মধ্য যুগের ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ, মানবতাবাদী দার্শনিক, বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার, মরমিয়া সাধক, অহিংস গণআন্দোলনের উদ্গাতা এবং সমাজ সংস্কারক সন্ত রবিদাস (? ১৪৫০ – ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দ) এর জন্ম উত্তর ভারতের বারাণসী অঞ্চলে এক দরিদ্র অস্পৃশ্য চর্মকার (উচ্চ বর্ণ লবজে ‘চামার’ , ‘মুচি’ ইত্যাদি) পরিবারে। তাঁকে আজীবন যেহেতু হিন্দু উচ্চ বর্ণের সামন্ততন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং দিল্লির সুলতানী শাসনের অত্যাচার ও ইসলামি মৌলবাদ কে প্রতিরোধ করে গরীব অন্ত্যজ শ্রমজীবী মানুষের মানব ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে যেতে হয়েছিলো তাই সমকালীন ও পরবর্তী ইতিহাসে তিনি প্রায় অনুপস্থিত। তাই তাঁর সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।
তাঁর পিতা সন্তখ দাস ও মাতা কলসি দেবী। স্ত্রী লনা দেবী ও একমাত্র সন্তান বিজয় দাস। বাল্য থেকে তিনি পৈতৃক চর্মকার পেশা গ্রহণ করেন। পাশাপাশি চলতে থাকে সাধু – সন্ন্যাসী ও সুফি – সন্ত সংসর্গ এবং কাব্য ও সঙ্গীত চর্চা। বলা হয় তিনি ও সন্ত কবীর সন্ত সাধক রামানন্দর প্রধান শিষ্য। এরপর তিনি ভারতের বিভিন্ন তীর্থ ক্ষেত্র ভ্রমণ করেন, চিন্তার ক্ষেত্রে ‘ সগুনা ‘ থেকে ‘ নির্গুনা ‘ পথে বিচরণ করেন এবং মানবতাবাদী ‘ আদি ধর্ম ‘ প্রচার করতে শুরু করেন যা অচিরেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। হিন্দু জাত ব্যবস্থায় নিষ্পেষিত উত্তর ও মধ্য ভারতের বিপুল সংখ্যক দলিত মানুষ তাঁর প্রচারিত ধর্মে সমাবেশিত হন। ‘ আদি গ্রন্থ ‘ ছাড়াও শিখদের পবিত্র ‘ গুরু গ্রন্থ সাহিব ‘ এবং দাদ্দু পন্থীদের ‘পঞ্চবাণী ‘ তে তাঁর বহু বাণী আজও অক্ষয় হয়ে আছে। অনেক বাধা ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির তুঘলাবাদে আদিধর্ম মন্দির গড়ে ওঠে। যা গুরু রবিদাস মন্দির বা গুরুদ্বর হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরবর্তীতে গড়ে ওঠে এবং বারবার বর্ণ শিখ ও বর্ণ হিন্দু দের আক্রমণের শিকার হয়। সাম্প্রতিক উদাহরণ ভারতের দিল্লি ও অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা।
ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জাত ব্যবস্থার শোষণ ও উৎপীড়ন এবং ইসলামী সুলতান শাহির পীড়ন উভয়কে প্রতিরোধ করে সন্ত রবিদাসকে ‘ আদি ধর্ম ‘ প্রচার করতে হয়। তিনি জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা এবং বৈষম্য ও শোষণের বিরোধিতা করেছেন। সমাজে নিম্ন বর্ণ, অস্পৃশ্য এবং নারীর অধিকারের কথা বলেছেন। তাঁর অনুগামী ও অনুসারীরা ‘ রবিদাসিয়া ‘ ধর্ম ও সামাজিক আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। তাঁর অনবদ্য সব কাব্য বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ছাড়াও সাধারণ মানুষের মুখে মুখে যুগ থেকে যুগান্তরে প্রবাহিত হতে থাকে। যেরকম:
“তোমার হৃদয় যদি পবিত্র থাকে
তাহলে তোমার ঘরে ধরে রাখা জলই পবিত্র,
কোন পবিত্র নদীর খোঁজে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।”
কিংবা
“উচ্চ বা নিম্ন বর্ণে জন্মালে ভালো মন্দ নির্ধারিত হয় না,
ভালো মন্দ নির্ধারিত হয় মানুষের কর্মে।”
গুরু নানকের সাথে সন্ত রবিদাসের সাক্ষাত হয় এবং গুরু নানক সন্ত রবিদাসের দর্শন ও বাণীর একাংশ গ্রহণ করেন। পরে শিখ ধর্মী খালসা শিখদের সাথে দ্বন্দ্বে রবিদাসিয়ারা শিখ ধর্মের মধ্যে নিজস্ব পন্থ গড়ে তোলেন। হরির নামাঙ্কিত তাঁদের ‘হর নিশান’ । পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও ভারতের অন্যত্র এবং বিদেশে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলেশিয়া প্রভৃতিতে যেমন শিখ রবিদাসিয়াদের দেখা যায় তেমনই ভারতের সর্বত্র ও বিদেশে হিন্দু ধর্মের দলিতদের মধ্যে রবিদাসিয়াদের দেখতে পাওয়া যায়। মান্যবর মোদিজী ২০১১-এর পর সেনসাস করতে দেন নি। সুতরাং সঠিক চিত্র আরও বেশি সংখ্যায় দাঁড়াবে। যাইহোক, ২০১১-এর তথ্যঅনুযায়ী পাঞ্জাবে সবচাইতে দলিত সম্প্রদায়ের হার বেশি। দলিত মাজহাবী শিখ জনসংখ্যার ২৬.৩৩ শতাংশ। রবিদাসিয়া ১১.১৫, আদিধর্ম পন্থি ১০.১৭, রমদাসিয়া ৯.৬১, বাল্মীকি ৮.৬ শতাংশ। রবিদাসিয়ারা উত্তর প্রদেশে ১১.২৫ (প্রায় আড়াই কোটি), হরিয়ানায় ৯.৫৮, ছত্তিসগড়ে ৯.০৭, মধ্যপ্রদেশে ৭.৩৯, হিমাচল প্রদেশে ৬.৬৮, বৃহত্তর দিল্লিতে ৬.৪, চণ্ডীগড়ে ৫.৬৮, বিহারে ৫, রাজস্থানে ৩.৬৩ শতাংশ সহ সব রাজ্য মিলিয়ে এক বিরাট জনসংখ্যা। অর্থাৎ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক ভোটার।
বিগত পাঁচ শতাব্দীতে পৃথিবী ও মানব সমাজ অনেক আধুনিক হয়েছে। সারা পৃথিবী থেকে ক্রীতদাস প্রথা উঠে গেছে। কিন্তু ভারত থেকে জাত ব্যবস্থা উঠে যায়নি। বরং আর এস এস – বিজেপির এই নতুন হিন্দুত্ববাদী ব্যবস্থায় আরও জাঁকিয়ে বসেছে। দলিত, জনজাতি ও নারীর উপর শোষণ, বৈষম্য ও অত্যাচার বেড়েই চলেছে। কিন্তু ভোট বড় বালাই। একদা বর্ণ হিন্দু পরে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় নিজের ঘঞ্চি মোধ তেলি সম্প্রদায়কে পশ্চাদপদ (OBC) করে তোলা মান্যবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সংসদীয় কেন্দ্র বারাণসীতে এসে জনসভায় সন্ত রবিদাসের মহানুভবতা তুলে ধরে নিজেকে গুরুর অনুগামীদের সেবক হিসেবে অভিহিত করেছেন।
জি ২০ শীর্ষ সম্মেলন থেকে শুরু করে অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধন ও রাম লালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা সহ একের পর এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটিয়েও মান্যবর মোদিজী আগামী লোকসভা নির্বাচনে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। শম্ভু সীমান্তে আটকে রাখলেও একদিকে কৃষক আন্দোলন, অন্যদিকে গান্ধী পরিবার ও কংগ্রেসকে এত অবদমনের পরেও কংগ্রেস চুপচাপ সমাজবাদী পার্টি, আপ, আর জে ডি প্রমুখের সাথে উত্তর প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে আসন সমঝোতা করে ফেলেছে। তাই এতদিন ও এখনও যাদের পায়ের তলায় রেখে দেওয়া হয়েছে সেই দরিদ্র ভূমিহীন শ্রমজীবী অস্পৃশ্য জলঅচল চর্মকর সম্প্রদায়ের ভোটের জন্যে তিনি ও যোগী আদিত্যনাথ বারাণসীতে সন্ত রবিদাসের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তাতে মাল্যদান করেছেন। মধ্য প্রদেশের সাগরে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করে বিশাল চত্বরে নির্মিত হচ্ছে সন্ত রবিদাসের মূর্তি। নির্বাচনের আগে সাময়িক ভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে সন্ত রবিদাস কে পুন:প্রতিষ্ঠা করার সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর কাজ চলছে।
২৪.০২.২০২৪