আইন কি কিছু কম পড়িয়াছে?
চিকিৎসা নিয়ে অসন্তোষ থাকলে আপনি একাধিক জায়গায় যেতে পারেন। প্রথমেই লোকাল পুলিশ থানায় যেতে পারেন।
স্বাস্থ্য কমিশনে অভিযোগ জানাতে পারেন। ডাক্তারের বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ নিয়ে রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলে যাওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশে চিকিৎসা আইনসম্মত ভাবে একটি পণ্য। অতএব ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরেও আপনার জন্য দরজা খোলা। আর কোন পেশায় পরিষেবা প্রদানকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর জন্য এতগুলি জানালা খোলা থাকে জানা নেই। তবু মানুষ কেন আইনসম্মত লাইনে না হেঁটে অস্ত্র তুলে নেন হাতে? শুধুই কি জীবনের চেয়ে দামি আর কিছু হতে পারে না সেই কারণে? না কি এদের নিগ্রহ করলেও অনায়াসে আক্রমণকারীরা পার পেয়ে যান বলে।
স্বাস্হ্যকর্মী নিগ্রহ যে শুধু পশ্চিমবঙ্গে ঘটে তা নয়। অহোরহ ঘটে চলেছে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে, এমনকি দেশের বাইরেও। কিন্তু বিদেশে প্রেক্ষিত আলাদা। কার আইন কতখানি শক্তিশালী জানা নেই। তবে কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত নিরাপত্তা তো যে কোন সভ্য দেশে প্রত্যাশিত।
একজন পদস্থ সরকারী কর্মচারী নিজ অফিস যে নিরাপত্তা পান একজন কর্তব্যরত চিকিৎসক সেটা আশা করতে পারবেন না কেন। গত তিন বছরে এ রাজ্যে তিনশ’র বেশি চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। যার দুই তৃতীয়াংশ সরকারি হাসপাতালে যেখানে কার্যত বিনামূল্যে চিকিৎসা মেলে। স্বাস্হ্যক্ষেত্রে এই নৈরাজ্যের দায় কার? প্রায় একই পরিস্থিতি দেশের অন্যান্য রাজ্যেও। দল মত নির্বিশেষে সব প্রশাসকসই চিকিৎসকদের নিরাপত্তাদানে ব্যর্থ।
গত বছর লকডাউন চলা কালীন তাঁদের উদ্দেশ্যে তালি বাজলো, দিয়া জ্বললো, থালি বাজলো, উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে পুষ্পবর্ষণ হলো। আক্রমণ ঠেকাতে কেন্দ্র সরকারের তরফে কড়া অর্ডিন্যান্স আনা হলো। তিন বছর, সাত বছর, সশ্রম, বিনাশ্রম অনেক কিছু শোনা গেল। তবু তাঁদের অবস্থার কোনো উন্নতি হলো কি? কোভিড ডিউটি করার ‘অপরাধে’ বাড়িওয়ালা ভাড়াটে নার্সকে উৎখাত করেছেন। ডাক্তার কে তাঁর নিজের পড়শীবন্ধুরা পাড়ায় ঢুকতে বাধা দিয়েছেন। তামিলনাড়ুতে কোভিডে মৃত চিকিৎসকের অন্ত্যেষ্টি পর্যন্ত করতে দেন নি স্থানীয় মানুষ। তালিকা দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকরও বটে! মাঝে কয়েকটা মাস মারধর, ভাঙচুর একটু কম ছিল। চিকিৎসকদের কদর বেড়ে গিয়েছিল না কি আক্রমণকারীরা সংক্রমনের ভয়ে ঘরে সেঁদিয়ে গিয়েছিলেন জানা নেই। তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পান্ডুয়া পর্বের পর বলতেই হয় আমরা যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি। চিকিৎসকরা একদিকে রয়ে গেছেন পান্চ ব্যাগ। প্রশাসনের অন্যদিকে একইরকম গা ছাড়া ভাব।
মিডিয়ার একাংশের কথা না বলে পারা যায় না। তাঁদের কৌশলী ব্যবহারে উদ্ধৃতি চিহ্নে ঘেরা “চিকিৎসায় গাফিলতি” এখন এক আটপৌরে শব্দবন্ধে পরিণত। অপ্রমাণিত অভিযোগের কথা যে ভাবে ফলাও করে প্রচার করা হয় তার ছিটেফোঁটা উৎসাহও থাকে না যখন সে অভিযোগ ধুলিস্যাৎ হয় বা অপরাধী শাস্তি পান। সেনশেসনাল হেডলাইন মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে ততদিন স্থান পায় “পাঁচের পাতার সাতের কলমে” বা বেমালুম উধাও। সাংবাদিক চুম্বকিত হন পরের সেনসেশনের দিকে। তা সে ভ্যাকসিন ঘটিত চুম্বকই হোক বা অন্য কোনো নতুন ভুঁয়ো অভিযোগে। সময় এসেছে সমাজের প্রতি আরো দায়বদ্ধ হবার। সত্যের প্রতি তো বটেই।
প্রশাসনিক তৎপরতা কি একেবারে নেই। তা নয়। হেনস্থা ঠেকাতে আবার পৌঁছে গেছে দিল্লীর চিঠি। রাজ্য সরকারও উদ্বাহু। তবে ঐতক। এসে গেছে ক্যুইক রেসপন্স টীম, বিশেষ কন্ট্রোল রুম ইত্যাদি একগুচ্ছ প্রস্তাব। পারবে কি তারা সামনের সারির কর্মীদের মনোবল বাড়াতে? না আঁচালে বিশ্বাস নেই।
সন্দেহবাতিকতার কারণ আছে। আঠারো সনের শেষে রাজ্য পুলিশের সদর দপ্তরে একটি RTI দাখিল করা হয়। সেখানে পূর্ববর্তী বছরে চিকিৎসকদের উপর ঘটে যাওয়া নিগ্রহের খতিয়ান চাওয়া হয়। নিয়মমাফিক উত্তরও আসে। বলা হয় এরকম কোনো ঘটনা পুলিশের গোচরে নেই। অর্থাৎ কাগজে, টিভিতে যে সব ঘটনার কথা বলা হয় তার কোনোটাই নাকি আদতে ঘটে নি। প্রশাসনিক অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলার আরো কারণ আছে। হাসপাতালে বিশৃঙ্খলা মোকাবিলায় আমাদের রাজ্যের হাতে যথেষ্ট কড়া আইন আছে যা মেডিকেয়ার অ্যাক্ট ২০০৯ নামে পরিচিত। এটি একটি জামিন অযোগ্য ধারা। অবাক হয়ে যেতে হয় যখন বছরের পর বছর এই আইন অব্যবহৃত থেকে যায়। বেশির ভাগ সময়েই তদন্তকারী অফিসার এই বিশেষ ধারার ব্যাপারে অবহিত না থাকার অযুহাত দেন।কিন্তু দেশীয় আইন সম্পর্কে খোদ আইনরক্ষকদের এই অজ্ঞতাও কি কর্তব্যে গাফিলতি নয়?
কেন্দ্র সরকার অভিন্ন আইন আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। সাধু উদ্যোগ কিন্তু তার গতি এত শ্লথ কেন। যে সরকার চার ঘন্টার নোটিসে সারা দেশের টাকা ধোলাই করে ফেলেন তাঁরাই আবার দু’বছরেও ডাক্তারদের গণধোলাই প্রতিরোধে আইন আনতে ব্যর্থ হন। কর্মরত চিকিৎসক বা সংশ্লিষ্টদের রক্ষার্থে প্রায় প্রতিটি রাজ্যেরই নিজস্ব আইন আছে। সে সব আইনও যথেষ্ট কড়া কিন্তু অব্যবহারে অশ্রুত। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা এবং যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে। অভিপ্রায়ে ঘাটতি থাকলে হয়তো কিছুই সম্ভব নয়। প্রতিটি হেনস্থাকারী কোথাও না কোথাও আশ্রয় পেয়ে যাবেন।
সঙ্গত কারণেই ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন “সেভ দ্য সেভিয়ার্স” এর ডাক দিয়েছেন। চিকিৎসকেরা কালো ব্যাজ পরে কাজ করবেন। এ ধরণের প্রতীকী প্রতিবাদ আগেও হয়েছে। আবারও হবে। কিন্তু প্রশাসন নড়েচড়ে না বসলে পরিস্থিতি বদলাবে কি? কেউ কেউ জনগণের অসহিষ্ণুতার কথা বলেন। কিন্তু যে দেশের জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে সমস্ত ক্ষোভ নিয়ম মেনে একটি মাত্র ভোটের মারফত প্রকাশ করেন, তাও পাঁচ বছরে মাত্র একটি বার তাঁদের অসহিষ্ণু বলি কোন সাহসে!