রকার্ল মার্ক্স তাঁর ‘ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম’-এ লিখেছেন, ‘বিপ্লবের পরে আমাদের যে সাম্যবাদী সমাজ গড়ার কাজে হাত দিতে হবে তা আপন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকবে না, বরং যে ধনতান্ত্রিক সমাজের গর্ভ থেকে তার জন্ম, সেই পুরানো সমাজের অর্থনৈতিক, নৈতিক ও বৌদ্ধিক জন্মদাগ বহন করবে।’ প্যারি কমিউন ৭২ দিনের বেশী টেকেনি, মার্ক্স তাই অংশ নিতে পারেননি সাম্যবাদী সমাজগঠনের প্রক্রিয়ায়। তবে তাঁর মৃত্যুর ৩৪ বছর পর দুনিয়ার প্রথম শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র তার পুরানো সমাজের জন্মদাগগুলো একে একে মুছে ফেলে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ স্বাস্থ্যকে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের অন্যতম হাতিয়ার বানালো লেনিনের নেতৃত্বে।
১৯১৪ সালে বিশ্বের স্থলভাগের এক ষষ্ঠাংশে প্রায় সাড়ে সতেরো কোটি মানুষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনাধীন ছিল। কৃষিপ্রধান দেশ, মাত্র লাখ বিশেক শিল্পশ্রমিক। মেরেকেটে যে দেড়কোটি মানুষ শহরাঞ্চলে বাস করত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই তাদের একটা বড় অংশ গ্রামে ফিরে গেল। হাজার জনসংখ্যা পিছু জন্মহার ৪৫.৬, মৃত্যুহার ২৯.৪, শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২৬০, গড় আয়ু ৩২ বছর। দেশে ডাক্তারের আকাল, সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা অস্তিত্ববিহীন, চিকিৎসা মানেই ফেলো কড়ি, মাখো তেল। ১৫ লক্ষ মানুষের যৌনরোগ, সেনাদের প্রতি দশজনে একজনের টিবি। কুষ্ঠ, কলেরা, ম্যালেরিয়া, প্লেগ, ট্র্যাকোম্যাটোসিস, গুটিবসন্ত, টাইফাস- সব রোগের মহামারী লেগেই থাকত সারাবছর। অথচ স্বাস্থ্যে জারের বরাদ্দ ছিল মাথাপিছু ৯১ কোপেক মাত্র। পশ্চিমের চেয়ে পূবের হাল আরো খারাপ, হাজার জনপিছু একটা করে হাসপাতালের শয্যা, ৫৬৬৫ জনপিছু একজন ডাক্তার। পুরুষদের একটা বড় অংশ মদ্যপানে আসক্ত; অদক্ষ শ্রমিকদের বারো আনাই হয় মহিলা, নয় শিশু। ঘিঞ্জি শ্রমিক বস্তিতে পানীয় জলের একমাত্র উৎস রাস্তার কল। কারখানাতেও চিকিৎসার কোন বালাই নেই। ১৯০৩-এর হিসেব, মস্কোতে মাত্র দশটা কারখানার নিজস্ব হাসপাতাল ছিল ২ থেকে ২৬ শয্যার, মাত্র ২৭৪-টিতে টিমটিম করে চলা ডিসপেন্সারি।
যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীর বর্ধিত খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে অসামরিক জনসাধারণের ভাঁড়ারে আরো টান পড়ল, কৃষকরা প্রতিবাদে চাষ বন্ধ করে দিল, ফলে মূল্যবৃদ্ধি চরমে উঠল ১৯১৭-র প্রথমার্ধে। ট্রটস্কি লিখছেন, ‘চিনি ও রুটি সরবরাহের জন্য কার্ড চালু করেছিল আগের সরকার, মস্কোর বহু বেকারিতে ঝাঁপ ফেলে দিয়েছিল।’ মস্কোর কারখানাগুলোতে সেসময় শ্রমিকদের মজুরির অর্ধেক খরচ হয়ে যেত খাবার কিনতে। খাবার বলতে চা আর রুটি, যা থেকে মোট ক্যালোরি গ্রহণের ৫৫ শতাংশ আসত। বার্ষিক রোজগারের ৮ শতাংশ খরচ হত চা কিনতে।
যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশে প্রাক-বিপ্লব এই অবস্থার মধ্যেই ১৯১৭-এর নভেম্বরে দুনিয়া কাঁপানো সেই দশ দিনে জার ও তার কেরেনস্কি সরকারের পতনের পর সদ্যজাত সোভিয়েতের সামনে দেখা দিল নতুন চ্যালেঞ্জ। একদিকে তখনো নানা স্থলখন্ডে ঘাঁটি গেঁড়ে বসে আছে ফরাসী, জাপানী, মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনা, শুরু হয়েছে শ্বেতসন্ত্রাস ও গৃহযুদ্ধ, উদ্বাস্তু ও পরিযায়ী সমস্যা, তীব্র খাদ্যসংকট, অন্যদিকে নানান সংক্রামক রোগের মহামারী। শুধুমাত্র টাইফাসেই ২৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে ১৯১৮ থেকে ১৯২৫-এর মধ্যে। ঐসময় হাজারে ১.৮ জনের টিবি হত বছরে লন্ডনে, আর মস্কোতে ৪.৬ জনের। ভরসা বলতে পশ্চিমে রাশিয়ান রেড ক্রস আর পূবে রাশিয়ান রেড ক্রেসেন্ট। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর ফলে জনসংখ্যা ১৯২১-এ নেমে এল ১৪ কোটির নীচে। রেড আর্মির হাতে পর্যাপ্ত গজ, ব্যান্ডেজ, ওষুধ নেই, শয়ে শয়ে সেনা মারা যাচ্ছে। সাবান, জীবাণুনাশক বাড়ন্ত। ১৯১৪ থেকে ১৯২০ – সাতবছরে দশ হাজার চিকিৎসক মারা গেলেন। টাইফাসে মৃত্যুর হার যুদ্ধের আগে ছিল ১০.৫ শতাংশ, পরে বেড়ে হল ১৬.৭ শতাংশ।
১৯০৩ সালে বলশেভিক পার্টির কর্মসূচীতে তারা ক্ষমতায় এলে কী কী করবে লেখা হয়েছিল, ‘কাজের সময় দৈনিক সর্বাধিক আট ঘন্টা, বছরে ৪২ দিন ছুটি, অত্যাবশ্যক ক্ষেত্র ছাড়া নৈশকালীন কাজ নিষিদ্ধকরণ, ষোল বছরের নীচে শিশুশ্রম নিষিদ্ধকরণ, আঠারো বছর অব্দি দৈনিক কাজের সময় সর্বাধিক ছ’ঘন্টা, বিপজ্জনক কাজে মহিলাদের নিয়োগে নিষেধ, ১০ সপ্তাহ সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি, কর্মক্ষেত্রে ক্রেশ, অসুস্থতায় বিনামূল্যে ওষুধ ও সবেতন ছুটি, শিল্পক্ষেত্রে সরকারী নজরদারী।’ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হল বিপ্লবের পঞ্চম দিনে, ১৯১৭ সালের ১৩-ই নভেম্বর ডিক্রী জারি করে বীমার আওতায় আনা হল গ্রাম ও শহরের সমস্ত ওয়েজ ওয়ার্কারদের। বীমার রাশিকৃত অর্থভান্ডারে থাকল শ্রমিক-কৃষকদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। বীমার অঙ্ক উপলব্ধ হল যে কোন ধরণের অসুস্থতায়, পঙ্গুত্বে, মাতৃত্বে, বৈধব্যে, বার্ধক্যে, অনাথত্বে, কর্মনাশে ও বেকারত্বে। পঙ্গুত্বে ও বেকারত্বে পূর্ণ ক্ষতিপূরণের বন্দোবস্ত। সরকার ঘোষণা করল সুস্থ সমাজের জন্য চাই স্বাস্থ্যবান মানুষ; স্বাস্থ্য প্রত্যেক মানুষের জীবনের অন্যতম সম্পদ, তাকে রক্ষা করা ও উন্নত করা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ১২০ ধারায় বলা হল, ‘সোভিয়েতের নাগরিকদের বয়সকালে, অসুস্থতায় বা কর্মহীনতায় বস্তুগত নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে এবং তা রাষ্ট্রীয় খরচে শ্রমজীবী ও কর্মচারীদের সামাজিক বীমার বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সহায়তা এবং মেহনতী মানুষের ব্যবহার্য্য স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে।’
চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী সব বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে ১৯১৮-র ফেব্রুয়ারিতে পেত্রোগ্রাদে কাউন্সিল অব মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্টস স্থাপন করা হল। তবে তার কাজ সাময়িক থমকে যায় টাইফাস মহামারী, গৃহযুদ্ধ ও প্রতিবিপ্লবীদের অন্তর্ঘাতের জন্য। কিছুটা সামলে উঠেই আবার শুরু হল জনস্বাস্থ্য বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম, পাশাপাশি পরোক্ষভাবে যে বিষয়গুলো জনস্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে সেই বিষয়ক নীতিনির্ধারণেও ভূমিকা নিতে সক্ষম, যা একদিকে প্রশাসনিক স্তরে প্রশস্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের এবং আঞ্চলিক ও স্থানীয় এজেন্সীগুলোর স্বশাসন, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারও সুনিশ্চিত করবে, এমন একটা কেন্দ্রীভূত, সুসমন্বিত কর্তৃপক্ষ গঠনের চিন্তাভাবনা। এই ভাবনা অনুসারে জুলাই মাসে গঠিত হল জনস্বাস্থ্য কমিশারেট, তার প্রথম কমিসার হলেন নিকোলাই আলেকজান্দ্রোভিচ সেমাস্কো, যিনি ১৮৯৩ সালের পার্টিসভ্য। পার্টি নেতৃত্বের আস্থাভাজন সেমাস্কোকে বলা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায়, পরিচালনায় ও ব্যয়ে এক স্বতন্ত্র, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে যা প্রতিটা শ্রমিক-কৃষক পরিবারের কাছে বিনামূল্যে অধিগম্য হবে, তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে, তাদের কাছে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, বিজ্ঞাননির্ভর ও স্থানীয়ভাবে লভ্য প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হবে। ১৯২১ সালের কাউন্সিল অব পিপলস্ কমিশার্স আর্টিকল ১-এ বলা হয়েছে জনস্বাস্থ্য কমিশারেট ‘জাতির স্বাস্থ্যের সার্বিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ও স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর যা কিছু তার বিলোপ সাধনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সবরকম বিধি প্রণয়ন ও আরোপের বিষয়ে, জনগণের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত’।
বিপ্লবের পরের মাসে এক বলশেভিক স্বাস্থ্যকর্তার স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে লেখা হল, ‘যুদ্ধ, বেহাল অর্থনীতি, ক্ষয়িষ্ণু জনসংখ্যা এবং তার অন্যান্য ফলশ্রুতিগুলো শ্রমিক-কৃষকের সরকারের সামনে জনগণের বৃহত্তর অংশের জীবনযাপনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, রোগভোগ ও মৃত্যুর সঙ্গে দেশজুড়ে লড়াইয়ের প্রশ্নকে তুলে ধরেছে। আবাসন, শিল্পতালুক ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যবিধির নজরদারী, জল সরবরাহ ও জাতীয় নদী-খাল খননের জন্য বিস্তৃত ও সার্বিক আইন প্রণয়ন জরুরী। জনগণের রোগভোগ ও মৃত্যু, বিশেষতঃ শিশুমৃত্যু, টিবি, সিফিলিস ইত্যাদি ছোঁয়াচে রোগের সঙ্গে লড়তে ও জনগণকে স্বাস্থ্যকারক ও স্বাস্থ্যবিধিসম্মত আশ্রয় দিতে গেলে বেসরকারী কব্জায় থাকা ফার্মাসি ও ওষুধ শিল্পকে সরকারের হাতে নিয়ে আসতে হবে।’
লেনিন ‘বলশেভিকরা কি রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে?’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘সর্বহারার রাষ্ট্রের হাতে, সার্বভৌম সোভিয়েতের হাতে খাদ্যশস্যের একচেটিয়া অধিকার, রুটির সংভরণ এবং লালফৌজে বাধ্যতামূলক নিয়োগই হবে হিসেবরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী পদক্ষেপ … সেই পদক্ষেপ, যা রাষ্ট্রযন্ত্রকে গতিশীল রাখার জন্য অদ্যাবধি ইতিহাসে অভূতপূর্ব ক্ষমতা দিতে পারে। … মোদ্দা কথা হল শোষিত মেহনতী মানুষকে তাদের নতুন শক্তির উপর দাঁড়িয়ে এই আত্মবিশ্বাস যোগাতে হবে, কাজের দ্বারা প্রমাণ করতে হবে যে তারা গরীব মানুষের স্বার্থে রুটি, সবরকমের খাদ্য, দুধ, জামাকাপড়, আবাসন ইত্যাদির সর্বাধিক কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও সুসংগঠিত বন্টন করতে সক্ষম এবং তাদের এটা করতেই হবে, না করতে পারলে রাশিয়াকে পতন ও ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না।’
সেপ্টেম্বর ১৯১৮-তে স্তনদাত্রী মায়েদের বাড়তি রেশন ও পাঁচবছরের নীচে সমস্ত শিশুদের দুধ ও খাবার সরবরাহের দায়িত্ব নিল রাষ্ট্র। ১৯১৯, জুনে লেনিন ডিক্রী জারি করলেন এই মর্মে যে শিশুদের খাওয়ানো জাতির অগ্রাধিকার, তাই সরকারী শিশুপোষণ কর্মসূচীর বয়ঃসীমা বাড়িয়ে ষোল বছর বয়স অব্দি করা হল। সমস্ত স্কুলে, কারখানায়, রেলস্টেশনে কমিউন ডাইনিং সেন্টার খোলা হল। দুধ সরবরাহ বাড়ানো হল একবছরের কমবয়সীদের জন্য। ডিসেম্বরে পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে লেনিন বললেন, ‘খাদ্যসংকট এই মুহূর্তে আমাদের সব সংকটের মূলে এবং যুদ্ধ পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি দেখামাত্রই খাদ্য উৎপাদনে আমাদের যথাসম্ভব শক্তি ব্যয় করতে হবে, কেননা ওটাই সবকিছুর ভিত্তি।’ ঐমাসের শেষদিকে রোগীর পথ্যের ও বড় পরিবারগুলোর রেশন বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হল। জোর দেওয়া হল প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয়। ১৯২০ সালের মধ্যে তুর্কমেনিয়ার মত জায়গাতেও ১০৮-টি মিল্ক কিচেন খোলা হয়েছিল।
ফেব্রুয়ারি ১৯১৮-তে লালফৌজে ও অসামরিক জনগণের মধ্যে টাইফাসে মৃত্যু ছিল যথাক্রমে ৬৬,১১৩ ও ৩,৮৯,৮৫৪, পরের বছর এপ্রিলে তা কমে যথাক্রমে ১৬,৫০৫ ও ১,৫৮,৩০৮-এ দাঁড়াল। ১৯১৯-এর শুরুর দিকে সারাটভে স্থাপিত হল রিজিওনাল ইন্সটিটিউট ফর মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড এপিডেমিওলজি ইন সাউথ ইস্ট রাশিয়া’, যেখান থেকে এপিডেমিওলজিস্টদের ছোট ছোট দল মহামারীর খবর এলেই অকুস্থলে ছুটে গিয়ে তথ্যসংগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণের কাজে লেগে পড়ে। এপ্রিল থেকে গুটিবসন্তের টীকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হল, জেলা, গ্রাম, মিলিটারি ব্যারাক, কারখানা সমস্ত স্তরে কমিটি গঠন করে তাদের দিয়ে ব্যাপকতম স্বাস্থ্য-সচেতনতার প্রচার শুরু হল পোস্টার, দেওয়াল-লিখন, লোকসংস্কৃতিকে মাধ্যম করে। ১৯২০-র মার্চ থেকে জনস্বাস্থ্য কমিশারেট স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম চালু করল, টিবি আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের উপর বিশেষ নজর দিয়ে। ঐবছরেই ম্যালেরিয়ার মহামারী মোকাবিলায় ক্যুইনাইনকে করমুক্ত করা হল এবং মস্কোতে স্থাপিত হল ইন্সটিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন, যাদের কাজ ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ নীতি ও বিধি প্রণয়ন, সমস্ত ম্যালেরিয়া রোগীদের বাধ্যতামূলক নথিভূক্তকরণ, দেশজুড়ে ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ক স্থাপন করা ও ওষুধ বিতরণ। ১৯২১-এ পার্টির কর্মসূচীতে লেখা হল, ‘পার্টির জনস্বাস্থ্য নীতির ভিত্তি হবে রোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে একের পর এক ব্যাপক ও সর্বাত্মক স্বাস্থ্যবিধি ও স্যানিটারী কার্যক্রম।’ ১৯২১ থেকে ১৯২৩ দু’বছরে ভয়াবহ কলেরা মহামারীর সঙ্গে টিবি, প্লেগ, টাইফাস, গুটিবসন্তের মহামারী শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে বাশকিরের উফা ব্যাক্টেরিওলজিক্যাল ইন্সটিটিউটকে ঢেলে সাজানো হয়। সাধারণ হাইজিন, স্যানিটেশন ছাড়াও কলেরা, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, টাইফয়েড, টিবি, জলাতঙ্ক, অ্যানথ্রাক্স ও স্মলপক্সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ওষুধ, টীকা, অ্যান্টিসেরাম ইত্যাদি এবং ডিসেন্ট্রির ওষুধ, স্ট্রেপ্টোকক্কাস সেরাম তৈরীর কাজে লাগানো হল এই প্রতিষ্ঠানকে। ওষুধশিল্পের জাতীয়করণ ও সিঙ্কোনাসহ অন্যান্য ওষধি গাছপালার বনসৃজনে হাত দেওয়া হল। ১৯২৫-এর মধ্যে দশটা বাছাই শহরে প্লেগ ল্যাব ও প্লেগ হসপিটাল চালু হল, যেগুলোর নেতৃত্বে কয়েক হাজার অ্যান্টি-প্লেগ টীম কারখানা চত্বর ও শ্রমিক মহল্লায় বাড়ি বাড়ি সাফাই অভিযান, জঞ্জাল দাহ, শব সমাধিস্থকরণ, কন্টেইনমেন্ট জোন নির্দিষ্টকরণ, আইসোলেশন ও কোয়ারান্টাইনে নজরদারী, ইঁদুর ও মাছি নিধন, সচেতনতা প্রসার – যা যা প্রয়োজন সব করল। ১৯২৭ নাগাদ গুটিবসন্ত অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এল। ১৯২৩-এ হাজারে ৪৬ জন থেকে চার বছরে হাজারে ১৫-তে নেমে এল আক্রান্তের সংখ্যা। এই চার বছরে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা বার্ষিক ৫৭ লক্ষ থেকে ৩৭ লক্ষে নেমে এল। ১৯২৯-এর পার্টি কংগ্রেসে জনস্বাস্থ্য কমিশারেট রিপোর্ট পেশ করল, শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২৭৩ ছিল ১৯১৩-তে, ১৮৬-তে নেমেছিল ১৯২২-এ, এবছর আরো নেমে ১৪১ হয়েছে। অবশ্যই অঞ্চলভেদে তারতম্য ছিল, খারটভে ১০৬, তো লেনিনগ্রাদে ১৫১, মস্কোতে ১৩১, সারাটভে ১০৬। কংগ্রেস মহামারীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাফল্যের উপর ভিত্তি করে উন্নততর স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ ও বসবাসের পরিস্থিতির জন্য সংগ্রামের পথে পা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। ১৯৩০-এ ‘ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি’ শীর্ষক সরকারী দলিল প্রকাশ হয়, যেখানে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহ, নিকাশী, আবাসন, পরিচ্ছন্নতা এবং বাসস্থান ও কর্মস্থলের পরিবেশের উন্নয়নে আরো বেশী অর্থ ও সময় বরাদ্দের। ঐবছরেই দ্বিতীয়ার্ধে প্রকাশিত হয় ‘মহামারীর সঙ্গে যুদ্ধ প্রসঙ্গে’ শীর্ষক আরেকটি দস্তাবেজ, যেখানে বলা হয়েছে ৫০ শতাংশ রোগবালাইয়ের কারণ খারাপ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষ তিন বছরে অসুখবিসুখের খাতে খরচ হয়েছে ২ কোটি ৭০ লক্ষ রুবল।
১৯১৯-এর পার্টি সম্মেলনে লেনিন বললেন, ‘হয় উকুন (টাইফাস জীবাণুর বাহক) সমাজতন্ত্রকে পরাজিত করবে, নয় সমাজতন্ত্র উকুনকে পরাস্ত করবে।’ জনস্বাস্থ্য কমিশারেটের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে সমগ্র পার্টি, সব ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র-যুব-মহিলা ফ্রন্ট একযোগে রাস্তায় নামল মহামারী মোকাবিলায়। মিলিটারি স্যানিটারি বোর্ডকে হেলথ কমিশারেটের আওতাধীন করা হল, সমস্ত চিকিৎসকদের মিলিটারিতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হল। প্রলেতারিয়ান রেড ক্রসের তত্বাবধানে রেড ভলান্টিয়ারদের দু’মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরী করা হল ফেলচার বাহিনী, লাল ফৌজের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা শুরু করল মানুষের বাড়ি-বাড়ি ঘুরে তাদের বাসস্থান পরীক্ষা করা, উকুন নিধন, পরিচ্ছন্নতার পাঠ দেওয়া, সাবান বিলি করা। হাতেনাতে ফল মিলতে শুরু করল বছর না ঘুরতেই। সেমাস্কোর কথায়, ‘আক্ষরিক অর্থেই শূন্য থেকে সবকিছু শুরু করতে হয়েছে এখানে। আমরা স্নানের ট্রেন, লন্ড্রি ট্রেন, হসপিটাল ট্রেন – সবকিছু পুনরায় চালু করেছি। আমাদের এখন মোট ৩,৯৭,৪৯৬-টি শয্যা ও ২৩২-টি সুসজ্জিত হসপিটাল ট্রেন রয়েছে, যে কোন ইউরোপীয় মিলিটারি অর্গানাইজেশনের কাছে যা অহঙ্কার করার মত। আমাদের এখন এক সুবিশাল, সুসংগঠিত, অসংখ্য শাখায় বিভক্ত ও কেন্দ্রীভূত কর্তৃপক্ষ রয়েছে।’ স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের প্রয়োগ এভাবেও করা যায়, জনস্বাস্থ্য যে এক আন্দোলন এবং তা শ্রেণী-সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সারা দুনিয়া তা প্রথম চাক্ষুষ করল।
সুইস চিকিৎসক হেনরী আর্নেস্ট সিজারিস্ট ১৯৩০ সালে রুশদেশে গিয়ে যা প্রত্যক্ষ করেন, তার ভিত্তিতে ১৯৩৭ সালে তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘সোশ্যালাইজড্ মেডিসিন ইন দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’-এ লিখলেন ‘স্বাস্থ্য এমন একটি সম্পদ যার উপর মানুষের অধিকার মৌলিক। যেখানেই এই ধারণাকে মান্যতা দেওয়া হয়, সেখানেই স্বাস্থ্যরক্ষা ও স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য সমস্ত ব্যবস্থা বিনামূল্যে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে এটাই যুক্তিসঙ্গত। শিক্ষার মত মেডিসিনও সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয় হবে না, বরং তা রাষ্ট্রের সরকারী দায়িত্বের মধ্যেই পড়বে।’
স্কটিশ প্যাথলজিস্ট, ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ডাঃ ডেভিড স্টার্ক মারে, যিনি ইংল্যান্ডে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস গড়ে তোলার পক্ষে অন্যতম প্রচারক ছিলেন, তিনি লিখলেন, ‘সোভিয়েত রাশিয়ার জনগণের স্বাস্থ্যরক্ষা ও চিকিৎসার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে একদিকে কেন্দ্রীয়ভাবে পিপলস্ হেলথ কমিসারেট, অন্যদিকে মহল্লায় মহল্লায় হেলথ কমিটি, প্রতিটি কারখানায ও যৌথ খামারে হেলথ নিউক্লিয়াসগুলো। এই দ্বিমুখী নিয়ন্ত্রণের একটা দিক হল জনগণের স্বাস্থ্যরক্ষা করা যে রাষ্ট্রের একটা জরুরী কাজে তার স্বীকৃতি, আরেকটা দিক হল তার পরিপূরক, অর্থাৎ, জনগণ তার নিজের স্বাস্থ্যরক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা নেবে এই নীতির যুক্তিসঙ্গত প্রয়োগ। এই ব্যবস্থা না রাশিয়ার জনগণের উপর, না চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া, বরং পরিষেবা প্রদানকারী ও গ্রহীতা – উভয়পক্ষের সক্রিয় সমর্থন ও অংশগ্রহণ, এমনকি সমালোচনার অধিকারও নিশ্চিত করে এই ব্যবস্থা।’
১৯২১-২২-এর মন্বন্তরে সত্তর লক্ষ শিশুসহ আড়াই কোটি মানুষ বিপন্ন হয়। ট্রটস্কি ১৯২২ সালকে ‘ভয়ঙ্কর ক্ষুধার বছর’ তথা ‘খাদের ধার’ বলে চিহ্নিত করেছেন। পেত্রোগ্রাদে সেসময় পাঁউরুটির দাম ছিল পাউন্ডে ৪৫০ রুবল, ময়দা ৭০০ রুবল প্রতি পাউন্ড, মাংস ৩০০০ রুবল প্রতি পাউন্ড; অন্যদিকে একজন নার্সের বেতন ছিল ২৬০০০ রুবল, স্টেনোগ্রাফারের ৩২০০০ রুবল। খাদ্শস্যের ব্যবসায় বিপুল মুনাফা লুঠছিল একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা। বিষ্মিত লেনিন খেদোক্তি করলেন, ‘খাদ্যশস্য নিয়েও ব্যবসা করা সম্ভব হয়! দুর্ভিক্ষকে কাজে লাগিয়েও মুনাফা লোটা যায়!’ দ্রুত সরকারী উদ্যোগে ব্যবসাদারদের তুলনায় নয়ভাগের একভাগ দামে খাদ্যশস্য বিক্রীর বিপণি খোলা হল মহল্লায় মহল্লায়। পাবলিক হেলথ কমিশারেটের রিপোর্ট, ১৯২০-র জানুয়ারিতে দেশে প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ৫২ শতাংশ খাদ্য সরবরাহ ছিল।
বিপ্লবের আগে দেশে আবাসনের তীব্র সংকট, প্রতি ঘরে উপচে পড়ছে মানুষ, অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি আবাসন, সেন্ট পিটার্সবার্গে শ্রমিক পরিবার পিছু গড়ে মাত্র ৩৩ স্কোয়ার ফুট মেঝে, মস্কোতে মাত্র ২৮ শতাংশ বিল্ডিংয়ে নিকাশী ব্যবস্থা বহাল, অধিকাংশ শ্রমিক পরিবারের বাস বেসমেন্টে এক কামরার ঘরে, অপর্যাপ্ত জল সরবরাহ, তাও জমে বরফ হয়ে যায় প্রচন্ড শীতে, ঘর গরম রাখবার জ্বালানির অনটন। বিপ্লবের দশমাস পরে পাঁচ বা ততোধিক অ্যাপার্টমেন্টযুক্ত সমস্ত বাড়ির জাতীয়করণ করে সেগুলির সুষম বন্টন শুরু হল গৃহহীন ও উপচে পড়া ভিড়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা শ্রমজীবীদের মধ্যে। ১৯২০ সালে এই আবাসনগুলোর সঙ্গে কারখানা, রেলস্টেশন ও স্কুলে অজস্র কমিউনিটি কিচেন, ডাইনিং হল, লন্ড্রি, শৌচাগার, বিনোদনকেন্দ্র, শিশুদের নার্সারি ও ক্রেশ গড়ে তোলা হল।
১৯১৯-এ জনগণ ও চিকিৎসকদের সেতুবন্ধনকারী ফেলচার বাহিনীর এক ষষ্ঠাংশ ছিলেন মহিলা, ১৯২৬-এ ৬০ শতাংশই হলেন মহিলা কর্মী। ১৯২১-এর মধ্যে নার্সিং স্কুলের সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়ানো হল, মিডওয়াইফারি ট্রেনিং স্কুল চালু হল। যৌনকর্মীদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও তাদের জন্য উৎসর্গীকৃত চিকিৎসাকেন্দ্র চালু করা হয় ১৯১৮-তেই। ১৯১৭-তে মস্কো শহরে ৩০ হাজার যৌনকর্মী ছিলেন, ১৯২৮-এ তা নেমে এল ৩ হাজারে। ১৯২৬ সালে দেশে গড় আয়ু বেড়ে হল ৪৪ বছর, যখন ভারতে গড় আয়ু ছিল ২৫.৭৫ বছর। ১৯১৩ থেকে ১৯২৬, দেড় দশকে ১০ বছরের নীচে শিশুদের মৃত্যুর হার হাজারে ২৪ থেকে ১২-তে, অর্থাৎ অর্ধেকে নেমে এল।
চিকিৎসকের আকাল ছিল প্রাক-বিপ্লব সময় থেকে বিপ্লবোত্তর কয়েক বছরে। মস্কো শহরে ১৯২৩ সালে মাত্র ৫৪৪০ জন চিকিৎসক ছিলেন সর্বসাকুল্যে, যার মধ্যে ৪১৯০ জন সরকারী চিকিৎসক, ৯৫৬ জন বেকার হিসেবে নথিভূক্ত ছিলেন। সরকার খুবই কম বেতন দিতে পারত বলে নিউ ইকনমিক পলিসি-তে প্রাইভেট প্র্যাক্টিসের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সরকারী চিকিৎসকদের। মেডিক্যাল স্কুলগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে শ্রমিক-কৃষক পরিবারের ছেলেমেয়েদের অগ্রাধিকার দেওয়া হল। এতদিন পড়া শেষে প্র্যাক্টিসের লাইসেন্স পেতে যে পরীক্ষা দিতে হত, তা বাতিল করে কোর্স কমপ্লিশন সার্টিফিকেটের ভিত্তিতেই লাইসেন্স দেওয়ার চল হল। ডাক্তারী পড়ায় শ্রমিক-কৃষকের সন্তানদের উৎসাহিত করতে বিশেষ ফ্যাকাল্টি গঠন করা হল। সরকারী অংশীদারিত্ব বাড়তে বাড়তে ১৯৩০ সালে আর মাত্র ৫ শতাংশ হাসপাতাল ও ৬.৪ শতাংশ আউটডোর ক্লিনিক বেসরকারী হাতে ছিল, মস্কোতে ১৭.৫ শতাংশ ও কাজানে ১৬ শতাংশ চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে থাকলেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্তর্গত ছিল মেডিক্যাল স্কুল ও চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো, মেডিক্যাল শিক্ষার সিলেবাসে রোগের সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ ও তার প্রতিরোধ অন্তর্ভূক্ত করা, গ্রামে বেশী করে ডাক্তার-নার্স পাঠানো ইত্যাদি কর্মসূচী। সোশ্যাল হাইজিন, এপিডেমিওলজি, স্যানিটারি স্ট্যাটিস্টিক্স প্রভৃতি পৃথক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হল মেডিক্যাল সিলেবাসে, জনস্বাস্থ্য কমিশারেটের অর্থানুকূল্যে এই বিষয়ে গবেষণার বিভাগ খোলা হল সব মেডিক্যাল স্কুলে। ১৯২৩-এ স্টেট ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল হাইজিন স্থাপিত হয়। ১৯১৩-তে যেখানে মেডিক্যালে ছাত্র ভর্তি হয়েছিল ১৯,৭৮৫, ১৯২৮-এ তা বেড়ে দাঁড়াল ৬৩,১৬২, আর ১৯৩২-এ ৭৬,০২৭। সেমাস্কোর পর যিনি জনস্বাস্থ্য কমিশারেট হন, সেই ভ্লাদিমিরস্কির রিপোর্ট, ১৯৩২ সাল নাগাদ রাশিয়ার অন্ততঃ ৯০ শতাংশ চিকিৎসক সরকারী ক্ষেত্রে কাজ করতেন। সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাকে শিশুস্বাস্থ্যের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, প্রত্যেক স্কুলগুচ্ছের জন্য চিকিৎসক নিবেদিত করা হয় নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য। পথসুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি স্কুলশিক্ষার সিলেবাসে এল, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হেলথ ডায়েরি বাধ্যতামূলক হল, যা পরীক্ষা করা ক্লাসের মনিটরদের কাজ।
চরম আর্থিক অনটনের মধ্যেও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ এপ্রিল ১৯২৩-এ ছিল ১৪.০২ কোটি রুবল, ১৯২৬-এ হল ৩৮.৪৯ কোটি ও ১৯৩০-এ ৪১.০৫ কোটি রুবল। ১৯১৩ সালে ৫৩০০-টি হাসপাতাল ছিল দেশে, শয্যাসংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজারের আশেপাশে। ১৯২৮-এ তা বেড়ে শহরাঞ্চলে ও গ্রামাঞ্চলে হয় যথাক্রমে ১,৫৮,৫১৪-টি ও ৫৯,২৩০-টি হাসপাতাল-শয্যা এবং ৫,৬৭৩-টি ও ৭,৫৩১-টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র-শয্যা, ১৮,২৪১-টি ও ৯,০৯৭-টি প্রসূতি-শয্যা। ১৯২৮ থেকে ১৯৩২ – শুধুমাত্র এই চারবছরে ২০০০ নতুন হাসপাতাল নির্মিত হয় সোভিয়েত রাশিয়ায়। ১৯২৮ সালে দেশের ৭০ শতাংশ ফার্মা-পণ্য ও ৮৮ শতাংশ ওষুধ রাষ্ট্রায়ত্ব কারখানাগুলো তৈরী করত। ১৯১৪-তে রাশিয়ায় ১২-টি মাত্র ব্যাক্টেরিওলজিক্যাল ইনস্টিটিউট ছিল, ১৯৩৭-এ ছিল ৩৭-টি, অর্থাৎ ২৫-টি নতুন, যার মধ্যে সারাটভের মত প্রত্যন্ত অঞ্চলেই অধিকাংশ গড়ে ওঠে এবং পুরোটাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে। ইউক্রেনের খার্টভে ১৯৩১ সালে রয়েন্টজেন ইনস্টিটিউট নামে ক্যান্সার চিকিৎসা ও গবেষণার উৎকর্ষ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়।
একদিকে বিদেশী পুঁজিবাদী শক্তির প্রবল আক্রমণ, অন্যদিকে দেশীয় প্রতিবিপ্লবী ও গোঁড়া চার্চের কড়া প্রতিরোধের মোকাবিলা করে যুদ্ধে বিধ্বস্ত, অনাহারে ক্লিষ্ট অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া একটা অর্থনীতিকে, জাতিকে এভাবেও শক্ত পায়ে দাঁড় করানো যায়, মার্ক্সবাদ ও মেহনতী মানুষের বৈপ্লবিক ঐক্যকে সম্বল করে মুক্তির দিশা দেখানো যায়, তা নভেম্বর বিপ্লবের পর হাতেকলমে করে দেখিয়েছে লেনিনের পার্টি। দুনিয়ার কোণে কোণে আজও মানব-মুক্তি মানেই মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ।