রাজস্থান সরকার রাজ্যের নাগরিকদের স্বাস্থ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করতে বিল এনেছেন। বিধানসভায় সে বিল পাস-ও হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হোক, এমন দাবি আমাদের অনেকেরই। দাবি অনেকদিনের। সেদিক থেকে এমন বিলকে ইচ্ছে-পূরণ হিসেবেই দেখা উচিত। তারপরও বিল নিয়ে এত বিক্ষোভ – বিক্ষোভ অধিকাংশত বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত চিকিৎসকদের – তার কারণ কী?
ইতিহাস বলে, বেসরকারি বাণিজ্যক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ সবসময়ই ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রই বা ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন! বিলেতের এনএইচএস, যাকে কিনা কল্যাণকামী রাষ্ট্রের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ও অনুসরণযোগ্য স্বাস্থ্যব্যবস্থার মডেল হিসেবে দেখা হয়ে থাকে, সেই এনএইচএস চালুর সময় সেদেশের ডাক্তাররা এবং ডাক্তারদের সংগঠন তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। এদেশেও যদি রাষ্ট্র সব হাসপাতাল অধিগ্রহণ করে আর্থিক স্বচ্ছলতা নির্বিশেষে সকলের জন্য একইমানের স্বাস্থ্যপরিষেবার বন্দোবস্ত করতে চান, নিশ্চিত থাকতে পারেন, বিরোধিতা করার লোকের অভাব হবে না। কিন্তু, বর্তমান ক্ষেত্রেও বিরোধিতার কারণ কি তা-ই? অর্থাৎ বিরোধিতা শুধুই কায়েমি স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে? প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বিল-টি বিষয়ে, বিশেষত মূল বিতর্কের জায়গাটা বিষয়ে, অল্পবিস্তর জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
রাজস্থান সরকারের স্বাস্থ্যের অধিকার বিলে স্বীকৃত হয়েছে রাজ্যের প্রতিটি নাগরিকের নিখরচায় চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার। চিকিৎসার অধিকার বলতে হাসপাতালের আউটডোরভিত্তিক চিকিৎসা এবং হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা, দুইই। এবং এই নিখরচায় চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার বলবৎ থাকবে সরকারি হাসপাতালে তো বটেই, ক্ষেত্রবিশেষে বেসরকারি হাসপাতালেও। এমার্জেন্সি পরিস্থিতিতে টাকা জমা না করেই চিকিৎসা করানো যাবে – আইনি ঝঞ্ঝাটের সম্ভাবনা আছে, এমন ক্ষেত্রেও থানাপুলিশে খবর করার আগেই চিকিৎসা শুরু করতে হবে – চিকিৎসার শেষে টাকাপয়সার হিসেব না মিটিয়েও হাসপাতাল থেকে চলে আসা যাবে, সেক্ষেত্রে বিল মেটাবেন সরকার। গণ্ডগোলটা বেধেছে, মূলত, এই শেষ কথায়। অর্থাৎ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিনেপয়সায় চিকিৎসা করানোর ‘অধিকার’-এর কথাটুকু নিয়েই।
তাহলে এতদিন কি রাজস্থানের মানুষজনের সুচিকিৎসার জন্য কোনও বন্দোবস্তই ছিল না? অবশ্যই ছিল। সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিনেপয়সায় চিকিৎসা করানোর জন্য ছিল ‘নিঃশুল্ক নীরোগী রাজস্থান” -শুধুমাত্র গতবছরের হিসেব দেখলে, দুহাজার বাইশ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে চিকিৎসা পেয়েছেন সাড়ে আট কোটিরও বেশি মানুষ, এই খাতে সরকারের খরচ হয়েছে মোটামুটি ১০৭২ কোটি টাকা। ছিল বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট-এর স্বপ্নের প্রকল্প “চিরঞ্জীবী স্বাস্থ্যবীমা”, যেখানে নাগরিকের দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসাব্যয় রাজ্য সরকার বহন করেন। এই প্রকল্পে গতবছরের শেষ নয় মাসে সরকার বিল মিটিয়েছেন চৌঁত্রিশ লক্ষ সাতাত্তর হাজার রোগীর, খরচা হয়েছে ১৯৪০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে ব্যক্তিনাগরিকের চিকিৎসাবীমার উর্ধ্বসীমা বার্ষিক দশ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে পঁচিশ লাখ টাকা করা হয়েছে আগামী আর্থিক বছর থেকেই, কাজেই এই খাতে সরকারের খরচ আরও বাড়বে। রাজ্য সরকারি কর্মী প্রমুখদের জন্য সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্প ছিল। এছাড়াও ছিল স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য ফ্রি টেস্ট স্কিম, যাতে উপকৃত হয়েছেন, গত বছরের শেষ নয় মাসে, প্রায় তিন কোটি মানুষ। তারপরও অসন্তোষ ছিল। তদুপরি, বিভিন্ন প্রকল্প ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছে-অনিচ্ছে অনুসারে চলে – বিল পাস করে নাগরিকের স্বাস্থ্যের অধিকার স্বীকৃত হয়ে গেলে ক্ষমতায় যে দলই থাকুন, তাঁরা দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবেন না। ঘটা করে বিল পাস, সম্ভবত, এ কারণেই।
সরকারি সদিচ্ছে নিয়ে সংশয় পোষণ যদি নাও করি, কিন্তু ঠিক এই পথে নাগরিকের স্বাস্থ্যপরিষেবার অধিকার, বিশেষত বিনেপয়সায় চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় কি? সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা মজবুত না করে সেই বন্দোবস্ত কি আদৌ সম্ভব? সরকারি স্বাস্থ্যবীমা – চিরঞ্জীবী স্বাস্থ্যবীমা – যেখানে সরকার নাগরিকের চিকিৎসার বিল মেটান, বনাম সরকারি হাসপাতালে বিনেপয়সায় চিকিৎসা দেওয়া, নিঃশুল্ক নীরোগী রাজস্থান – এই দুই প্রকল্পে সরকারি ব্যয় ও উপকৃত রোগীর অনুপাতের তুলনা করে দেখুন। হাজার প্রকল্প চালু করেও সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা মজবুত না করে নাগরিকের স্বাস্থ্যের অধিকার সুলভে সুরক্ষিত হতে পারে না।
একদিকে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাটিকে নড়বড়ে হতে দিয়ে বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবসাকে ফুলেফেঁপে ওঠার পরিসর দেবেন, সরকারি স্বাস্থ্যবীমার মাধ্যমে সেই স্বাস্থ্যব্যবসায় বাড়তি ‘কাস্টমার’ জুগিয়ে বাড়তি মুনাফার সুযোগ করিয়ে দেবেন – আবার ওই ব্যবস্থার মাধ্যমেই নাগরিকের বিনেপয়সায় চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করতে চাইবেন, তা কি হয়?
সবার দুবেলা পেটপুরে খাবার পাওয়ার অধিকারের যাথার্থ্য নিয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশই নেই, কিন্তু সেই অধিকার নিশ্চিত করার দায় যদি সরকার নিজে না নিয়ে এমন বিল পাস করিয়ে নেন যে ক্ষুধার্ত মানুষ দরকারমতো দোকান থেকে চালডাল বিনেপয়সায় যথেচ্ছভাবে জোগাড় করে নেবেন, তাতে আপত্তি উঠবেই। ইমার্জেন্সি পরিস্থিতিতে (ইমার্জেন্সি বলতে কী, বিলে তা স্পষ্ট নয়) নাগরিক যেখানে খুশি গেলেই বিনেপয়সায় চিকিৎসা পাবেন এবং সেটি তাঁর অধিকার, শুনতে খুবই ভালো – কিন্তু রাষ্ট্রের কাছ থেকে বাণিজ্যিক লাইসেন্স নিয়ে হাসপাতাল চালাচ্ছেন যাঁরা, বাণিজ্য থেকে মুনাফা অর্জনও তাঁদের অধিকার, সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো বুনিয়াদী বিষয়কে মুনাফামুখী বন্দোবস্তের হাতে ছাড়া উচিত কিনা, সে প্রশ্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং আমি সর্বতভাবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে – কিন্তু সেই বন্দোবস্ত বহাল রেখে বাণিজ্যমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাতে জনকল্যাণের দায় ছেড়ে রাখতে চাওয়াটা – বা জোর করে তাঁদের দিয়ে জনকল্যাণ করাতে চাওয়াটা – দ্বিচারিতা।
অতএব, প্রতিবাদ যাঁরা করছেন, তাঁদের আপত্তি অকারণ নয়, এমনকি একান্তভাবে সঙ্কীর্ণ স্বার্থভাবনাপ্রসূত এমনও নয়। মহান লক্ষ্য খুবই ভালো কথা, কিন্তু তা অর্জনের জন্য যতখানি পরিকল্পনা বা দূরদর্শিতা প্রয়োজন ছিল, ততখানি ভাবনাচিন্তা এক্ষেত্রে করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও বলি, একটি অঙ্গরাজ্যের সরকারের মাথা হয়েও, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট যেভাবে বিধানসভায় বিল এনে নাগরিকের স্বাস্থ্যের অধিকারের স্বীকৃতি দিতে চাইলেন, তার জন্য তাঁকে কুর্নিশ। নাগরিকের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার, সর্বজনীন স্বাস্থ্যের অধিকার সর্বত্র স্বীকৃত হোক – যতদিন না সেই অধিকার সর্বত্র স্বীকৃত হচ্ছে, অধিকারের দাবি উত্তরোত্তর জোরালো হোক, এটুকুই চাওয়া।