#
আমার মেয়ে আমাকে বাবা বলে ডাকে। কিন্তু স্কুলের বন্ধুদের দেখে কখনও কখনও তারও আমাকে অন্য নামে ডাকতে ইচ্ছা হয়। তখন ডাকে পাপা,বাবি,ড্যাডি। আমি এক মুহূর্তের জন্য অবাক হই। তাকিয়ে দেখি আমার মেয়ে এক চোখ আনন্দ আর এক আকাশ বিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
||
গত মঙ্গলবারের কথা, আমি নাইট শিফটে ছিলাম। এমার্জেন্সিতে রুগী দেখছি। এমন সময় অন ডিউটি রেডিওলজিস্টের ফোন।
-আমিনা বিবি, ২৩ নম্বর ওয়ার্ড, ৩৫ বছর বয়স। পেটের সিটিস্ক্যানটা আপনি রিক্যুয়েস্ট করেছিলেন?
-না আমি না, আমার আগের শিফটের সার্জেন। কিন্তু আমি জানি সিটিটা হচ্ছে।
-ওকে, সিটি হয়ে গেছে। ওর একটা ইনকারসিরেটেড ইঙ্গুইনাল হার্নিয়া আছে। রিপোর্টটা সিস্টেমে চলে আসবে আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই।
ব্যস, সার্জেন দৌড়ল ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের দিকে।
কুঁচকিতে যে হার্নিয়া হয় তার নাম ইঙ্গুইনাল হার্নিয়া। পেটের ভিতরের নাড়ির কোন একটা অংশ কুঁচকি দিয়ে বেরিয়ে এসেই এই হার্নিয়া তৈরি করে। এ জিনিস আগে ভাগে ধরা পড়লে অপারেশন করিয়ে নিলেই কোন সমস্যা আর হয় না। কিন্তু যদি আগে ধরা না পড়ে তাহলে একটা বড় সমস্যা হতে পারে। যে কোন দিন ওই হার্নিয়া ওখানেই আটকে যাবে। নাড়ির একটা অংশ আর পেটের ভিতরে ঢুকতে পারবে না। একেই বলে ইনকারসিরেশন। এমন অবস্থায় কয়েক ঘন্টা থাকলে সেই নাড়ির রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। তার পরে আরো কয়েক ঘন্টার দেরীতে সেই নাড়িতে পচন ধরবে, তা থেকে হবে সেপসিস। তারপরে মৃত্যু। এটা আটকাবার একটাই উপায়, যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি অপারেশন করা।
ওয়ার্ডের দিকে যেতে যেতেই থিয়েটারে ফোন করে বললাম এমন একটা রুগী আসছে। সব যেন তৈরি থাকে।
পাঁচ নম্বর বিছানায় শুয়ে ছিল আমিনা। একদম ছোট্ট পাখির মতো শরীর। মুখটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে। ডান হাতে পাশে বসে থাকা স্বামীর হাতটা ধরে আছে। আর বিছানার পাশে একটা ছোট প্যারাম্বুলেটরে ঘুমিয়ে আছে ওর বাচ্চা মেয়েটা।
আমিনা মাস পাঁচেক আগেই এক শিশুকন্যার জন্ম দিয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু সোমবার রাত থেকে হটাৎ করে তলপেটে ব্যথা শুরু হয়। তারপরে বমি। সেই ব্যথা যখন সারা রাতেও কমেনি তখন সে হাসপাতালে ভর্তি হয়। আমার আগের শিফটের সার্জেন ওকে দেখে সিটি স্ক্যান করতে দেন। আমি আমিনার ডান কুঁচকিতে হাত দিয়ে দেখলাম খুব হালকা একটা ফোলা মতো অংশ, সেখানটাতেই প্রচন্ড ব্যথা। সাধারণত এমন হার্নিয়া বেশ বড়ই হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে এটা এত ছোট হওয়ার কারণেই প্রথম দিকে বোঝা যায়নি। সিটিস্ক্যানটা না হলে ধরাই পড়ত না।
আমিনাকে বললাম ওর অপারেশন করতে হবে। শুনেই বেচারির মুখটা আরো কুঁকড়ে গেল। ও বলল,- কাল সকালে করলে হয় না?
– না,অনেক দেরী হয়ে যাবে। সকাল অব্দি ফেলে রাখা যাবে না আপনাকে।
-কী হবে দেরী করলে?
ডাক্তারের একটা বড় দায়িত্বই হল কিছু না লুকিয়ে রুগীকে সবকিছু বলা। তা সে যতই নিষ্ঠুর তথ্যই হোক না কেন, রুগীর সাথে তা আলোচনা করতেই হয় অপারেশনের আগে। আমিও আমিনার বিছানায় ওর পাশে বসে সব বললাম ওকে। আটকে থাকা নাড়ির অবস্থা কেমন আমরা জানি না,তার কিছু অংশ বাদ দিতে হতে পারে, বাদ দেওয়ার পরেও সেপসিসের আশংকা থাকতে পারে, তা থেকে.. সব কিছু।
আমিনা কাঁদছিল তখন।
এমন দৃশ্য আমাদের কাছে নতুন না। অপারেশনের কথা শুনলেই যে কারোর মনে ভয় এসে যায়। আমিও এবারে তাই করলাম যা সবার জন্য করি। মুখে একটা হাসি টেনে বললাম,-ভয় পাবেন না, আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব।
-আমি কাল মেয়েকে দুধ খাওয়াতে পারব তো ডাক্তার?
– যদি সব ঠিক ঠাক থাকে তাহলে কেন পারবেন না, নিশ্চয়ই পারবেন।
এবারে মেয়েটা আমার হাতটা ধরে ফেলল। বলল, -আপনাকে একটা রিক্যুয়েস্ট করব? রাখবেন?
-বলুন।
– আমার অপারেশন শুরুর আগে না একবার আল্লার নাম নেবেন প্লিজ। বলবেন ইনশাহ আল্লাহ। দেখবেন অপারেশন ঠিকঠাক করে হয়ে যাবে। আল্লাহর নাম নিলে সব ভাল হয়।
-আচ্ছা, তাই করব।
কনসেন্ট ফর্মে সই করে দিল আমিনা। আমি ওয়ার্ডের বাইরে বেরিয়ে এসে ক্লিনিকাল নোট লিখছি, দেখি আমিনার স্বামী বেরিয়ে এসেছে। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,-আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না ডক্টর।
আমি একটু অবাক হলাম,-কী ব্যাপারে?
– আপনি তো হিন্দু, আপনার নামেই বুঝেছি। ও আপনাকে আল্লাহর নাম নিতে বলল। আসলে না ও একদম বাচ্চার মতো। বয়সই যা বেড়েছে। কখন কাকে কী বলতে হয় তার কোন জ্ঞান নেই। ও আমার বউ কম, মেয়েই বলতে পারেন। সবসময় সামলাতে হয়।
-আপনার স্ত্রী ভয় পেয়ে আছেন, এমন সময় আমরা সবাই ভগবানকে ডাকি। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। আমি কিছু মনে করিনি। বাই দা ওয়ে, আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি,
-বিলাল।
||
এই কথোপকথনের চল্লিশ মিনিটের মাথায় আমিনা বিবির অপারেশন শুরু হল। নাড়ি হার্নিয়ার মধ্যে জড়িয়ে ছিল ঠিকই, কিন্তু তার কোন ক্ষতি হয়নি। খুব সাবধানে তাকে ছাড়িয়ে পেটের ভিতরে চালান করে দিলাম। তারপরে হার্নিয়াটা ঠিক করতে যতটুকু সময় লাগে। সব মিলিয়ে ঘন্টা দেড়েক মতো লাগল।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরের করিডোরে দেখলাম বিলাল বসে আছে। আমি হেসে বললাম, -আপনার মেয়ের অপারেশন ভাল ভাবে হয়ে গেছে বিলাল, ওকে আর এক ঘন্টার মধ্যে বেডে দিয়ে দেওয়া হবে।
আমার মজাটা বুঝতে পেরে বিলাল একগাল হাসল। বলল, -তাহলে সব ঠিকঠাক আছে তো?
-হ্যাঁ, নাড়ির কিচ্ছু বাদ দিতে হয়নি। ওর ঘুম ভাঙলেই দেখবেন একদম ফিট।
শুক্রবার সকালে আমিনা বিবি বাড়ি চলে গেছে। যাওয়ার আগে ও আর বিলাল আমাকে অনেক বার ধন্যবাদ জানিয়ে গেল।
||
সে রাতে থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে একটা কথা আমি বিলালকে বলিনি।
আমিনার শরীরে স্ক্যালপেলের প্রথম আঁচড়টা কাটার সময় আমি আল্লাহকে ডেকেছিলাম মনে মনে। যেমনটা আমিনা চেয়েছিল। হয়ত আমার উচ্চারণে ভুল ছিল, তবু বলেছিলাম, ইনশাআল্লাহ।
আমার ঈশ্বর তখন এক পলের জন্য অবাক হয়েছিলেন মনে হয়। এই প্রথম বার আমার মুখে ওঁর নামের অন্য ডাক শুনে। ঠিক যেমনটা আমি আমার মেয়ের মুখে ‘পাপা’ শুনে তাকাই।
যে নামেই ডাকি না কেন, পিতাই তো।
ওই এক আকাশ বিশ্বাসটাই তো সব।
তাই না?
দারুন।