ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন তাঁদের লোগো বদলে পৌরাণিক ধন্বন্তরির ছবি ব্যবহার করছেন। ‘ইন্ডিয়া’ সরে গিয়ে সেখানে ‘ভারত’ জ্বলজ্বল করছে। এর মূলে ঠিক কী ভাবনা, সে নিয়ে তর্কবিতর্ক বা আলোচনার মানে হয় না – কেননা সত্যিটা সকলেই জানেন। আর যাঁরা বলছেন, যে, সামান্য লোগো বদলে কী যায় আসে, তাঁদের মনে করিয়ে দিই – যুগ যুগ ধরেই মানুষ প্রতীকের মাধ্যমে নিজেদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রকাশ করে এসেছে এবং সচেতনে বা অবচেতনে, প্রতীক মানুষের চিন্তাভাবনা ক্রিয়াকলাপ যাপনে প্রভাব ফেলে। কাজেই, এ বদল শুধুই ‘’প্রতীকী” বদল নয় – “প্রতীক”-এর এই বদলকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে দেখা উচিত। সে বদল যদি আপনার পছন্দ হয়, তো ভালো কথা – কিন্তু যাঁরা চিকিৎসাব্যবস্থা বা সরকারি চিকিৎসা-দর্শন সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার এই বদল পছন্দ করছেন না, তাঁরা যদি এখনও চুপ থাকতে চান, তাহলে মুশকিল।
যাক গে, এত কথা খরচা করার মানে হয় না। এমনিতে, বর্তমান সময়ে, ডাক্তারবাবুরা জনবিচ্ছিন্ন প্রজাতি। সমাজের আর পাঁচটা সমস্যা বা সমাজের বাকি সব অংশের সমস্যা নিয়ে তাঁরা সেভাবে ভাবেন না। এমনকি চিকিৎসা সংক্রান্ত বা চিকিৎসা-পেশা সংক্রান্ত সমস্যার ক্ষেত্রেও তাঁরা সাধারণত মুখ বন্ধ রাখেন – অন্তত যতক্ষণ সম্ভব, ততক্ষণ অবধি মুখ বন্ধ রাখেন – অপেক্ষা করেন, নিশ্চয়ই আর কেউ না কেউ মুখ খুলবে। আগুনের আঁচ নেহাত যদি নিজের পশ্চাদ্দেশ অবধি পৌঁছায়, তখন তাঁরা প্রতিবাদে ব্রতী হন – এবং শিশুসুলভ সারল্যে বিস্মিত হন, কেন বাকি সকলে মিলে তাঁর সঙ্গে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদে গর্জে উঠছেন না!! তো ঠিকই আছে। আমার পোস্ট কজনই বা পড়েন – সেই সীমিত গুটিকয়েকের কেউই এই পোস্ট পড়ে প্রতিবাদে সামিল হবেন, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ (যদিও আগের কথাগুলো পড়ে অনেকেই যে চটে যেতে পারেন এবং আড়ালে-আবডালে, বা প্রকাশ্যে, আমার নামে গালি পাড়তে পারেন, এমন সম্ভাবনা বেশ প্রবল)। অতএব, এই প্রতীক-বদল নিয়ে কথা বাড়াচ্ছি না।
অর্থাৎ, পোস্ট থেকে চিকেন-মাটন সরিয়ে নিরুপদ্রব পনীর-এর আয়োজন করছি। আমি এতদিন অবধি ডাক্তারিক্ষেত্রে যে প্রতীক ব্যবহৃত হতো, তার গল্প শোনাতে চাইছি।
ডাক্তারিক্ষেত্রে, অর্থাৎ মডার্ন মেডিসিন বা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান, সেখানে এতদিন অবধি মোটামুটি দুরকম প্রতীক ব্যবহৃত হতো – নিচের ছবি দেখুন – একটির নাম ক্যাডুসিয়াস (যেখানে দুটি সাপ দৃশ্যমান), অপরটি রড অফ এসক্লেপিয়াস (একটি সাপ)।
যিশুখ্রিস্ট জন্মানোর অন্তত হাজারখানেক বছর আগে থেকেই, চিকিৎসাবিদ্যার প্রতীক হিসেবে – সুস্বাস্থ্য ও নিরাময়ের প্রতীক হিসেবে – রড অফ এসক্লেপিয়াস-এর ব্যবহার। হোমার-এর ইলিয়াডে যে এসক্লেপিয়াস উপস্থিত, তিনি রক্তমাংসের মানুষ – নায়কোচিত চিকিৎসক। পরবর্তীকালে তিনি কিংবদন্তী এবং ধীরে ধীরে কল্পকথার চরিত্রে পরিণত হন – গ্রিস-এ প্রায় সব খ্যাতিমান চিকিৎসক-ই নিজেদের এসক্লেপিয়াস-এর বংশধর হিসেবে দাবি করতেন, এমনকি হিপোক্রেটিস-ও অমন দাবিই করেছেন – তারও পরে তিনি চিকিৎসার দেবতা হিসেবে স্বীকৃতি পান। গ্রিসের সুদিন শেষ হয়ে রোমান রাজত্বের সময় তিনি পুরোদমে দেবতা।
তো কিংবদন্তী চরিত্র-ই হন, বা হোমার-এর কল্পনা – কিংবা গ্রিস পুরাকাহিনীর ঈশ্বর – এসক্লেপিয়াস যা-ই হন, তাঁর হাতে অমন দণ্ডটি এলো কোত্থেকে? বা দণ্ডটি নিরাময় ও সুস্বাস্থ্যের প্রতীক হয়ে উঠল কী করে?? অনেক গল্পের মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় গল্পটি হলো এরকম :
একবার জিউস – দেবতা, সে তো বলা-ই বাহুল্য – খুব চটে গেলেন গ্লাউকস-এর উপর। এবং রেগেমেগে বজ্র দিয়ে তাকে মেরেই ফেললেন। বাঁচানোর দায় এসে পড়ল সেই এসক্লেপিয়াস-এর উপর। তো এসক্লেপিয়াস মন দিয়ে গ্লাউকস-কে দেখছেন আর ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না। এমন সময় ঘরে একখানা সাপ ঢুকে পড়ল। মন দিয়ে পেশেন্ট দেখছেন, পেশেন্ট খারাপ আছে এবং ডাক্তারবাবু বুঝতে পারছেন না ঠিক কী করণীয় – এমন সময় ঘরে ময়ূর ঢুকে নাচলেও ডাক্তারবাবুর পক্ষে চটে যাওয়াটা স্বাভাবিক, আর এ তো জ্বলজ্যান্ত একটা সাপ! এসক্লেপিয়াস হাতের ডান্ডা দিয়ে সাপটির যাকে বলে দেহান্ত্ ঘটিয়ে দিলেন। আর তার পরই ঘটে গেল সেই আশ্চর্য ঘটনা! ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল আরও একখানা সাপ! সাপ, তার মুখে কিছু ওষধিপাতা/শেকড়বাকড়/জড়িবুটি – আর সেই ওষুধে মরা সাপ জ্যান্ত হয়ে নাচতে নাচতে চলে গেল।
এতক্ষণ ধরে বলা গল্পের মধ্যে এসক্লেপিয়াস চরিত্রটিকে আপনি যেটুকু চিনেছেন, তাতে নিশ্চয়ই এটুকু বুঝেছেন, যে, ভদ্রলোক, আর যা-ই হোক, বোকা ছিলেন না। তদুপরি তিনি ব্যাপম-কেসে চান্স পাওয়া ডাক্তার টাইপ-ও নন। সাপের মুখের জড়িবুটিতে মরা সাপ জ্যান্ত হওয়ার বার্তাটি অনুধাবন করা এবং কার্যক্ষেত্রে – অর্থাৎ গ্লাউকস-এর উপরে – তা যথাবিহিত প্রয়োগ করার ব্যাপারে তাঁর তিলমাত্র ভুল হলো না।
আর তার পর?
মহাকবি বলেছেন, তার পর কী হইল, জানে শ্যামলাল।
লেখা আর দীর্ঘ করব না। ফার্স্ট হাফ এখানেই শেষ। আজকে ওই ‘’রড অফ এসক্লেপিয়াস’’ অবধি রইল। পরের হাফে ক্যাডুসিয়াস-এর গল্প।