১৯৯৯-২০০০ নাগাদ সল্ট লেক স্কুলের একজন শিক্ষিকার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। উনি ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে নানা অ্যাক্টিভিটি-র একটা গ্রুপ চালাতেন। ডিগবাজি খাওয়া, ছাদে চক দিয়ে আঁকিবুকি কাটা, বর্ষায় পার্কে গিয়ে কাদা-মাটির তাল নিয়ে চপ-কাটলেট বানানো – কিছুই বাকি থাকতো না। আমার মেয়ে যেত সেখানে – খুব আনন্দ করে ফিরত। তাঁদের একটা পত্রিকা বেরোত, অনুরোধ করেছিলেন, আমার স্কুল জীবনের দুষ্টুমি নিয়ে একটা লেখা লিখতে। উদ্দেশ্য ছিল, একজন ডাক্তার যদি স্কুলজীবনে দুষ্টুমি করে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই বাচ্চারা দুষ্টুমি করলেও উৎরে যেতে পারে, সেই শিক্ষা বড়োদের দেওয়া।
শ্রীমতী মঞ্জির ঘোষকে দেওয়া সেই লেখাটা আর নেই, এখানে নতুন করে লিখছি – কাহিনীটা ছিল সঞ্জয়কে নিয়ে। সঞ্জয় আমাদের সবাইকে খুব হাসাত। মহা পাজি ছিল, ক্লাস চলছে, এমন সময় হঠাৎ কিছু একটা সাংঘাতিক হাসির কথা বলত যার ফলে আমাদের গমকে গমকে হাসি বেরোতো, সামলানো যেত না। নিজে গম্ভীর মুখে বসে থাকত। ধরা পড়তাম আমরা, বকুনি খেতাম, শাস্তি পেতাম, সঞ্জয়কে কোনও দিন ধরা পড়তে হয়নি। অথচ, অন্য সময় সঞ্জয় হাসির কিছু হলে খুবই হাসত। রামগড়ুরের বংশধর নয়।
জানতে চেয়েছিলাম। “হ্যাঁ, রে, না হেসে থাকিস কী করে?”
বলেছিল, “দেখবি, ক্লাসে কিছু একটা ঘটলে আমি সঙ্গে সঙ্গে খুব হাসি। সেটা অত বেশি হাসির না হলেও হাসি। তোরা হয়ত টিচারের কথায় কিছু তেমন মজা পেলি না, একটু মুচকি হাসলি, আমি তখন হেসে গড়িয়ে পড়ি। তাই হাসি খরচ হয়ে যায়। পরে সত্যিকারের মজার কথায় হাসি চাপতে পারি।”
চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না। একটা না-হাসির কথায় কী করে অনেক হাসব, আর একটা জেনুইন হাসির কথায় না-হেসে… সে আমি আজও ভেবে পাই না।
সবাই মিলে একদিন ঠিক করলাম, সঞ্জয়কে হাসাতে হবে। কে এই মহান প্রোজেক্টের উদ্যোক্তা ছিল মনে নেই – আমি নিশ্চয়ই না, আমাকে বন্ধুরা বিশেষ ধর্তব্যের মধ্যে আনতো না। কিন্তু এটা মনে আছে, ঠিক হল যে টিফিনের সময় সঞ্জয় খেয়েদেয়ে যখন জল খাবে, তখন ওকে খুব হাসাব। বিষম খাওয়াব।
যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। সঞ্জয় একটা বড়ো জলের বোতল আনতো। দেখতে কেমন মিলিটারি টাইপ। ছাইরঙা কোনও ধাতুতে তৈরি, তার গায়ে সবুজ ফেল্টের খোলস আঁটা থাকত, উদ্দেশ্য গরমের দিনে সেই ফেল্ট ভিজিয়ে নিয়ে ভেতরের জল ঠাণ্ডা রাখা। ওরকম ওয়াটার বটল তখনকার দিনে চলত, কিন্তু সবার ছিল না। আমরা বেশ ঈর্ষা করতাম অমন বোতলের মালিকদের।
ক্লাস ফোরের সেই দৃশ্যটা এখনও দেখতে পাই। সঞ্জয় মাথা উঁচু করে ঢকঢক করে জল খাচ্ছে, আর ওর সামনে একটা সেমি-সার্ক্ল বানিয়ে আমি, অমিত, সোমনাথ, সৌমিত্র – সব্যসাচী ছিল কি? হয়তো ছিল… সবাই নানা কথা বলে, অঙ্গভঙ্গী করে, বিকট শব্দ করে ওকে হাসাবার চেষ্টা করছি।
গম্ভীরভাবে সঞ্জয় জল খাওয়া শেষ করে এক মুখ জল পু-উ-উ-চ করে আমাদের গায়ে পিচকিরি করে ছিটিয়ে দিয়ে বলল, “কী করব? এমন হাসিয়ে দিলি…”