of the poison.” (র. ৭৯, পৃঃ ৬)
অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, বায়োকেমিক, আয়ুর্বেদ, উনানি তিব্বি ইত্যাদি সমস্ত চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়েই তাঁর অভিযোগ, অমান্যতা এবং ক্ষোভ ছিল। (র. ৫৪, পৃঃ ৩০৫-৬) স্পিরিট অব রিসার্চ বলতে তিনি ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন আমি তাঁর ৮৪ খণ্ড রচনাবলী পড়েও (যদিও রচনাবলী মোট ৯৮ খণ্ড) উদ্ধার করতে পারিনি। কোন আধুনিক ল্যাবরেটরির কথা বলেননি, ব্যবচ্ছেদের বিরোধিতা করেছেন, ওষুধ কিভাবে পরীক্ষিত হবে সে সম্বন্ধে কোন রূপরেখা দেননি। গান্ধী কথিত “spirit of research” কি nebulous বা মহাজাগতিক কোন বিষয়? একমাত্র ক্ষেত্র যেটা আমার চোখে পড়েছে তাহল কুনের mud poultice বা কাদার স্তরকে খানিকটা পরিমার্জন করেছেন ভারতীয় জনতার উপযোগী করে এবং মাটিকে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দিয়ে জীবানুমুক্ত করার কথা বলেছেন। আয়ুর্বেদের সেসময়ের দুর্বল ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে নিতান্ত বিদ্রুপের স্বরে বলছেন – “the mere feeling of the pulse could enable them to understand whether the patient was suffering from appendicitis or some such other disease.” (র. ২৭, পৃঃ ৪৫)
এতটা বিদ্রুপ ক্ল্যাসিকাল আয়ুর্বেদের প্রাপ্য ছিল বলে মনে হয়না আমার। বরঞ্চ তিনি যদি খবর রাখতেন তাহলে দেখতেন প্রধানত পশ্চিমী মেডিসিনের অ্যানাটমি এবং ফিজিওলোজির অনুকরণে ২০শ শতাব্দীর গোড়া থেকেই কলকাতায় গণনাথ সেন, তৎকালীন মাদ্রাজের পণ্ডিত গোপালাচারলু, কেরালায় পি এস ভারিয়ার প্রভৃতিদের নেতৃত্বে “নব্য আয়ুর্বেদ” আলোড়ন বা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আয়ুর্বেদের এই নতুন ভাষা ও প্রকাশ নিয়ে গান্ধী একটি বাক্যও খরচ করেননি। গান্ধীর পূর্বোক্ত লেখার সময়কাল ১৯২৫ সাল। এর প্রায় ১০০ বছর আগে ১৮৩৬-এর ১৭ মার্চ মেডিক্যাল কলেজে আধুনিক মেডিসিনের সঙ্গে এতদিন ধরে ভারতীয় ছাত্রদের এদেশের মেডিসিন শিখে আসার পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে প্রায় হুবহু একই স্বরে তৎকালীন প্রিন্সিপাল ব্রামলে এবং গুডিভ এধরনের কথা বলেছিলেন। এসবের পরে তিনি যখন স্বরাজ নিয়ে কথা বলছেন তখন স্পষ্ট করে বলছেন স্বরাজের প্রকৃত বীজ উপ্ত হয়ে আছে মিউনিসিপাল কাজের মধ্যে, জনস্বাস্থ্যে (র. ৩৪, পৃঃ ১৮৭)। কিন্তু কি ধরনের বীজ – হাইজিন এবং স্যানিটেশনকে বাদ দিয়ে? এর প্রায়োগিক ভিত্তিই বা কি? তাঁর লেখাতেই উত্তর আছে – “Nature-cure treatment brings us nearer to God … Nature-cure treatment means going towards Nature, towards God.” (র. ৭৯, ১৭)
ভারতবর্ষের আয়ুর্বেদে এ দর্শনকেই ভিন্নভাবে তাত্ত্বিক চেহারা দেওয়া হয়েছিল। গান্ধী সেটা গ্রহণ করলেননা। পাশ্চাত্য তাঁকে পূর্ণত প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করল। এ যে এক ঐতিহাসিক সত্য – আমরা এতক্ষণ দেখলাম। নন্দী এবং অল্টার গান্ধীর দার্শনিক অবস্থান থেকে চিকিৎলার অবস্থান ও দর্শন বুঝতে চেয়েছেন। আমি তাঁর চিকিৎসার বোধ থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, আধুনিক চিকিৎসাকে প্রায় সম্পূর্ণত গার্হস্থ্য চিকিৎসায় পর্যবসিত করে দেওয়া যার সাথে লেখাপড়া করা, অধীত বিদ্যা নিয়ে চিকিৎসার কোন যোগাযোগ নেই, সেটা বুঝতে চেয়েছি। বুঝতে চেয়েছি গান্ধীর বোধের মাঝে কিভাবে reductionism কাজ করেছিল। এই reductionism-এর ফলশ্রুতিতে জনস্বাস্থ্যের যে কাঠামো নির্মাণ হবে তাতে গান্ধীর নিজস্ব চিন্তায় সিঞ্চিত ও নিবেদিত সেবাকর্মীরা থাকবে, প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার কোন হাতিয়ার চিকিৎসার অবস্থান থেকে দেখলে কিছুই থাকবেনা – গার্হস্থ্য চিকিৎসা (home remedies) এবং নেচার কিউর ছাড়া।
শেষ কথা হিসেবে বলবো গান্ধী বা নেইপ, কুন এবং জাস্টের মতো নেচার কিউরিস্টরা শুধু নন cellular pathology-র প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত রুডলফ ভির্শ (Rudolf Virchow) ১৮৭৭ সালে বলছেন – “Let us hope that men of science in England also will not fail to examine this most serious question, whether the authority of Science will not be better secured, if it confines itself strictly to its province, than if it undertakes to master the whole view of nature by the premature generalizing of theoretical combinations.” (Virchow, The Freedom of Science in the Modern State, p. vii) রুডলফ ভির্শ-র আরেকটি বিশেষ পরিচয় হয়তো অনেকেই জানেন। সামাজিক মেডিসিন বা সোশ্যাল মেডিসিনের অন্যতম জনক। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি অমর্ত্য সেন থেকে আরও অনেকেই ব্যবহার করেছেন, প্রচুরসংখ্যক গবেষণাপত্রও লেখা হয়েছে এই বিশেষ বক্তব্যটি নিয়ে – “Medicine is a social science, and politics nothing but medicine at a larger scale – মেডিসিন একটি সমাজ বিজ্ঞান, এবং রাজনীতি মেডিসিনের বৃহত্তর পরিসরের রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।” পাঠকেরা নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন কথাগুলো।
ভির্শ রাজনীতি এবং মেডিসিনের আন্তঃসম্পর্ক উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে বুঝিয়েছেন। যেমনটা আমরা গান্ধীর ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রোগ্রাম এবং মেডিসিনের আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখেছি। প্রকৃতির ওপরে মেডিসিন তথা বিজ্ঞানের কর্তৃত্ব নিয়ে দুশ্চিন্তা ভির্শ-র মতো আরও অনেক অনুভবী চিন্তাবিদ তথা চিকিৎসকের মাঝে ছিলো, কেবলমাত্র গান্ধী বা নেচার কিউরের প্রবক্তাদের ক্ষেত্রেই নয়। এ মিথ ভুলে যাওয়া ভালো।
বড় বিশ্লেষণ ধর্মী সুন্দর আলোচনা করেছেন এই প্রবন্ধে ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্বন্ধে গান্ধীজির বোধ, ব্যক্তিগতভাবে সেবায় আত্মনিয়োগ, পড়াশোনা এবং ভাবনার প্রকাশ যেভাবে আমাদের সামনে পেশ করেছেন তাতে গান্ধীজির চিন্তাধারার আরেকটি দিক, যেটা অন্ততঃ আমার অজানা ছিল, তা জানতে পারলাম।
কিছু ক্ষেত্রে তাঁর মতে কিছু বৈপরীত্য থাকলেও, তাঁর ভাবনা স্বচ্ছ ছিল এবং পশ্চিমী চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতিকূল ছিল না। বৈপরীত্য কিছু থাকবেই কারণ ঐ সময়েই পশ্চিমী আধুনিক চিকিৎসা ভারতীয় সনাতন চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সরিয়ে ভারতীয়দের আস্থা অর্জন করছে।
ধন্যবাদ ডঃ জয়ন্তকে এমন একটি প্রবন্ধ আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।