১৯০৮ সালের ৯ই নভেম্বর। একটু আগেই সন্ধ্যা নেমেছে কলকাতা শহরের বুকে। গঙ্গা থেকে বয়ে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ায় চলছে শীতের প্রস্তুতি।
সারপেন্টাইন লেন,মধ্য কলকাতার একটি ছোট্ট গলি। সময় আনুমানিক সন্ধ্যা সাতটা। ল্যাম্পপোস্টের গ্যাসবাতির হালকা আলোতে কেমন একটা রহস্যময় পরিবেশ চারদিকে। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন রোজকেরে পসারিরা। ফেরিওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে রকমারি সুরে,লক্ষ্য বাড়ির গৃহিণীদের দৃষ্টি আকর্ষণ।
গলায় চাদর জড়িয়ে ছোট্ট লাল একটি শিব মন্দিরের পাশে, উবু হয়ে বসে রোগাসোগা চেহারার দুটি তরুণ চীনেবাদাম খাচ্ছিলেন।
কার্তিক মাসের এই নিস্তরঙ্গ সন্ধ্যায় অঞ্চলের এক মাঝবয়েসী ভদ্রলোক তাঁর বসত বাড়ি থেকে বেড়িয়ে হেঁটে রওয়ানা দিলেন সেই রাস্তা ধরেই। শিবমন্দিরটি পেরিয়ে সেন্ট জেমস পার্কের দক্ষিণপশ্চিম কোণে আসামাত্রই, অন্ধকারে ঝলসে উঠল রিভলবার। মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়লেন সেই ব্যক্তি।
অন্ধকার ফুঁড়ে, মুখের চাদর সরিয়ে, বেরিয়ে এলেন দুই বিপ্লবী। ঢাকা মুক্তি সংঘের শ্রীশ চন্দ্র পাল আর আত্মোন্নতি সমিতির রণেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি। শ্রীশ পা দিয়ে উল্টে দিলেন শরীরটাকে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে আরো দু বার ফায়ার করলেন। বুলেটের শব্দ অনুরণিত হতে লাগলো গোটা এলাকা জুড়ে। মৃত্যু একদম নিশ্চিত করে দুজনে রিভলবার দুটি কোমরে গুঁজে ধীরে ধীরে পার্কের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। এলাকার লোকজন কেউ বিন্দুমাত্র বাধা দিলেন না। ঘটনাটি চাক্ষুষ করে সবাই যে যার কাজে ফিরে গেলেন। যেন এই ঘটনা অপ্রত্যাশিত ছিল না মোটেই। কারণ, এই মৃত ব্যক্তির নাম নন্দলাল ব্যানার্জি। পরাধীন ভারতের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ইংরেজ পুলিশের ডাকসাইটে দারোগা।
ঘটনার নেপথ্যকাহিনী যদি আমাদের খুঁজতে হয় তাহলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই বছরের পয়লা মে র দিনটিতে।
ট্রেনে চেপে কলকাতা থেকে দারোগা নন্দলাল ছুটি শেষ করে সিংভূমে ফিরে যাচ্ছেন নিজের কাজে যোগদান করতে। অন্যদিকে তিরিশে এপ্রিল রাতে মুজ:ফরপুরে দুই বিপ্লবী যে বোমা বিস্ফোরণ করেছেন তার খবর ততক্ষণে রটে গেছে চতুর্দিকে। সব গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথ, রেলপথ মেপে মেপে চলছে পুলিশি প্রহরা।
নন্দলাল কামরায় বসে লক্ষ্য করলেন স্থানীয় মানুষদের সাথে বসে রয়েছেন একটি তরুণ বাঙালি যুবক। যুবকটির পরনে সদ্য দোকান থেকে কেনা ধোপদুরস্ত নতুন পোষাক এবং জুতো। যা কিনা পাশে বসে থাকা ময়লা জামা কাপড়ের দেহাতি লোকেদের থেকে তাকে একটু হলেও আলাদা করে রেখেছে।
স্বাভাবিক পেশাগত প্রবৃত্তিতে দারোগাটি র সন্দেহ হলো। পুলিশের খবরে বিপ্লবীদের বয়স যেমনটি বলেছে, এর বয়সও ঠিক সেরকমই যে মনে হচ্ছে তার। গোঁফের তলায় একটা আলগা হাসির আভাস খেলে গেলো নন্দলালের। সরকার বাহাদুর ৫০০০ টাকা ইনামও যে ঘোষণা করে রেখেছেন বিপ্লবীদের মাথার দাম হিসাবে!
তিনি ধীরে ধীরে তরুণটির সাথে ভাব জমাতে শুরু করলেন। ছেলেটি যে কিছু একটা অস্বস্তিতে রয়েছে, তা ধরতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না দুঁদে দারোগার। বুঝতে পারলেন শিকারের খুব কাছে তিনি এসে পড়েছেন, তার সন্দেহ এক্কেবারে ঠিক!
ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ালে, যুবকটি জল খেতে নামলেন। নন্দলালও নেমে, দৌড়ে গিয়ে খবর দিয়ে দিলেন স্টেশন মাস্টারকে, যাতে পরের স্টেশন মোকামাঘাটে পুলিশ অপেক্ষা করতে পারে ছেলেটিকে গ্রেফতারের জন্য। যুবকটি যে তাকে বিশ্বাস করে আগেভাগেই তার গন্তব্য বলে দিয়েছে।
পরের স্টেশন মোকামাঘাটে নামতেই পুলিশ ধরলো ছেলেটিকে।
স্বাস্থ্যবান যুবকটি হাত ছাড়িয়ে পালাতে পালাতে নন্দলালের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “আপনি বাঙালি হয়ে আরেক বাঙালিকে এমন করে ধরিয়ে দিলেন!!” তরুণ বিপ্লবী, কাঁচা বয়সের অনভিজ্ঞতায় বুঝতে পারেননি, মীরজাফরদের দল সব যুগেই থাকে। সঠিক সময়ে তাদের চরিত্রের প্রকাশ হয়।
গুলি বিনিময় শুরু হল স্টেশন চত্বরে। তুমুল অসম লড়াইয়ে কার্তুজ শেষ হয়ে গেলে বিপ্লবীটি সিদ্ধান্ত নেন, এই ইংরেজ পুলিশের হাতে তিনি ধরা দেবেন না। নিজের গুলিতে আত্মঘাতী হন দীনেশ চন্দ্র রায় ওরফে প্রফুল্ল চাকী। আমাদের ক্ষুদিরামের জুড়িদার। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবের প্রথম শহীদ।
এদিকে মুজঃফরপুরে ক্ষুদিরামকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসার পর থেকে তিনি একবারেও দীনেশের নাম করেন নি। বারবার বলেছেন তিনি একাই বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। দীনেশচন্দ্র রায়ের আসল নাম যে প্রফুল্ল চাকী, সেটাও তাঁর জানা ছিল না। কিন্তু দীনেশের মরদেহ দেখার পর আর সত্য গোপন করতে পারেন নি।
হাজারহোক কঠিন বিপ্লবীরা তো মানুষই হন। যদিও ঠিক কতটা মনুষ্যত্ব থাকলে আর কতটা নিঃস্বার্থ হলে দেশের জন্য হাসি মুখে আত্মবলিদান দেওয়া যায় তা আমার জানা নেই। রাজনৈতিক শঠতা দেখে দেখে অভ্যস্ত হওয়া আমাদের প্রজন্মের পক্ষে এই শহীদদের দেশপ্রেম সম্বন্ধে ধারনা পাওয়া এক রকম অসম্ভব।
কিন্তু দীনেশ চন্দ্র রায় ঠিক কে তার হদিশ ইংরেজ পুলিশ করতে পারছিল না। নন্দলালকেও যে স্বাভাবিকভাবে এই নামটাই বলেছিলেন প্রফুল্ল। তাই অত্যন্ত ‘সুভদ্র’ ব্রিটিশ পুলিশ মৃত প্রফুল্ল চাকীর গলাটি কেটে স্পিরিট দিয়ে ভিজিয়ে কলকাতার লালবাজারে পাঠিয়ে দেয় সনাক্তকরণের জন্য। এই নৃশংস আচরণ অবশ্য তাদের কাছে অস্বাভাবিক ছিল না। যদিও কথায় বলে মৃতের কোন শত্রু হয় না আর যুদ্ধেও মানুষ এরকম পশুর মতো আচরণ করে না। আসলে এ দেশের মানুষকে ইংরেজরা মানুষ বলেই ভাবতো না যে।
মীরজাফর নন্দলাল ১০০০ টাকা পুরষ্কার পেলেন সরকারের কাছ থেকে। পদোন্নতির পর আরও পদোন্নতির আশা নিয়ে ফিরলেন কলকাতায়। আর প্রফুল্ল মারা যাওয়ার ঠিক ৬মাস ৮ দিন পর কলকাতার রাজপথে মুখ থুবড়ে পড়লো তার শরীর। বদলা। বুলেটের জবাব বুলেটেই দিলেন বিপ্লবীরা।
সারপেন্টাইন লেনের আঁকাবাঁকা গলিপথে সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে এক মীরজাফরের মৃতদেহ পড়ে রইলো। একা।