তেরো পার্বণ শেষে চিকিৎসার বিবর্তনের চৌদ্দতম পর্ব এটি।
কত কত কিছু লেখার আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে কত কিছু যে আছে … বাপ রে! তার উপর যদি বিবর্তিত আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে লিখি, তাহলে তো শেষই হবে না। দেখা যাক, কতদূর লেখা হয়ে ওঠে।
এই পর্বে একটি লোভনীয় কথা বলে লেখাটা শুরু করি। আমি
বিবর্তন নিয়ে লিখছি বটে, কিন্তু জানেন কি- বিবর্তন তত্ত্বের প্রবক্তা কে?
উত্তর ঠোঁটের কোনায়- ডারউইন।
কিন্তু সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা হলো- আমি ডারউইনকে মানি না! এবং কেন মানি না, এই পর্বটি সেই নিয়েই।
ঘনচক্কর লাগা শুরু হলো?
আচ্ছা ঠিক আছে। এবার কয়েকটি কবিতার লাইন লিখে ফেলি – By immutable immortal laws / Impress’d in Nature by the great first cause, / Say, Muse! How rose from elemental strife / Organic forms, and kindled into life ।
বলুন তো- এগুলো কার লেখা? জানেন না?
এটা ডারউইনেরই লেখা!!
ভাবছেন- এসব কি হচ্ছে? তাহলে এবার আরেকটু চক্কর খেয়ে নিন।
আপনি কি জানেন- ডারউইন ছিলেন একজন চিকিৎসক, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী তো বটেই! কেমন দিলাম চমক?
আপনি জানতেন প্রকৃতিবিদ, বায়োলজিস্ট- এইসব তাই তো?
ভালো কথা। কিছু একটা ধরে নিন শক্ত করে। মাথা ঘুরে পড়ে গেলে লেখক দায়ী নয়।
এর পরের চমক নিন। আপনি কি জানেন- ডারউইনও একটি চিকিৎসা পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছিলেন?
জানেন না? ধুর মশাই। এবার আসুন তবে ডারউইনের সেই অভূতপূর্ব চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে কিছু জানা যাক।
শুধু আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশই নয়, পৃথিবীর অন্য দেশেও, যাদেরকে এখন আমরা বেশি সভ্য বলে সমীহ করি সেখানেও- মানসিক রোগীদের চিকিৎসা চিরকালই অবহেলিত।
আমরা যেমন খুব সহজে কাউকে পাগল বলে দিই, তারপর ঝাঁটা ঝাড়ফুঁক জলপড়া তেলপড়া গ্রহরত্ন ইত্যাদি ইত্যাদি সহযোগে বীভৎস সব চিকিৎসা শুরু করে দিই, কাউকে কাউকে অলৌকিক ক্ষমতাশালী বলেও ভেবে বসি, আজকের উন্নত দেশেও কিন্তু এরকম বহু পদ্ধতি চালু ছিল ।
এবং অবশ্যই মানসিক রোগের কারণ হিসেবে আমরা যেমন ডাইনির কাজ/ ভূতে পাওয়া/ জীন পরীদের কাজ/ বান মারা/ তন্ত্র মন্ত্র তাবিজ কবচ ইত্যাদি ইত্যাদিতে বিশ্বাস করি, ঠিক ওদের দেশেও একসময় এরকম অনেক কিছু ভাবা হত। এবং পত্রিকায় এখনো মাঝে মাঝে খবর আসে- তমুককে ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে!
এবার আসুন ইংল্যান্ডে। না, আজকের দিনের ইংল্যান্ড আর তখনকার ইংল্যাণ্ডের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। তখনও সেদেশে বিশ্বাস ছিল- প্রাচীন গ্রীকদের থেকে ধার করা।
হিপোক্রেট গ্যালেনের সময়কার হিউমর থিওরিতে বিশ্বাস করতো সবাই।
মানে- শরীরের সব রোগের কারণ হলো- চারটে হিউমর।
Black bile, yellow bile, phlegma এবং blood।
তখন ভাবা হত- এই চারটে উপাদানের আনুপাতিক হার বা এদের কোন দোষের কারণেই সব অসুখ হয়। মানে দুষ্টু হিউমর হলেই রোগ! হিউমারাস বটেক! যদিও আজকের দিনে এই পদ্ধতি শুধুমাত্র ইতিহাস।
ফিরে আসি ডারউইনে। ডারউইন কি বললেন? বললেন – যত মানসিক রোগ, তার একটা বড় কারণ স্বমেহন করা! স্বমেহন করলে নাকি মস্তিকে রক্তের কনজেশন হয়, এবং মানসিক রোগ হয়। চক্কর বাড়ছে আবার? বাড়ুক।
আচ্ছা, ডারউইনের মাথায় এই চিকিৎসা পদ্ধতি এলো কি করে, তাই ভাবছেন তো?
বলছি। জাহাজে চড়ে সমুদ্রের লবণাক্ত জল খেয়ে যে হয়নি, এটা নিশ্চিত! ডারউইন খেয়াল করেছিলেন- ছোট ছোট বাচ্চারা খেলার সময় স্বেচ্ছায় লাটিমের মত চরকি পাক খায় এবং একটা সময় দুষ্টুমি বন্ধ করে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে। অতএব, এই পদ্ধতিকে মানসিক রোগের রোগীদের চিকিৎসার কাজে লাগানো যেতে পারে।যেই ভাবা সেই কাজ! সঙ্গে সঙ্গে ডারউইন ব্যবস্থা করে ফেললেন দুই ধরনের চেয়ারের। (সঙ্গের ছবি দেখুন)
এবার যে সকল মানসিক রোগের রোগীদের কোন চিকিৎসা হচ্ছে না, তারা স্বেচ্ছায় যেতে পারে। ফ্রিতে চিকিৎসা হবে।
ভাবুন তো- কেউ যদি নিজেকে দাবি করে সে ডাক্তার আর ফ্রিতে চিকিৎসা করবে, কে না দৌড়ে যাবে? তাও আবার যদি হয় পাগলের চিকিৎসা! এই সময়েও একদিনের মধ্যে সেখানে মাছের বাজার বসে যাবে! মারামারিও লেগে যেতে পারে।
তো ডারউইন শুরু করলেন চিকিৎসা। পদ্ধতি সংক্ষেপে বলি:
কারো মানসিক রোগ আছে? আসুন। প্রতিজ্ঞা করুন, যতক্ষণ না পর্যন্ত রোগী নিজে বলবে যে আমার আর মানসিক রোগ নেই, ততক্ষণই চিকিৎসা চলবে। তাতে যতবার চিকিৎসা লাগুক।
এবার ছবিতে দেখুন ছাদের থেকে ঝোলানো আছে দুই ধরনের পদ্ধতি। একটিতে রোগী শুয়ে থাকবে, একটিতে বসে। ছবিতে দেখুন সেই ঝুলন্ত বেড এবং চেয়ার ঘোরানোর জন্য আলাদা ব্যবস্থাও আছে! ভয় কিসের?
এবার রোগীকে শুইয়ে দিন বা বসিয়ে দিন। শুরু হোক ঘনচক্কর চিকিৎসা! ঘুরছে … ঘুরছে … ঘুরছেই … ডাক্তার যত দ্রুত মনে করবেন, তত দ্রুতই ঘোরানো হবে! কতক্ষণ ঘোরানো হবে? ওটি ডাক্তার ডারউইন বা বহু পরে আমেরিকার এক মহামান্য বেঞ্জামিন রাশই ঠিক করবেন!
সিম্পলি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যখন রোগীর মাথার ভেতর ভোঁ ভোঁ করবে, চারপাশের পৃথিবী ঘুরতে শুরু করবে, বমি পায়খানা প্রস্রাব- সব শরীরের বিভিন্ন ফুটো দিয়ে ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পড়বে চারিদিকে, তখন … হ্যাঁ ঠিক তখনই রোগী ধপাস!
তারপর তার মাথা থেকে চলে যাবে স্বমেহনের পাগলামি।
মাথার কনজেশন দূর হয়ে গিয়ে পোস্ট অর্গাজমিক শান্তিতে রোগী ক্লান্ত হয়ে নিবিড় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। সে কি শান্তি! ওঁম শান্তি!
আত্মবিশ্বাসী ডারউইন ছাপ ডাক্তার তখন খিল খিল করে হাসতে হাসতে বাড়ির লোকেদের গিয়ে বলবে- ও পাগলা আর স্বমেহনও করবে না। খিঁচুনি এবং খে* দুটোই বন্ধ । আপনার রোগী শান্তিতে ঘুমাচ্ছে । দরকার হলে আবার ব্যবহার করা হবে একই পদ্ধতি।
ফলাফল: যে সব রোগীরা ঘুম ভাঙ্গার পর ওই স্মৃতি কোন ভাবে মনে করতে পারতেন, তারা ভয়ে হোক বা ভক্তিতে হোক বা লুকিয়ে লুকিয়ে স্বমেহন করার লোভে হোক, আর ওই পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিত না। সাফল্য অতএব উদযাপনীয়!
****
ভাবুন, আজকের দিনে যখন কোন মানসিক রোগীকে আধুনিক বিজ্ঞান চিকিৎসা করে, তখন কি অসম্ভব পরিশ্রম করেন তাঁরা।
অথচ বিবর্তিত না হলে এই মহান পদ্ধতিতে আরামসে সব “পাগল”-এর পাগলামি ছুটিয়ে দেওয়া যেত! সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকিয়াট্রি নামক শব্দ, ভারী ভারী অসুখের নাম- সব লোপাট করে দেওয়া যেত অনায়াসে। আশা করি- পাঠকবর খানিকটা চক্কর অনুভব করছেন এতোক্ষণে। করাই স্বাভাবিক।
আসুন। আপনাকে শেষ চক্কর দিয়ে এই ঘনচক্কর চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে লেখা শেষ করি।
যে ডারউইনের কথা এতোক্ষণ লিখলাম, তিনি চার্লস ডারউইন নন!!
তবে কেন এতোক্ষণ ধরে ডারউইন ডারউইন করে চক্কর দিলাম?
বলেই ফেলি- এই ডারউইনের পুরো নাম ইরাসমাস ডারউইন!
এবং ইনি হলেন আমাদের পরিচিত চার্লস ডারউইনের আপন ঠাকুরদা!!
চলুন, এবার সবাই মিলে ঘনচক্কর সিনেমাটা দেখে ফেলি। ওখানেও ইমরান হাশমি মাথায় আঘাত পেয়ে কেমন যেন পাগল পাগল (রেট্রোগ্রেড অ্যামনেসিয়া) হয়েছিল না?
ওনাকে দিয়েই শুরু করি ঘনচক্কর চিকিৎসার নতুন ভার্সন!!
ছবি: সংগৃহীত