আলিপুরদুয়ার স্টেশনে নেমে গাড়িতে চলেছি ঘণ্টা দুয়েক হল। গন্তব্য সাউথ রায়ডাক জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত শতবর্ষ পুরনো রায়ডাক বনবাংলো। ধূ-ধূ মাঠ, ধানি জমি, ছোট-ছোট জনপদ পেরিয়ে এক সময় পৌঁছলাম শামুকতলা হাটে। এখান থেকে রেশন নিয়ে যেতে হবে বাংলোয়। কী নেই সেই হাটে? মাটির কলসি, ধামা, কুলো থেকে শুরু করে টাটকা সব্জি, মাংস, হরেক রকম মাছ ( শুঁটকি মাছ অবধি), চাল, ডাল, মসলাপাতি, ছাপা শাড়ি, গরম জিলিপি, শিঙাড়া পর্যন্ত। রেশন নিয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসা।
মন্দস্রোতা রায়ডাক নদীর উপর ছোট কাঠের সাঁকো পেড়িয়ে বক্সা টাইগার রিজার্ভে প্রবেশ। ঝিম ধরা ঘন সবুজের মধ্যে দিয়ে একচিলতে কাঁচা পথ চলে গেছে বাংলো অবধি।
গ্রেট হর্ণবিল আর নানা রঙের প্রজাপতির টানেই এই অরণ্যের কাছে আত্মসমাপন। বাড়তি পাওনা হতে পারে বুনোহাতি আর গাউর। নাম না জানা বুনো ফুলের সুবাস আর পাখির ডাকে পথের প্রতিটা বাঁকে অদ্ভুত রোমাঞ্চ।
এ অঞ্চলের অরণ্যে মূলতঃ শাল-সেগুনেরই দাপট। এছাড়াও আছে আম, জাম, কাঠাল, শিমূল, আমলকি গাছের সমারোহ।
ফরেস্ট বাংলোয় যখন পৌঁছলাম খিদেয় পেট চুঁইচুঁই। আগে থেকেই কেয়ারটেকারকে জানিয়ে রাখা ছিল দুপুরের খাবার কথা। গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে ডাল, আলুপোস্ত, দেশি মুরগির ঝোল আর পেঁপের চাটনি।
কাঠের দোতলা বাংলো, ওপরে দুটো বড় ঘর, কাঠের পালঙ্ক, আরাম কেদারা।নিচে প্রশস্ত ডাইনিং হলে ডাইনিং টেবল, ফ্রিজ, ফায়ার প্লেস, দেওয়ালে বাঘ শিকারের ছবি।
খাওয়া দাওয়া সেরে বিট অফিসারের সাথে আলাপ জমালাম। অল্পবয়সী সপ্রতিভ যুবক। উনিই জানালেন দিনকয়েক আগে একটি লেপার্ড কাছেই রাভা বস্তি থেকে একটা ছাগল তুলে নিয়ে গেছে।
বিকেলবেলায় বিটবাবুর ঠিক করে দেওয়া বন্দুকধারী গার্ডকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম জঙ্গলের আরও ভেতরে যাবার জন্যে। গহন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে দেখা পেলাম বুনো শুয়োর, বনমোরগ আর ময়ূরের। টিঁ টিঁ শব্দে একঝাঁক টিয়া উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। জঙ্গলের গাছগুলোতে মৌমাছির বিশাল বিশাল চাক। মাথার উপর হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ আর কানের কাছে গার্ডের ফিসফিসানি -“মেডাম, বড়া পন্ছি” ! মাথা তুলে একঝলক দেখা মিলতেই নিমেষে মিলিয়ে গেল ওপাশের জঙ্গলে। এক জোড়া ইন্ডিয়ান গ্রেট হর্ণবিল। ফিরতি পথে চাঁদ উঠে পড়ল আকাশে। মায়াবী চাঁদনী আলোয় শাল-সেগুনের বনে কাদের যেন অস্ফুট সংলাপ। দূরে অস্পষ্ট পাহাড় আর লাখ জোনাকির ওড়াওড়ি।
সন্ধেবেলায় ব্যালকনিতে বসে চা আর পকোড়া-মুড়ি সহযোগে আড্ডা আর গান। শতবর্ষ পুরনো এই বাংলোর প্রতিষ্ঠাতা সাহেব নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন এই নিরালা অরণ্যে দিনের পর দিন থাকার হতাশা সহ্য করতে না পেরে।
রাত বাড়তেই অন্ধকার গাঢ় হয়। সঙ্গে গা ছমছমে ভাবটাও। কাঠের সিঁড়িতে ও কার পায়ের শব্দ? শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে শুরু করেছে হিমেল স্রোত।