বাড়িতে দীর্ঘ ছয়- সাড়ে ছয় ঘণ্টার চেম্বার শেষ করে আমরা চারজনে একসাথে বসে মুড়ি আর চা খাই। চারজন বলতে আমি আর আমার তিন অ্যাসিস্ট্যান্ট- সঞ্জয়দা, গৌর আর পার্থ।
কোনো দিন মুড়ির সাথে শিঙাড়া থাকে, কোনো দিন ঘুগনি চেনাচুর, কোনো দিন আবার পানতুয়া- রসগোল্লা- নারকেল কোরা। খেতে খেতে আমরা বিভিন্ন জরুরী বিষয়ে আলোচনা সেরে নি। পরবর্তী দিনের ট্যাকটিস ঠিক করি।
আজ মুড়ি খেতে খেতে সঞ্জয়দা বলল- ‘যাহ্, একটা জিনিস একেবারে ভুলে গেছি। দাদা, আপনার এক রোগিণী মারা গেছেন। তাঁর মেয়ে ফোন করেছিলেন।’
রোগীর মারা যাওয়ার খবর শুনলেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে। প্রশ্ন করলাম, ‘বয়স কতো?’
‘কার বয়স দাদা?’
‘কার আবার! যিনি মারা গেছেন তাঁর।’
সঞ্জয়দা বলল, ‘রোগিণীর বয়স তো জিজ্ঞেস করিনি।’
বললাম, ‘বাড়ি কোথায় সেটা জেনেছো?’
‘আশেপাশেই থাকেন বললেন। সাড়ে তিনটে নাগাদ ফোন করেছিলেন। আমি বললাম, চারটে নাগাদ ডাক্তারবাবু ফ্রি হলেই আপনাকে ফোন করে নিচ্ছি। ডাক্তারবাবু মনোরমার চেম্বারে যাওয়ার আগে ঘুরে যাবেন।’
পার্থ বলল, ‘চলুন স্যার, আপনি আর আমি ঘুরে আসি। আজ ডেথ কনফার্ম করাটা ভালো করে শিখে নেব।’
সঞ্জয়দা এক মনে ফোনের কললিস্ট ঘাঁটছিল। সেদিকে তাকিয়েই বলল, ‘একটা মুশকিল হয়েছে দাদা। সাড়ে তিনটের পর থেকে চারটের মধ্যে অন্তত গোটা কুড়ি ফোন ঢুকেছে। বেশিরভাগই নাম লেখার জন্য ফোন করেছে। কোনটা যে ওনার নাম্বার বুঝতে পারছি না। দাঁড়ান, ট্রু কলারে দেখি। নামটা কি যেন বলেছিলেন, এটাই হবে মিতা বিশ্বাস। ৩টে ৩৩ শে ফোন করেছেন।’
সঞ্জয়দা ফোন করল, ‘হ্যালো দিদি, আমি ডাক্তার ভৌমিকের অ্যাসিস্ট্যান্ট সঞ্জয় বলছি। আচ্ছা, আজ কী আপনার মা মারা গেছেন?’
ফোনের ওপারে ভদ্রমহিলার উত্তেজিত স্বর আমরা স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ‘কী যাতা বলছেন। ফোন করে আমার সাথে মশকরা করছেন। তাও এমন নিদারুণ মশকরা।’
সঞ্জয়দা বিপন্ন মুখে বলল, ‘সরি দিদি, আসলে কারও একজনের মা মারা গেছেন, ফোন করেছিলেন। তাঁর নাম্বারটা খুঁজছি।’
ফোন কেটে সঞ্জয়দা পরের নম্বরে ফোন করল। এবার বেশ সাবধানী, ‘হ্যালো দাদা, আপনার মা কী বেঁচে আছেন?’
ফোনের ওপারে একটি পুরুষ কণ্ঠস্বর শুনলাম, ‘কি ব্যাপার সঞ্জয়দা, তুমি ফোন করে আমার মায়ের খবর জিজ্ঞেস করছো? আমি গাড়ির গ্যারেজের নজরুল। কাল ডাক্তারবাবুকে দেখাবো বলে ফোন করেছিলাম। নামটা লিখেছো তো?’
সঞ্জয়দা বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নাম লিখেছি। সরি ভাই। অন্য একজনকে ফোন করতে গিয়ে তোমাকে ফোন করে ফেলেছি।’
সঞ্জয়দা ফোনের কল লিস্ট দেখতে দেখতে বলল, ‘শিওর এটাই হবে। হ্যালো দিদি, মানে ইয়ে… আপনি কি কারও মৃত্যুর জন্য মানে আপনার মায়ের মৃত্যুর জন্য… ইয়ে করেছেন?’
মহিলা কণ্ঠ হুনতে পেলাম, ‘আপনি কে বলছেন? কাকে চাইছেন? আমার মা তো বহুদিন গত হয়েছেন। সে খবরে আপনার কী দরকার?’
‘সরি দিদি, মনে হচ্ছে ভুল নাম্বারে ফোন করে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না।’
বললাম, ‘সঞ্জয়দা, তুমি যাতা শুরু করেছো। এবারে লোকে তোমায় পিটবে।’
গৌর এতক্ষণে মুখ খুলল। বলল, ‘তুমি ওভাবে ফোন করছো কেন? ফোন করে আগে জিজ্ঞেস করো ডাক্তারবাবুর চেম্বারে আপনি কি জন্য ফোন করেছিলেন? নাম লেখানোর জন্য? নাকি অন্য কারণে?’
সঞ্জয়দা তাই করল। ‘হ্যালো দাদা, আপনি ডাক্তারবাবুর চেম্বারে কেন ফোন করছিলেন? নাম লেখানোর জন্য?’
‘ডাক্তারবাবুর চেম্বার…? কই নাতো। আজ তো কোনো ডাক্তারবাবুকে ফোন করিনি।’
‘ফোন করেননি মানে, শিওর করেছেন। আমি তো কল ব্যাক করেছি। ডাক্তার ভৌমিকের চেম্বারে ফোন করেছিলেন।’
‘ডাক্তারবাবুর চেম্বার? ডাক্তারবাবু কী আছেন? ওনাকে একবার দেওয়া যাবে? একটু দরকার আছে?’
সঞ্জয়দা ফোনটা আমার হাতে দিল। বললাম, ‘হ্যালো আমি ডাক্তারবাবু বলছি। কী বলবেন বলুন।’
‘হ্যাঁ স্যার, মানে স্যার আপনি যদি কোনো হোম লোনের ব্যাপারে আগ্রহী হন, মানে যে কোনো ব্যাংকের… এইচডিএফসি, অ্যাক্সিস… যে কোনো ব্যাংকের… মাত্র দুদিনে করিয়ে দেব।’
বললাম, ‘দেখুন আমরা একটা সমস্যার মধ্যে আছি। একজন মারা গেছেন, আমরা তাঁকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি। ছটার মধ্যে তাঁকে খুঁজে বার করে ডেথ সার্টিফিকেট না দিতে পারলে আজ রাত্রে তাঁর আর চিতায় ওঠা হবে না। কারণ ছটার সময় আমি আরেকটা চেম্বারে ঢুকে যাব। এই সমস্যার মধ্যে আপনি দয়া করে লোনের প্রসঙ্গ আনবেন না।’
‘তাহলে স্যার, একটা ক্রেডিট কার্ড…’
ফোন কেটে বললাম, ‘সঞ্জয়দা, দেখো তুমি কী ব্লান্ডার করেছো।’
সঞ্জয়দা আবার ফোনের কললিস্ট খুলল। বলল, ‘ঐ ভদ্রমহিলা তো নিজেই আরেকবার ফোন করতে পারেন। দায়টা আমার নাকি? হ্যালো… আপনি কী আজ ডাক্তার ভৌমিকের চেম্বারে নাম লেখানোর জন্য ফোন করেছিলেন?’
‘হ্যালো… কে সঞ্জয়দা, নাম আর কার জন্য লেখাবো? যার জন্য লেখাতাম তিনিই তো চলে গেলেন।’
সঞ্জয়দা অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বলল, ‘যাক বাঁচলাম… তাহলে আপনার মা’ই মারা গেছেন?’
ভদ্রমহিলা বিস্মিত এবং সম্ভবত ব্যথিতও হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, তিনটের সময়। কিন্তু…’
আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘সঞ্জয়দা, মায়ের বয়সটা জিজ্ঞেস করো?’
‘হ্যাঁ দিদি, যিনি মারা গেছেন তাঁর বয়সটা কতো? পঁচানব্বই? ইয়ে দিদি আপনার বয়সটা… মানে আপনি কী… ওহ ওনার নাতনি… বাহ বাহ বেশ ভালো…’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘তুমি দয়া করে ঠিকানাটা শোনো। আমি আর পার্থ টুক করে ঘুরে আসি।’