অনেকে আমাকে বলেন আমি ডাক্তার হয়েও এত ঈশ্বরবিশ্বাসী কেন। আমি তাদের বলি এই পেশার জন্যই আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে। আমি জানি আমার কাজের জায়গায় আমার দৌড় ঠিক কতোটা অবধি। ঠিক কতোটা অবধি হাত বাড়িয়ে ধরে রাখতে পারব একটা জীবনকে, আর ঠিক কখন মুঠো আলগা হয়ে যাবে।
আমার সার্জারি শেখার হাতেখড়ি উত্তর কোলকাতার খালপাড়ে, আর জি কর হাসপাতালে। সেখানে এম এস করার সময় তিনটে সোনার বছর কাটিয়েছি।
প্রতি সপ্তাহের বুধবার হত আমাদের অ্যাডমিশন ডে, মানে সকালে সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে বারোটা আউটডোরে রুগী দেখ, তারপরে কিছু একটা নাকে মুখে গুঁজে ছোট সিবি ওটিতে, সেটা এমার্জেন্সি বিভাগের গায়েই লাগানো একটা বেশ বড় জায়গা। তার মধ্যে আছে রুগী দেখার জন্য একটা ঘর, একটা অপারেশন থিয়েটার, আর দুটো ছোট ছোট ঘর আমাদের আর নার্সদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।
আর জি কর প্রচণ্ড ব্যস্ত একটা হাসপাতাল, উত্তর আর দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার অনেকটা জায়গা থেকে রুগী আসে। তাই আমাদের কাজটাও ছিল খুব পরিশ্রমের। বিকেল তিনটে নাগাদ অপারেশন শুরু হত। একের পর এক, অবিরাম চলতে থাকত। ভোরের দিকে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ঘন্টা দুয়েক একটু শুতাম, তারপরেই আবার ওয়ার্ড রাউন্ড।
তবে সত্যি বলতে কি এই কাজে আমাদের কোন অভিযোগ ছিল না, অপারেশন করাটা একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। প্রতিটা শরীর একটা আলাদা চ্যালেঞ্জ। সেই নেশাতেই বুঁদ হয়ে থাকতাম।
২০১৪ র সপ্তমীর দিন, আমি তখন ফাইনাল ইয়ার। নিজেকে একটা হনু ভাবতে শুরু করেছি। আর কয়েকমাস পরেই ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বিশ্বজয় করতে বেড়িয়ে পড়ব।
পুজোর দিনগুলোতে স্বাভাবিক ভাবেই ভীড় একটু কম থাকে। তখন সন্ধ্যেবেলা। আমরা পাঁচ ছয়জন গোল হয়ে বসে গল্প করছি। জুনিয়র ইন্টার্নরা ব্যস্ত ছোটখাটো কাটা ছেঁড়া মেরামত করতে। এমন সময় হাউজস্টাফ অমিত এসে খবর দিল এক্ষুনি একটা রুগীকে দেখতে হবে, খুব আর্জেন্ট!
বেচারাম সরকারের বয়স ষাটের কাছাকাছি। বাড়ি ক্যানিংয়ের একটা ছোট্ট গ্রামে। ভাগচাষী। চিংড়ির চাষ করে। এদের তো আর পুজোর ছুটি নেই। কাজ না করলে খাবে কি? তাই ভোর ভোর বেড়িয়ে পরেছিল ভেড়ির দিকে। দুপুরের দিকে বাড়ি আসছিল খাবে বলে, এমন সময় সামনে পরে যায় একটা পাগলা ষাঁড়ের।
তারপর?
তারপর আবার কি? ষাঁড় দিল গুঁতিয়ে। বেচারামের বাড়ির লোক আর পাড়া প্রতিবেশী গ্রামের হাসপাতাল ঘুরে নিয়ে এল আরজিকরে।
বেচারামকে যখন প্রথম দেখলাম তখন ও পেটে একটা গামছা চেপে কুঁকড়ে শুয়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গামছাটা। পাশে ওর স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। কেঁদেই চলেছে সে।
ষাঁড় তাহলে গুঁতোটা মেরেছে পেটে। ইন্টার্নরা যখন দ্রুত স্যালাইনের বোতল ঝোলাতে আর রক্তের আয়োজন করতে ব্যস্ত তখন আমি আর আমার জুনিয়র সার্জারির ট্রেনিরা খুব সাবধানে গামছাটা সরাতে লাগলাম। সাথে অনেকখানি গজ, আরেকটা আর্টারি ফরসেপ্স। ফিনকি দিয়ে বেরনো কোন রক্তের স্রোত দেখলেই টুঁটি চিপে ধরতে হবে তার।
নাহ, রক্ত পড়ছে না আর। তলপেটের ডানদিকের অনেকটা জায়গা জুড়ে জমাট বেঁধে আছে এখন। তবে ক্ষতটা দেখে চিন্তায় পড়লাম।
ষাঁড়ের শিংটা অনেকটা ভিতরে ঢুকে গেছিল মনে হচ্ছে, সেই শিংয়ের ডগা নাড়িভুঁড়ি ফুটো করে দিতেই পারে। তাতে পেটের ভিতরে রক্তপাত হবে। বাইরে থেকেও বোঝা যাবে না। তার সাথে নাড়ির ভিতরের খাবারের অংশ বাইরে বেড়িয়ে বিষিয়ে দেবে পেটের ভিতরটাকে।
একটা সিটি স্ক্যান করে দেখে নেওয়াই যায়, কিন্তু তাতে যে সময় লাগবে তার মধ্যে শরীরের মধ্যের রক্তপাতের চোটে বেচারাম মারা যেতে পারে। তাহলে উপায় কি?
উপায় একটাই, বেচারামকে থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে ওর পেটটা খুলে দেখা। আমরা ডাক্তারিতে একে এক্সপ্লোরেটরি ল্যাপারোটমি বলি। ভজ-ঘট শুনতে লাগলেও আসলে ব্যাপারটা খুব সোজা সাপটা। রুগীর পেট লম্বালম্বি কেটে দেখা ভিতরে কিছু হয়েছে কিনা। এক্ষেত্রেও সেটাই লক্ষ্য, যদি রক্তপাত হয় তাহলে সেটাকে বন্ধ করা। আর যদি কোন নাড়ি ফুঁটো হয় তাহলে সেটাকে সারানো।
মুশকিলটা হল বেচারামের স্বাস্থ্য নিয়ে। একদম রোগা, অপুষ্টিতে ভোগা। এই শরীর এত বড় একটা অপারেশনের ধকল নিতে পারবে তো? রক্তক্ষরণও হয়েছে অনেক। অপারেশন টেবিলেও মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বেচারামের স্ত্রীকে এই কথা গুলো বলতেই সে আমার হাত দুটো ধরে ফেলল,- আমার স্বামীই আমার সব বাবু, ও একাই রোজকার করে আনে। দুটো মেয়ে আছে বিয়ে হয়নি। আপনার পায়ে পড়ি ওকে আপনি বাঁচিয়ে দিন।
বাঁচা মরার খেলাটা যে এই আঠাশ বছরের বাবুটির হাতে নেই সেটা ওনাকে তখন বোঝাই কি করে। আমরা ল্যাটিন শব্দ আওড়ে রুগীকে তাক লাগিয়ে দিতে পারি, কিন্তু বিশ্বাস করুন অপারেশন টেবিলে একবার পেট খোলার পরে যা দেখি তা মেরামত করার চেষ্টা করি যথাসাধ্য। বাকিটা আমরা সত্যি জানি না।
বেচারামের স্ত্রীকে যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বাইরে রেখে বেচারামকে নিয়ে এলাম ওটি-র মধ্যে। ইন্টার্ন ভাইরা দৌড়াদৌড়ি করে এরই মধ্যে তিন বোতল রক্তও জোগাড় করে ফেলেছে। অ্যানাথেটিস্টও দ্রুততার সাথে বেচারামকে অজ্ঞান করে ফেললেন।এবারে সবটা আমাদের হাতে। মানে আমি, আমার স্যার আর একজন জুনিয়র ট্রেনি।
বুকের নিচ থেকে নাভির অনেকটা নিচ অবধি লম্বালম্বি করে কেটে ফেললাম পেটটা। এতে সময় লাগে মিনিট পাঁচেক। তারপরে খোঁজার পালা।
নাহ, যেটা ভয় করছিলাম সেটা নয়। শিংটা পেটের মাংসকে ভেদ করলেও তার নিচের আচ্ছাদন যাকে পেরিটোনিয়াম বলে তাকে ফুঁড়ে যেতে পারেনি। অর্থাৎ ভিতরের নাড়ির কোন ক্ষতিই হয়নি। যাক, এই যাত্রায় বেচারাম বেঁচে গেল। এখন পেটের বাইরের ওই ক্ষতটা ভাল করে ধুয়ে মেরামত করে দিলেই হল..
কিন্তু একি! পেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে যখন বোঝার চেষ্টা করছি যে নাড়িতে কোন ক্ষত আছে কিনা সেই সময়ই একটা ভারী শক্ত কিছু হাতে লাগল। ভাল করে দেখতে গিয়ে যেটা নজরে এল সেটা ভয়ংকর!
বেচারামের সিকামে একটা টেনিস বলের সাইজের টিউমার!
মানুষের নাড়ি দু’রকমের। ছোট আর বড়। ক্ষুদ্রান্ত আর বৃহদান্ত্র। নাড়ির ব্যাস অনুযায়ী এই ভাগ। প্রথমের ছোট নাড়ির গুলো হল জেজুনাম আর ইলিয়াম। তারা শেষ হয় কোলন বা বৃহদন্ত্রে। কোলন শুরু হয় তলপেটের ডানদিকের কোণাতে, শেষ হয় পায়ুদ্বারে। কোলনের শুরুটাকেই বলে সিকাম।
বেচারামের সিকামের টিউমারটা যে ক্যান্সার সেটা সাইজ আর গড়ন দেখেই বোঝা গেছিল। আমি আর স্যার মিলে এবারে খুব সাবধানে টিউমারটা বাদ দিলাম। তারপরে নাড়ির দুটো বাকি অংশ একসাথে জুড়ে দেওয়া হল। ভাগ্যের কথা টিউমারটা পেটের আর কোথাও ছড়ায়নি। এবারে পেটটা সেলাই করতে যেটুকু সময় লাগে আরকি।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বেড়িয়ে বেচারামের স্ত্রীকে যখন টিউমারের কথা বলছি তখন একটা কথাই বলেছিলেন ভদ্রমহিলা,- ডাক্তারবাবু ও বাঁচবে তো?
এই কথাটা আমি কতবার যে শুনেছি আজ অবধি তা গুনে বলতে পারব না। এমার্জেন্সি অপারেশনের পরে সার্জেন রুগীর বাড়ির লোকের সাথে কথা বলতে এলেই একটাই কথা শুনতে হয় আগে, এই বিলেতেও,- হি ইজ গোইং টু সারভাইভ রাইট?
হ্যাঁ, বেচারাম বেঁচে গিয়েছিল। বায়োপ্সির রিপোর্টে ক্যান্সারই বেড়িয়েছিল। অ্যাডিনোকার্সিনোমা। তবে সিকামের দেওয়াল ভেদ করতে পারেনি। নালীর ভিতরেই ছিল। তাই আর কেমোথেরাপি লাগেনি। দিন দশেক হাসপাতালে কাটিয়ে বেচারাম বাড়ি চলে যায়।
কালীপুজোর পরের অ্যাডমিশন ডে-তেই বেচারাম আমাদের আউটডোরে দেখাতে আসে, একদম সুস্থ। হাতে করে নিয়ে এসেছিল ভেড়ির কিলো খানেক গলদা চিংড়ি। ভেড়ির মালিক কোলকাতার ‘বাবু’-দের কাজে খুশি হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেইদিন রাতে অপারেশনের ফাঁকে ওই গলদা চিংড়ির মালাইকারি দিয়ে গরম ভাত। আহা, ভাবলে এখনও জীভে জল আসে।
কোলনের, বিশেষত সিকামের ক্যান্সার আগে থেকে ধরা যায় না। যখন ধরা পরে তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব দেরী হয়ে যায়। ইংল্যান্ডে এই জন্য পঞ্চাশের ওপরে সবার কোলন ক্যান্সারের টেস্ট হয়। সেই খরচ বহন করার ক্ষমতা আমাদের সরকারের নেই। তাই নিঃশব্দেই বাড়ে এরা।
সেই দিন বেচারামকে ষাঁড়ে না গুঁতোলে সে হাসপাতালেও আসত না, তার পেট চিরে দেখাও হত না। বেচারামের ক্যান্সারও তাহলে গুছিয়ে বাসা বাঁধতে পারত ওর শরীর জুড়ে। কেউ টেরটি পেত না। যখন বোঝা যেত তত দিনে সব শেষ। এক স্ত্রী, দুই বিয়ে না হওয়া কন্যাকে রেখে বেচারাম উড়ত স্বর্গ বা নরকের উদ্দেশ্য।
এরপরেও যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী কিনা, বলুন তো কি জবাব দি তাদের!