আজকে একটু আমার কথা বলি?
এখন আমি সার্জারির যে বিভাগে কাজ শিখছি তাকে বলে ‘বেরিয়াট্রিক সার্জারি’। ভীষণ মোটা মানুষকে রোগা বানাবার চেষ্টা আর কী। এতে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা সম্ভব হয়, অকালে হৃদপিন্ডের সমস্যাকে আটকানো যায়। মানুষটার লাইফ এক্সপেকটেন্সি বা বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। শরীর প্রস্থে কমলে ব্যক্তির নিজের ওপরে আস্থাও বাড়ে।
বেরিয়াট্রিক সার্জারি বেশ জটিল। যেহেতু রুগী ভীষনই স্থূল, ওজন কমপক্ষে প্রায় ১২০-১৩০ কিলো তাই পেটে থাকা চর্বির আধিক্য অনেক বেশি হয়। সেই কারণে এই সব রুগীর অপারেশন পেট কেটে করা যায় না। ল্যাপারোস্কোপি করে করতে হয়, মানে পেটে ছোট ছোট ফুটো করে ক্যামেরা ঢুকিয়ে। অনেকে এটাকে কি হোল সার্জারি বলে জানে। বেরিয়াট্রিক অপারেশনের সময় পাকস্থলীর প্রায় বেশির ভাগ অংশই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। যে পাকস্থলীর আকার আপনার হাতের তালুর দেড় থেকে দুই গুণ তাকে ছোট করে জামার বুকপকেটেরও অর্ধেক সাইজের করে দেওয়া হয়। এতে রুগী সামান্য খেলেই তার পেট ভরে যাবে, শরীরে ক্যালোরি কম যাবে। তাতে ওজন কমবে। পাকস্থলীর এতটা অংশকে বাদ দিয়েও আমরা থামি না। রুগীর নাড়ির প্রায় ১০০ মিটারের স্থান বদল করে দেওয়া হয়। এতে আরো ওজন কমে। অপারেশনের শেষে পেটের ভিতরের অ্যানাটমিটাই বদলে যায়।
আগেই বললাম এই অপারেশন বেশ জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ । কখনও কখনও এই অপারেশনের পরে পেটের মধ্যে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তাদের কয়েকটি আবার সার্জিকাল এমার্জেন্সি। তৎক্ষণাৎ অপারেশন না করতে পারলে মৃত্যু অনিবার্য।
||
মাস দুয়েক আগের কথা,
এলিনা অ্যান্দ্রোভিচের বয়স ৩০। পাঁচ বছর আগে পোল্যান্ডে তার বেরিয়াট্রিক অপারেশন হয়েছিল। এখনকার চেহারা দেখলে মনেই হয় না যে একসময় এই মানুষটাই কত মোটা ছিল। আমি যখন অন কল ডিউটিতে তখন এলিনা অ্যাম্বুলেন্সে চেপে এল এমার্জেন্সি বিভাগে। ওর পেটে নাকি গত পাঁচদিন ধরে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে, তার সাথে বমি। এলিনা কোন মলও ত্যাগ করছে না চারদিন হল। প্রথমে বাড়িতে থেকেই ব্যাপারটাকে ঠিক করার চেষ্টা করেছিল এলিনা, পেটে ব্যথার ওষুধ খেয়ে। তাতে কোন কাজ হয় নি। সেই দিন সকাল থেকে আসে ধুম জ্বর, তার সাথে ঘন ঘন জ্ঞান হারাতে থাকে এলিনা। এগুলো সব ওর স্বামীই বলল। ওদের বিয়ে হয়েছে বছর দেড়েক হল। আমি যখন এলিনাকে দেখছিলাম তখন ওর জ্ঞান থাকলেও ও খুব ক্লান্ত, দরদর করে ঘামছে। পেটে হাত দিতে গেলেই কঁকিয়ে উঠছে ব্যথায়।
পাঁচ বছর আগে বেরিয়াট্রিক অপারেশন হয়ে ছিল এলিনার। পেটে ব্যথা, বমি, মলত্যাগ করা বন্ধ হয়ে যাওয়া, জ্বর, জ্ঞান হারানো… এলিনার নাড়ি জট পাকিয়ে যায়নি তো?!
বেরিয়াট্রিক সার্জারির সময় যেহেতু পেটের ভিতরের নাড়িদের জায়গা বদল হয় তাই কখনও কখনও সেই নাড়ির একটা লুপের মধ্যে আরেকটা নাড়ির অংশ ঢুকে গিয়ে তৈরি করে হার্নিয়া। এতে আটকে যাওয়া নাড়ির অংশটি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। তারপরে বন্ধ হয় তার মধ্যে রক্তের জোগান। এর ফলে একসময় সেই নাড়ি মরে যায়। সেখানে চেপে বসে ব্যাকটেরিয়া। ব্যাকটেরিয়ার টক্সিনের বিষক্রিয়ায় শরীর কাবু হয়ে পরে। তার লক্ষণগুলো হল জ্বর আসা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, ঘাম হওয়া.. এলিনার ঠিক এই গুলোই হচ্ছিল না?
এই সেপসিসকে আটকাতে না পারলেই জীবনটা ফুট করে হারিয়ে যাবে। অতএব আমরা এলিনাকে নিয়ে দৌড়লাম থিয়েটারে।
অপারেশন থিয়েটারের আবহাওয়া সার্জেন আর অ্যানেস্থেসিস্টের মনের সাথে বদলায়। আমাদের থিয়েটারে মৃদু আওয়াজে গান বাজে। কখনও কখনও ক্লাসিকাল মিউজিক। লম্বা অপারেশনের সময় মনকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে এটা। অপারেশন ঠিকঠাক চললে হাল্কা হাসি ঠাট্টাও হয় সার্জেন, অ্যানেস্থেসিস্ট, নার্সদের মধ্যে। কিন্তু কোন জটিলতার সামনে দাঁড়ালেই পরিবেশটা বদলে যায়।
এলিনার পেটটা মাঝ বরাবর লম্বা করে কাটার পরেই আমার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা কনসালট্যান্ট নার্সদের উদ্দেশ্যে বলল, “ক্যান ইউ টার্ন অফ দা মিউজিক প্লিজ?”
এলিনার পেটের কাটা অংশের ফাঁক দিয়ে তখন উঁকি মারছে মরতে থাকা কালো নাড়ি।
না, এলিনার পেটের মধ্যে কোন হার্নিয়া হয়নি। পোল্যান্ডের সার্জেন তার অপারেশন বেশ ভালই করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশ অনেকটা নাড়ি নিজেদের মধ্যে জড়িয়ে গেছে। এর ফলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে কালো হয়ে গেছে তারা। নাড়িগুলোর জটকে খুব সাবধানে ছাড়ালাম আমরা। এর পরে আসল সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা।
কী করা যায়? নাড়িগুলোকে রাখব নাকি বাদ দেব?
এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব মুশকিলের। এলিনার নাড়ি বাদ দিতে হলে বাকি প্রায় আর কিছুই পড়ে থাকবে না। নাড়ির দুটো অংশকে জোড়াও লাগানো যাবে না। এর ফলে বাকি জীবন পেটের ওপরে তৈরি করা স্টোমা দিয়ে পায়খানা করতে হবে। আবার নাড়িগুলোকে বাদ না দিলে অন্য বিপত্তি। এদের থেকে বের হওয়া টক্সিন থেকে রক্তে সমস্যা হবে, হৃদপিন্ড বিকল হয়ে যাবে।
এলিনার নাড়িগুলোকে গরম কাপড়ে মুড়ে মিনিট পনেরো অপেক্ষা করলাম আমরা। থিয়েটারে তখন শুধুমাত্র অ্যানাস্থেসিয়ার মেশিনের বিপ বিপ শব্দ। অপেক্ষা করার পরে কাপড় সরিয়ে দেখলাম। না, নাড়ির রঙটা বদলে লালের দিকে যাচ্ছে না। আঙুল দিয়ে খুব ভাল করে অনুভব করলে নাড়ির মধ্যে যেতে থাকা ক্ষীণ ধমনীর পালসকে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তা কী যথেষ্ট?
-“কী মনে হচ্ছে ঘোষ? কী করা যায়? বাদ দিয়ে দি?”
দুজন সার্জেন একসাথে কোন অপারেশনে নামলে কেউ কখনও নিজের ইচ্ছা মতো কোন কাজ করে না। এখানে বয়সে ছোট বড় বলে কিছু নেই। সবাই একে অপরের মতামতকে গুরুত্ব দেয়।
আমি নিজেও তখন জানি না ঠিক কী করা উচিত। দোলাচলে ভুগছি।
-“দেবেন বাদ?”
-“তুমি কী ভাবছ?”
-“ভাবছি একবার চান্স নিয়ে দেখা যাক নাকি?”
-“তাহলে বাদ দেব না?”
-“হুম, বাদ যদি আমরা দিইও তাহলেই বা ওর বাঁচার চান্স কতটা? বাঁচলেও তো খুব একটা ভালভাবে বাঁচবে না। জটগুলো ছাড়ানো গেছে। ওকে এবারে একটা সুযোগ দিলে হয় না?”
-“ল্যাপারোস্টোমা করে রেখে দেবে বলছ?”
-“হ্যাঁ, কাল আরেকবার দেখব না হয়। কালও যদি দেখি নাড়িগুলো কালোই হয়ে আছে তাহলে বাদ দিতে তো বাধ্যই হব আমরা।”
ল্যাপারোস্টোমা করা মানে হল অপারেশনের পরে পেটকে আবার জোড়া না লাগানো। এতে নাড়ির ওপরে চাপ কম থাকে৷ কিন্তু এভাবে বেশিদিন রাখা যায় না। জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। এলিনার নাড়ির ওপরে আমরা বেশ কয়েকটা বড় বড় ভিজে গজ চাপা দিলাম। তার ওপরে লাগালাম স্যালাইনের প্লাস্টিকের ব্যাগ কেটে তৈরি করা আচ্ছাদন। এভাবে তৈরি হল ল্যাপারোস্টোমা। খোলা পেট আর মুখের মধ্যে ঢুকে থাকা ভেন্টিলেটর এর নল নিয়েই আই.সি.ইউ তে গেল এলিনা। এবারে বল অ্যানেস্থেসিস্ট আর ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিনের ডাক্তারদের কোর্টে। তারা সারা রাত চেষ্টা করবে এলিনার রক্তচাপকে বাড়ানোর, যাতে নাড়িতে রক্তপ্রবাহ বাড়তে পারে। এলিনার শরীরের সেপসিসের সাথেও লড়তে হবে। তার সাথে সাথে লড়াইটা এলিনারও ছিল। জীবনটা যে ওরই।
পরেরদিন সকালে হাসপাতালে এসে শুনলাম রাতের মধ্যে খুব খারাপ কিছু হয়নি৷ এলিনা এখনও ভেন্টিলেটরে থাকলেও রক্তচাপ স্বাভাবিক, জ্বর নেই, সেপসিসও ভালর দিকে। এলিনাকে আমরা আবার থিয়েটারে নিয়ে এলাম। ভাল খবর গুলোর কোন মূল্যই থাকবে না যদি দেখি নাড়িগুলো এখনও কালোই হয়ে আছে। খুব বেশি আশা নিয়ে সেদিন অপারেশনে নামিনি আমাদের দুজনের কেউই।
সাবধানে প্লাস্টিকের আচ্ছাদন আর ভিজে গজ সরালাম আমরা। দেখলাম আমাদের চমকে দিয়ে পেটের ফাঁক থেকে হ্যালো বলছে লাল-গোলাপী অন্ত্র! এতটুকু অংশও আর কালো নেই! মেডিসিনের ডাক্তারদের রাত জাগা অক্লান্ত পরিশ্রমে এলিনার নাড়ির মধ্যের রক্তচলাচল আবার শুরু হয়ে গেছে!
সেদিন এলিনার নাড়ির একটি ইঞ্চিও আমাদের বাদ দিতে হয়নি। পেট আমরা সেলাই করে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এই অপারেশনের দিন তিনেক পরে এলিনা ভেন্টিলেটর থেকেও বেরিয়ে আসে৷ দিন পাঁচেক পরে আই.সি.ইউ. থেকে ছাড়া পায়। আরো দশদিন ওয়ার্ডে কাটাবার পরে ওর ছুটি হয়ে যায়।
এলিনা গত সপ্তাহে আমার ক্লিনিকে এসেছিল ওর স্বামীর সাথে। বেশ সেজেগুজে ঠোঁটে লিপস্টিক, কানে বড় দুল পড়ে। ও এখন একেবারে সুস্থ, পেটের কাটাটাও পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। ভাঙা ভাঙা ইংরাজীতে পোলিশ মেয়েটা এক মুখ হাসি নিয়ে আমাকে ধন্যবাদ জানালো। আর বলল এবারে ওরা প্রেগন্যান্সির প্ল্যান করছে। এলিনার স্বামী মজা করে বলল,- “বেশি না, আমাদের গোটা তিনেক বাচ্চা হলেই চলবে!”
সাক্ষাত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে এলিনা এখন নতুন প্রাণ তৈরি করার স্বপ্ন দেখছে।
||
এই লেখাটা আমার নিজের জন্যই লিখলাম। তার কারণ দুটো।
আমি বারবার বলি আমরা কেউ ভগবান নই। মানুষের সাথে মৃত্যুর দূরত্ব বাড়াবার চেষ্টা করি মাত্র। আমার বলতে দ্বিধা নেই, সার্জারি হল ডাক্তারির সেই শাখা যেখানে ডাক্তারের একটা ছোট ভুলে রুগীর সরাসরি ক্ষতি হয়। আমরাও মানুষ, অপারেশন চলাকালীন সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না কেউই। কিন্তু যে সিদ্ধান্তটাই নিই না কেন তা রুগীর ভালর কথা ভেবেই নিই। কখনও জিতি, কখনও হেরে যাই। এই হেরে যাওয়াটা রুগীর সাথে সাথে সেই সার্জেনেরও। সব সার্জেনের জীবনেই সেই কালো দিন একবার না একবার আসেই। আমাকেও হয়ত তেমন দিন দেখতে হবে। তখন এই লেখাটার কাছে ফিরে আসব নিজের ওপরে নিজের ভেঙে পড়া আস্থাটাকে ফিরিয়ে আনতে।
দ্বিতীয় কারণটা আরো ব্যক্তিগত। প্রতিনিয়ত করে চলা কোন না কোন পাপের স্খালনের সময়ে পূণ্যের এই চার আনাকে ব্যবহার করব আমি।
সবাই জানবে ডাক্তার এলিনার প্রাণ বাঁচিয়েছে, নতুন জীবন দিয়েছে। শুধু ডাক্তার জানবে এলিনা ডাক্তারকে কী দিয়ে গেল। এই পাওয়া বড্ড স্বার্থপর। এর কোন ভাগ হয় না।
দারুন। এই স্বীকারোক্তি সচরাচর দেখা যায়না। ভালো থাকবেন।
What a great achievement. You are really a breaveheart and also I must mention, stunning flow of words.