১৯৭০ সালের ৬ই নভেম্বর ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সভায় নিজের হাতে নোট নিতে গিয়ে সিআইএ ডিরেক্টার রিচার্ড হেল্মস লিখছেন, “প্রেসিডেন্ট নিক্সন বললেন যে আলেনদেকে গদি থেকে সরাবার যদি কোনো রাস্তা থাকে তাহলে এক্ষুনি সেটা নিয়ে ফেল”।
মহা শক্তিধর আমেরিকা কেন আলেনদে নামক এক ব্যক্তিকে গদি থেকে সরানোর জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল সেটা জানতে হলে আলেনদে কে ছিলেন তা একটু জানা দরকার।
ডাঃ সালভাদর আলেনদে (উচ্চারণে আয়েন্দে) ছিলেন একজন প্যাথলজিস্ট, ১৯৩৯ সালে। তাঁর দেশ চিলির নব নির্বাচিত পপুলার ফ্রন্ট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রকে জমা দেন তাঁর রিপোর্ট। এর ভিত্তিতে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত বই, “দ্যা চিলিয়ান মেডিকো সোশ্যাল রিয়েলিটি”। রোগ ব্যাধি মৃত্যুর সামাজিক নিরূপক উপাদান হিসেবে আরেক প্যাথলজিস্ট রুদলফ ভীর্ষ এর হাত ধরে ইউরোপ মহাদেশে “স্যোশাল মেডিসিন” নামে বিজ্ঞানের যে শাখার জন্ম, সেই বিজ্ঞান গোটা ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশে শিকড় গেঁড়ে বসে ডাঃ আলেনদের হাত ধরে।
আগে আলোচিত হয় নি এমন সব বিষয় নিয়ে আলেনদে তাঁর গবেষণা চালান। তার মধ্যে আছে শ্রমজীবী মহিলাদের ইললিগাল এবরশন, এন্টিবায়োটিক চিকিৎসার আগের জামানায় পরিবেশের উন্নতির সাথে টিবি রোগের প্রকোপ এর সম্পর্ক, বিভিন্ন ওষুধের জেনেরিক ও ব্র্যান্ড নামের দামের পার্থক্য ও তাতে ফার্মা ইন্ডাস্ট্রির ভূমিকা ইত্যাদি।
রোগ ব্যাধি, ইত্যাদির কারণ খুঁজতে গিয়ে তার মূলে প্রবেশ করে আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উৎস সন্ধানে শুরু হয় এপিডমিওলজিস্ট ডাঃ আলেনদের যাত্রা। মহামারীর পেছনে যে কেবল অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় দেখতে পাওয়া জীবাণু নেই, লুকিয়ে আছে অনাহার, দারিদ্র, অপুষ্টি, অপরিশ্রুত পানীয় জল, অবিশুদ্ধ বাতাস এই সত্য উন্মোচিত হতে থাকে।
ডাঃ আলেনদে উপলব্ধি করেন ও প্রচার করতে শুরু করেন যে মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলির আগ্রাসনের ফলে চিলির প্রাকৃতিক সম্পদ নির্বিচারে লুঠ হয়ে যাওয়ার সাথে সম্পর্ক আছে দারিদ্র্যের, ক্ষুধার, যার সাথে সম্পর্ক আছে স্বাস্থ্যের অবনতির।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আলেনদের এই অভিযান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালো ভাবে নেয় নি। আলেনদে প্রেসিডেন্ট পদ লাভ করার কয়েকদিন বাদে ৩রা নভেম্বর ১৯৭০ রিচার্ড নিক্সন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মিটিং ডাকেন চিলির নবনির্বাচিত সরকারের প্রতি আমেরিকার নীতি ঠিক করার জন্য। যাদের ডাকা হয়েছিল সেই উপদেষ্টাদের মধ্যে কয়েকজন আগেই জানতেন যে সিআইএ প্রচুর টাকা খরচ করে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আলেনদেকে হারাবার বন্দোবস্ত করেছিল যা কাজে দেয় নি। পৃথিবীতে নিজেদের নিও লিবারাল গণতন্ত্রের পূজারী বলে চিহ্নিত করা একটা দেশের রাষ্ট্রনায়করা চক্রান্ত করেছিলেন অন্য দেশের গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে সরিয়ে দেয়ার। সফল হয় নি, তাই এবার তাই নতুন ছক কি কষা যায় তাই নিয়ে মিটিং।
মিটিং এর মিনিটস থেকে জানা যাচ্ছে যে মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট উইলিয়াম রজার্সের সাথে সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স মেলভিন লেয়ার্ডের মধ্যে ঐক্যমত হয়। লেয়ার্ডের ভাষায়, “আলেনদেকে আহত করার জন্য আর টেনে নামানোর জন্য যা পরিকল্পনা করার সবই আমাদের করতে হবে।”
১৯৭৩ সালে সেই পরিকল্পনা সফল হয়। পিনচেত ও সিআইএ বাহিনীর যৌথ আক্রমণের সামনে আলেনদে মারা যান। ল্যাটিন আমেরিকার গণতন্ত্রকে রক্তের স্রোতে ডুবিয়ে দিয়েছিল তথাকথিত গণতন্ত্রের পূজারী আমেরিকা। ফিদেল কাস্ত্রোর কাছ থেকে উপহার এ কে ৪৭ এসাল্ট রাইফেল হাতে রুখে দাঁড়ানো আলেনদের সেই শেষ ছবি।
মহামারী বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ থেকে মার্ক্সবাদী বিপ্লবী ও রাষ্ট্রপ্রধান। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মদতে মৃত্যু। এই মৃত্যুতে গল্পটা শেষ হয়ে গেলে এত কিছু লেখার দরকার হত না।
আজ গোটা পৃথিবী জুড়ে মহামারীর ঘটনা সহ জনস্বাস্থ্যের অবস্থা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে রুদলফ ভীর্ষ, সালভাদর আলেনদের সোশ্যাল মেডিসিন এর সেই বুনিয়াদি তত্ত্ব যে কেবল এন্টিবায়োটিক, পেডিয়াট্রিক ভেন্টিলেটর আর ক্যাথ ল্যাব দিয়ে মৃত্যু ঠেকানো যায় না। পুষ্টি, পানীয় জল, পরিবেশ এই সব এর উন্নতি সমান প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞান আজো অবহেলিত। বাজেট বরাদ্দের সিংহভাগ কেবল ঝাঁ চকচকে হাসপাতাল সাজানোয়। এই মানসিকতার পরিবর্তন কবে হবে কেউ জানে না। চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করে ফেলেছে নিরাময়, কিন্তু টাকার অভাবে সব মানুষ তা কিনতে পারছে না, পঙ্গু হচ্ছে, অকালে মারা যাচ্ছে, আর কিনতে গিয়ে, সাধ্যের বাইরে কিনতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে এই অমানবিক সমাজ ব্যবস্থায়।
১১ই সেপ্টেম্বর কমরেড আলেনদের মৃতুদিবস। আলেনদের চিন্তাভাবনা বেঁচে থাক জনস্বাস্থ্যের আন্দোলনের পাতায়, সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাসের পাতায়। বিশ্ব জোড়া অনাহার, ক্ষুধা, দারিদ্র অসাম্য এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম যতদিন চলবে, ততদিন ডাঃ সালভাদর আলেনদের নাম স্মরণে রাখতে হবে। কারণ অমানবিক পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আলেনদে একটা প্রতিবাদের নাম।
শহীদ কমরেড আলেনদে বেঁচে থাকুন মনের মণিকোঠায়।