(১)
অতীতে বিজেপির এক প্রতিনিধি দলকে বেধড়ক পিটিয়ে এবং শাসক দলের এক মন্ত্রীর ত্রাণ বণ্টন দলকে হেনস্থা করে ত্রাণ লুঠ করে ও এলাকা ছাড়া করে সংবাদের শিরোনামে আসা সন্দেশখালির ‘ বেতাজ বাদশা ‘ ও তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান মাসখানেক আগে আবার সংবাদের শিরোনামে আসেন রেশন দুর্নীতিতে তার ভূমিকা নিয়ে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তার গৃহে তদন্ত করতে গেলে তার হার্মাদ বাহিনীকে দিয়ে ইডি আধিকারিক, আধা সামরিক বাহিনী, সাংবাদিক দের পিটিয়ে এলাকা ছাড়া করার জন্যে।
নির্বাচন থেকে আরম্ভ করে এলাকা বা জমি দখল ‘ এগিয়ে বাংলা ‘ তে এসব এখন আকছারই ঘটে চলেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সবচাইতে অবাক করল দলদাস দুষ্কৃতীবান্ধব রাজ্য পুলিশ বাহিনীর হিমশীতল নিষ্ক্রিয়তা, সরকারের চুড়ান্ত নিস্পৃহতা, কেন্দ্র সরকারের অদ্ভুত নীরবতা, আদালতকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা এবং কিছু শাসক দলের নেতা ও সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট বিদ্দ্বজ্জনদের অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনাটিকে গৌরবান্বিত করার সাথে সাথে দুষ্কৃতীদের মহিমান্বিত করা।
(২)
মাসখানেক ধরে কেবল সময় কাটিয়ে শাসক দল ও শাসকখোসামুদে প্রশাসন যখন সন্দেশখালির ঘটনা অনেকটা ম্যানেজ করে ফেলেছেন তখন সুন্দরবনের সন্দেশখালির প্রত্যন্ত আটটি পঞ্চায়েতের সাধারণ গরীব মানুষ, ভূমিহীন ক্ষেত মজুর প্রমুখরা প্রতিবাদে প্রতিরোধে ফেটে পড়লেন শাসক – মাফিয়া – প্রশাসন – পুলিশ চক্রের বছরের পর বছর সীমাহীন শোষণ, বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে। এর নেতৃত্ব দিলেন দরিদ্র শ্রমজীবী দলিত আদিবাসী মহিলারা। শাসক দলের নেতৃত্বে দুষ্কৃতীদের সংগঠিত আক্রমণ প্রতিরোধ করে শয়ে শয়ে নারী সাবেকি অস্ত্র নিয়ে দুষ্কৃতীদের ঘাটিগুলি, যেখানে এতদিন তাদের সম্ভ্রমহানি করা হত, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করলেন। সন্দেশখালি থানা ঘেরাও করে রাখলেন।
তাঁরা বিচার চাইলেন তাঁদের বংশানুক্রমিক ক্ষুদ্র জমিগুলি যাতে তাঁরা প্রবল ঘাম ঝড়িয়ে দু ফসলী সোনার ধান ফলাতেন, সেগুলি মাফিয়ারা জোর করে কেড়ে নিয়ে নোনা জল ঢুকিয়ে মেছো ভেড়ি করে মুনাফায় লাল হয়ে যাচ্ছে – তার। তাঁদের সরকারি দেয় অর্থ এবং শ্রমের মজুরির টাকা নেতা – মাফিয়া রা বছরের পর বছর আত্মসাৎ করে চলেছেন – তার। দিনের পর দিন পুরুষদের ডেকে নিয়ে গিয়ে শারীরিক অত্যাচার এবং মহিলাদের উপর নির্যাতন প্রভৃতি অপরাধের।
তৃণমূল শাসনে কামদুনি ধর্ষণ কান্ড এবং ভাঙ্গর কৃষক আন্দোলন এর পর এত বড় কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন এবং তাতে ব্যাপক মহিলাদের অংশগ্রহণ ও জঙ্গী মেজাজ যেন কংসারি হালদার প্রমুখের নেতৃত্বে সুন্দরবনের ঐতিহাসিক তেভাগা কৃষক আন্দোলনের ছটা দেখালো। সলিল চৌধুরীর মরমিয়া কাব্যের শহীদ অহল্যা মা যেন চন্দনপিড়ির শ্মশান থেকে পুনরায় আবির্ভূতা হলেন।
(৩)
শাসক দল প্রথমে এটিকে ছোটো করে দেখিয়ে বিজেপি – সিপিএম এর উস্কানি বলে চালিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু যখন দেখা গেল সাধারণ মানুষের মধ্যে এত বিক্ষোভ এবং এটি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে, সব চাইতে বড় কথা অর্থের উৎস ও উন্নয়নের সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই আগামি নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে সস্তা ডোলের বাজেট পেশ করে সর্বময় নেত্রীর যে ঢাকঢোল পেটানো শুরু হয়েছিল, শোষণ ও নারী নির্যাতনের কাহিনীগুলি প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং গরীব শোষিত অত্যাচারিত দলিত আদিবাসী নারীদের আন্দোলন ব্যাপকতা পেয়ে সব যে মাটি হয়ে যাচ্ছে। তাঁর ক্রমাগত অনুপ্রেরণায় এবং তাঁর অনুগ্রহ নির্ভর ‘ বিদ্দজ্জন ‘ ও ‘ বিপ্লবীদের ‘ সমর্থনে মেছো ভেড়ির মজুর থেকে বাম আমলে দুষ্কৃতী হয়ে ওঠা শেখ শাহজাহানদের প্রবল ধনী নেতা – মাফিয়া হয়ে ওঠা, ‘ বাঘ ‘ , ‘ সমাজসেবী ‘, ‘ স্বাধীনতা সংগ্রামী ‘ ইত্যাদি সম্মাননা প্রাপ্তি সব তো উন্মোচিত হচ্ছে। আবদুল বারী বিশ্বাস, আরাবুল ইসলাম, শওকত মোল্লা…. পাশাপাশি এইসব কাহিনীও।
তাই যে পুলিশ শাহজাহান ও তার বাহিনীকে উক্ত অঞ্চলে তাদের সক্রিয়তা বজায় রাখা সত্বেও খুঁজে পায় না, উত্তম সারদার কে থানার মধ্যে আশ্রয় দিয়ে গোপনে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে দেয়, তারাই অতি সক্রিয় হয়ে আন্দোলনকারী দের দমন, আক্রমণ ও গ্রেফতার করতে শুরু করল। কোথাও কোথাও শাসক দলের দুষ্কৃতীদের সঙ্গে নিয়ে। বহু নিরপরাধ মানুষকে গ্রেফতার করে জোরালো কেস দেওয়া হল।
আর রাজ্য সরকার ও জেলা প্রশাসন এতদিন অন্ধ থেকে এখন বিশাল পুলিশ বাহিনী, কমান্ডো ইত্যাদি পাঠিয়ে দ্বীপ গুলিকে ঘিরে, অবরোধ করে, ১৪৪ ধারা জারি করে, ইন্টারনেট ও যান চলাচল বন্ধ করে আন্দোলন আটকানোর উদ্দেশ্যে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলল।
(৪)
পুরনো কাসুন্দি বেশি ঘেটে আর কি লাভ?
কংগ্রেস আমলে ছাত্র যুবদের প্রতিবাদ ধ্বংস করতে বরানগর – কাশীপুর ঘিরে পুলিশ – দুষ্কৃতীরা রক্ত বন্যা বইয়ে দিয়েছিল।
বাম আমলে মরিচঝাঁপির নিরপরাধ উদ্বাস্তুদের এবং নন্দীগ্রামে প্রতিবাদী কৃষকদের পুলিশ ও দুষ্কৃতী দের দিয়ে ঘিরে রক্তবন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তৃণমূল আমলে পুলিশ কে নিষ্ক্রিয় রেখে দুষ্কৃতীদের দিয়ে বগটুই তে রক্তবন্যা বইয়ে দেওয়া হল।
দেখা যাচ্ছে সব আমলেই গরীব কৃষক শ্রমজীবী প্রতিবাদী মানুষ আক্রান্ত। আর সব আমলেই দেখা যায় সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, হয় নীরব অথবা এই সমস্ত অপকর্মের সমর্থক কিংবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, প্যালেস্টাইন বা কাশ্মীরের স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’-এ আগামী ‘রাম রাজত্ব’-তেও কি তারা এরকমই আচরণ করবেন?
১০.০২.২০২৪
বাঃ! রামরাজত্ব এসে গেছে বলে তো প্রকারান্তরে একরকম ঘোষণা-ই করে দিলেন দেখলাম। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট, তৃণমূল সবাইকেই একই গোষ্ঠীর মধ্যে ফেলে দিলেন! এবং আশা প্রকাশ করেছেন যে বিজেপি এই রাজ্যে ক্ষমতায় এলে এই ধরণের কাজ করবেনা। ভাল কথা, আশা নিয়ে বাঁচুন। রঙ বদল একদম সঠিক সময়েই হচ্ছে।