ফেসবুকের বন্ধু/গুরুজনেরা বলছেন আজকাল আমার লেখায় বড্ড বেশি বিষাদ থাকে।
অস্বীকার করি না, থাকে। আজ বলে নয়, চিরদিনই। ইদানীং হয়ত একটু বেশি। নিজের চারিত্রিক অনপনেয় ত্রুটি লুকোতে চেষ্টা করি যত, তত চেষ্টা করি না বিষাদ লুকোতে।
সতত সুখের উদযাপনের অপর্যাপ্ত মালমশলা হয়ত কারোরই মজুদ থাকে না তেমন, কিছুমিছু থাকে। আমার কৃপণ সংসারে সেটুকু কাঁচামালও বাড়ন্ত। বহিরঙ্গে যতই ঝকঝকে হোক, ঘর কিংবা কাজের জায়গা, সর্বত্র গাঢ় হয়ে জমে থাকে বিষণ্ণতার কালিমা।
দিন দুয়েক আগে সন্ধেবেলায় ইমার্জেন্সিতে বসে ছিলাম রুগীর জন্য হাপিত্যেশ করে — সঙ্গী সহকর্মী সিনিয়র ডাক্তার দিদি জয়শ্রীদি।
একটি বছর পনের ষোলোর কিশোরী মেয়েকে নিয়ে মধ্যযৌবনা অবাঙালি মহিলা ঢুকে এলেন ঘরে।
মেয়ের পেটে ব্যথা হচ্ছে দু’তিনদিন ধরে, দেখে দিতে হবে।
আমি উঠলাম। পরীক্ষা করতে করতেই জিজ্ঞাসা করলাম — ডায়রিয়া বা ফুড পয়জনিংএর কোনো উপসর্গ রয়েছে কি না। না, নেই। বমিভাব? রয়েছে, সামান্য। ঋতুস্রাবের দিন কিনা প্রশ্ন করতে মেয়ে মাথা নামালো। না, নয়।
দূরে চেয়ারে বসা জয়শ্রীদির অভিজ্ঞ চোখে মেয়েটির চোখের তলার কালি অন্য কোনো বার্তা পাঠিয়েছিল হয়ত — দিদি হেঁকে বললেন, “সুকন্যা, ডিটেইলসে মেনসট্রুয়াল হিস্ট্রি নাও। আর ক্লোজ ইন্টিমেসির কোয়্যারিও করবে।”
কি ভাল এই ইংরেজি ভাষা — দেখুন্তি, হাগুন্তি, দু’য়েরই লাজ কেমন সুন্দর রক্ষা করে পরম মমতায়।
মেয়েটির মা-কে ঘর থেকে বের করে দিয়ে আমার ঠেট হিন্দিতে প্রশ্নোত্তর চালিয়ে চেনা গল্প উদ্ধার করা গেল। চাচাতো দাদা প্রায়ই জবরদস্তি করে থাকে, মাকে জানানো সত্ত্বেও মা আমল দেয়নি, বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে পরে —
হয়নি। সর্বশেষ ঘটনা মাস দেড় দুই আগের। তারপর থেকে ‘শরীর খারাপ’ হয়েছে কি না মনে করতে পারছে না সে। তবে, দিন পনের কুড়ি আগে একদিন হয়েছিল। দেখা দিয়েই বন্ধ হয়েছিল রক্ত। ঘিনঘিনে ব্যথাটার শুরু সেইদিন থেকেই কিনা জিজ্ঞাসা করতে নতমুখী মেয়েটি কোনোক্রমে ঘাড় নাড়ে — হ্যাঁ।
বুঝলাম, ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং, ভ্রূণ জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত হবার মুহূর্তের সামান্য রক্তপাত।
কিন্তু তারিখগুলো গুলিয়ে ফেলছিল মেয়েটি। মিলন, অনিয়মিত ঋতু, পেটব্যথা — হিসেব মেলাতে অসুবিধে হচ্ছিল আমাদের। এদিকে মেয়ে অশিক্ষিত নয়, ক্লাস নাইনে পড়ে স্থানীয় স্কুলে। নিয়মিত জুলুমের বিচার বাড়িতে না হয়ে থাকলে, স্কুলে দিদিমণিদের কেন জানায়নি, তার উত্তরে একটু থমকে মাথা নামিয়ে বলেছিল, ম্যামরা বলেন — ‘ঘর কা ঝমেলা ঘর মে হি মিটাকে আনা, স্কুল মে তঙ্গ মৎ করনা’ —
গ্রামে গ্রামে সরকারি স্কুলগুলোতেও যেখানে চাইল্ডলাইনের সহায়তা পাওয়ার হাজারো ব্যবস্থা থাকে, সেখানে শহর কলকাতার বুকে কোনো স্কুলে (হোক না সে বেসরকারি) শিক্ষিকাদের এমন উচ্চারণ বিস্মিত করে বৈকি!
মেয়েটির মাকে ডাকা হয়। তিনি সব শুনে প্রত্যাশিতভাবেই মেয়েটির উপর চড়াও হ’ন মারধর করার অভিপ্রায়ে। তাঁকে থামিয়ে পিজি হাসপাতালের গাইনি ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যেতে বলি সন্তানকে, কারণ আমাদের এই পুর হাসপাতালটিতে স্ত্রীরোগ বিভাগটাই নেই।
তার মা বলেন প্রেসকৃপশনে আমি যেন কিছু না লিখি, তিনি নিজেই মেয়ের ‘বন্দোবস্ত’ করবেন। যদিও এই রকম পেট দর্দ তাঁর মেয়ের হামেশাই হয়ে থাকে, সুঁই লাগালেই কমে যায়, এইসব বলে আমাদের ডায়াগনসিসের উপর মাতৃদেবীটি অনায়াসেই তাঁর অনাস্থা প্রকাশ করে বসেন।
এমনিতে শান্ত মানুষ জয়শ্রীদি এবার ক্ষেপে ওঠেন দস্তুরমতো। বাইরের দোকান থেকে আনানো হয় প্রেগন্যান্সি কার্ড — স্ত্রীরোগ বিভাগ নেই বলে এই হাসপাতালে লভ্য নয় সেটি।
প্রস্রাব পরীক্ষা করে দুটি নিশ্চিত দাগ দেখানো হয় মা-কে। এইবারে ভেঙে পড়েন তিনি। আর আমার চোখ গিয়ে পড়ে মেয়েটির দিকে।
এখনো পর্যন্ত চিত্রটি পরিচিত। ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সে’র বিষয়বস্তু হিসেবে দিস্তে খানেক লিখে নামিয়ে ফেলার মতো ‘কমন টপিক’।
সাধারণ অবস্থায় মায়ের এই হাহাকার মেশানো কান্নার সঙ্গে নির্যাতিত মেয়েদের অসহায় অশ্রুও মেশে।
কিন্তু আমি ধাক্কা খেলাম এই মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে। অপ্রত্যাশিত সংবাদের অভিঘাতের, নিবিড় দুঃখের, চরমতম বিপন্নতার সম্মুখীন হওয়ার ভয়ের লেশমাত্রও নেই সেখানে। এ ধরনের বিপদের মুখোমুখি হয়ে শোকে পাথর হয় কেউ কেউ — সেই ভাবলেশহীন নিরাসক্তিও নেই তার মুখে। চোখে জল নেই, চাপা আনন্দের চিকমিক রয়েছে। আছে স্বেচ্ছারমণের স্বাভাবিক পরিণতির সাফল্যের তৃপ্তির আভাস।
আমার মনে হলো, মেয়েটি বহু তথ্য গোপন করে গিয়েছে, আমাদের কাছে তো বটেই — হয়ত তার মায়ের কাছেও। ‘জবরদস্তি’টা দ্বিপাক্ষিক সহমতের ভিত্তিতেও হওয়া সম্ভব বলে আমার মনে হচ্ছিল। নয়ত, চিকিৎসকের কাছে এসে ইচ্ছাকৃতভাবে মাসিক বা যৌনমিলনের দিনক্ষণ গুলিয়ে দেবার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চেষ্টা একটি পনের বছরের মেয়ে করবে, এমন ভাবতেও মন নারাজ হয়ে ওঠে।
জয়শ্রীদি বহুদিন লিলুয়া হোমে কর্মরত ছিলেন, এই ধরণের অনেক ঘটনা দেখেছেন। এর চেয়েও বীভৎস, নারকীয় ঘটনা আর তার শোচনীয় পরিসমাপ্তিরও সাক্ষী তিনি। আমাকে বলছিলেন সেসব দিনগুলোর গল্প, কিন্তু আমার কানে কিছুই ঢুকছিল না। শুধু মেয়েটির ঐ অদ্ভুত দৃষ্টিটার কথা মনে পড়ছিল, আর কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম ভিতরে ভিতরে, আঁধার হয়ে আসছিল অন্তরমহল।
আমি ঘোরতর প্রাচীনপন্থী ব্যক্তি — এখনো মাঝেসাঝে অভিনেত্রী বা লেখিকা শব্দগুলো অবলীলায় উচ্চারণ করে ফেলি, সোশ্যালি আনঅ্যাক্সেপ্টেবল জেনেও, আন্তরিক ঘৃণা করি মদ্যপান/ধূমপানকে, প্রকাশ্যে শাড়ি ছাড়া অন্য পরিধেয়র কথা চিন্তাও করতে পারি না (আমার শাড়ির বাঁধনের দৈর্ঘ্য দেখে উত্তরবঙ্গের এক সহকর্মিণী বলেছিলেন, শাড়িটা গলার লেভেল থেকে পরতে পারতে তো!)
অল্পবয়সের কিছু সমাজবিরুদ্ধ কৃতকর্মের জন্য এই পড়ন্ত বেলাতেও ক্ষমা করতে পারিনি নিজেকে — এতটাই রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন আমি। কিন্তু এই প্রবল সামাজিক শুচিবায়ুগ্রস্ততার জন্য বিন্দুমাত্রও লজ্জিত নই। তাই বোধহয় নাবালক বয়সে সমাজ অননুমোদিত নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ককে মেনে নেবার মতো ঔদার্য দেখাতে পারেনি মন, বরং ভরে গিয়েছে গভীর বিষাদে।
প্রযুক্তি সহজলভ্য, শারীরিক সুখনিবৃত্তি আরো সহজলভ্য, কেবল নিজেকে সম্মান করার, ভালবাসবার শিক্ষাটি সহজলভ্য নয়। জেন নেক্সট-এর বিদ্রূপের পাত্রী হওয়ার দায় মাথা পেতে নেব এই গোঁড়ামির অকুন্ঠ প্রকাশের পরে, মনের আঁধার গভীরতর হবে।
শীতের অবেলায় স্নান সারব, মুখে ঘষব ক্রিম, ভাতের পাতে মেখে নেব ফুলকপি দিয়ে ভেটকিমাছের রসা, রবিবারের অবসরে মরা রোদ চোঁয়ানো আকাশের নিচে শুকোতে বসব ভিজে চুল —- সন্ধের সিরিয়াল দেখে চোখে জল আসবে —- মা চলে যাওয়ার আগে এগুলোই দেখত বসে বসে, সেই কথা মনে পড়বে বার বার। অকাজের অবসরে আনমনে হাত বুলিয়ে নেব অ্যাকুচেক গ্লুকোমিটারটার গায়ে — নিত্য পরীক্ষার ফলে স্ট্রিপ ঢোকানোর জায়গাটায় রক্ত লেগে শুকিয়ে রয়েছে — মায়ের রক্ত, আমার উত্তরাধিকার।
আমার মা-ও ঠিক আমারই মতো গোঁড়া, রক্ষণশীল ছিল যে!
বিষাদ আমার শব্দমালাকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে, বিনুনিতে জড়ানো গোড়ে মালার মতো।
এই বিষাদ সিন্ধু পার হবার নোয়ার তরীটি কই? কেউ সন্ধান পেলে জানাবেন তো!