আজকের গল্পটা সাহেবদের দেশের। আমি গত তিন বছর যে হাসপাতালে কাজ করছি সেখানকার।
ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রায় গোটাটাই সরকারি। ফোঁড়া কাটা থেকে শুরু করে ওপেন হার্ট সার্জারি সব কিছু বিনামূল্যে হয়। যদিও তার জন্য ট্যাক্সটাও বেশ বেশি দিতে হয়। যাই হোক, এমনই একটা সরকারী হাসপাতালে আমি গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল সার্জেন, মোদ্দা কথা পেট কাটি। মাসে সাতদিন ১২ ঘন্টা করে অন কল থাকে, সেই দিনগুলোতে কাজের চাপ কোলকাতার কোন সরকারী হাসপাতালের মতোই।
তেমনই একটা অন কলের কথা। ডিসেম্বর মাস, রাত তখন প্রায় সাড়ে সাতটা, আমি মনে মনে ভাবছি আর এক ঘন্টা সময় কাটিয়ে দিতে পারলেই ব্যাস, বাড়ি ফিরেই বিছানায় ফ্ল্যাট হয়ে যাব। এমন সময়ই আমার জুনিয়র এসে বলল, ড্যারেন আর্লকে আবার ভর্তি করতে হয়েছে, এবারে অবস্থা বেশ খারাপ।
ড্যারেন আর্লকে তখন আমরা সবাই প্রায় চিনে গেছি। ড্যারেনের বয়স প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই, অনেকদিনের পুরনো ডায়াবেটিসের আর হাঁপানীর রুগী। তার ওপরে বছর তিনেক আগে স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে একটা, তারপর থেকে ড্যারেন কথাও বলতে পারে না। এই ড্যারেনকেই শেষ কয়েক মাসের মধ্যে বেশ কয়েকবার ভর্তি করতে হয়েছিল আমাদের ওয়ার্ডে। কেন? কারণ ড্যারেনের সিকাম।
স্ক্যালপেলের আগের গল্পে সিকামের কথা বলেছিলাম। পেটের ডানদিকের নিচে সিকাম থাকে, এটা বৃহদন্ত্রের শুরুর অংশ। ড্যারেনের সিকামটা কোন এক অজ্ঞাত কারণে খুব বড় হয়ে গিয়েছিল, বেলুনের মতো। আর সেই জন্যই সেটা বার বার সেটা নিজের অক্ষের ওপরে ঘুরে যাচ্ছিল। তাতে কি হবে? এই অবস্থাকে বলে সিকাল ভলভুলাস। এই ভাবে বার বার ঘুরতে ঘুরতে সিকামের বেলুনটা বাড়তেই থাকবে, সেই বেলুন যে কোন দিন ফেটে গেলেই সর্বনাশ! মৃত্যু অনিবার্য।
এই রোগের একমাত্র চিকিৎসা হল সিকামটাকে কেটে বাদ দেওয়া। কিন্তু সেই অপারেশনের ঝক্কি ড্যারেনের দূর্বল শরীর নিতে পারবে না। তাই আমরা পেটের বাইরে থেকে একটা পাইপ সিকামের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম একটা ছোট অপারেশন করে। তাতে করে সিকামটা ওই পাইপের ওপরে আটকে থাকবে। আর ঘুরতেও পারবে না। ব্যাস, আর কোন চিন্তা নেই। শুধু একটাই জিনিস খেয়াল রাখার, পেটের বাইরে বেড়িয়ে থাকা সেই পাইপ যেন কোন ভাবে খুলে না পড়ে যায়!
দূর্ভাগ্যবশত ড্যারেনের সাথে ঠিক এইটাই হয়েছিল। বেচারা রাতে যখন ঘুমোচ্ছিল তখন বেখেয়ালে হাতের টান পড়ে টিউবটা খুলে যায়। আমি যখন ড্যারেনকে দেখলাম তখন ওর অবস্থা বেশ শোচনীয়। প্রচন্ড জ্বর, একদম নেতিয়ে পড়েছে। পেটে হাত দিতে গেলেই ককিঁয়ে উঠছে ব্যথায়। টিউবটা সিকামের যেখানে লাগানো ছিল সেই ফুটো দিয়ে এখন পেটের মধ্যেই অনর্গল বেড়িয়ে আসছে মল। সেটা বিষিয়ে দিচ্ছে সারা শরীরকে।
ড্যারেনের সাথে এসেছিল ওঁর স্ত্রী এলিসা আর মেয়ে জ্যানেট। দুজনেই তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছে। হতাশার ছাপ ওদের চোখে মুখে। একটাই কথা বারবার বলে যাচ্ছে আমাকে তখন, যেভাবেই হোক ড্যারেনকে বাঁচাতেই হবে। ওরা পারবে না ড্যারেনের মৃত্যুকে মেনে নিতে। ক্রিসমাসের আগে ওকে বাড়ি ফেরাতেই হবে।
আমরা ডাক্তাররা মানুষের শরীর টুকটাক বিগড়ে গেলে মেরামত করার চেষ্টা করি। কিন্তু কখনও কখনও সত্যিই আমাদের হাতের নাগাল গলে মৃত্যু জিতে যায়। সেই দিনটাও ছিল তেমনি। ড্যারেনকে এই অবস্থা থেকে বাঁচাতে গেলে একটাই উপায়। এক্ষুনি থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করা। কিন্তু তাতে অপারেশন টেবিলেই ওর মৃত্যু অনিবার্য। অন্যদিকে পেটের মধ্যে জমতে থাকা ব্যাকটেরিয়া ভর্তি মলকেও বার করা সম্ভব নয়।
অতএব ওর জীবন আর এগোচ্ছে না। এখানেই চলার শেষ। ওর স্ত্রী আর মেয়েকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে সেইটাই বোঝালাম, ড্যারেনকে এবারে শান্তিতে যেতে দেওয়া হোক। বাঁচাবার কোন আশা নেই, আমরা ওর ব্যথাটুকু যতটা পারব কমাবার চেষ্টা করব মরফিন দিয়ে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক আর দেব না, জীবনের শেষ মুহূর্তে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে বাঁচাবার চেষ্টাও করব না, এতে ওর যন্ত্রণাকেই আরো দীর্ঘায়িত করা হবে। সহানুভূতি দেখালাম নাকি সহানুভূতির নাটক করলাম সেটা বুঝলাম না। এরকম এর আগেও অনেককে অনেকবার বলেছি। মৃত্যুর সাথে সহবাস করতে করতে আমাদের অনেকেরই অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যায়। তাই বাড়ির লোকেদের জ্বর, কাটা ছেঁড়া, মাথা ব্যথা, গায়ে ব্যথাকে কিছু মনে হয়নি কখনও।
সেদিন ওই ঘর থেকে যখন বেড়িয়ে আসছিলাম তখন মা আর মেয়ে একে ওপরকে জড়িয়ে বসে আছে। কারোর মুখে কথা নেই। সামনের খারাপ দিনগুলোর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছিল হয়ত।
ড্যারেনের ভর্তি হওয়ার দিন পাঁচেকের মধ্যে আমি এক সপ্তাহের জন্য ছুটিতে যাই। ফিরে আসার পরদিনই আবার জুনিয়রদের নিয়ে ওয়ার্ড রাউন্ডে বেড়িয়েছি। একটা নামে এসে চোখ আটকে গেল, ড্যারেন আর্ল, ওয়ার্ড ১০ বেড নাম্বার ২৪।
– এই ড্যারেনই কি…
– হ্যাঁ ঘোষ, ড্যারেন আর্ল। সিকোস্টমি টিউব খুলে গিয়ে..
– হুম, সেটা জানি, এখন কেমন?
ড্যারেন যে সিকামে ফুটো নিয়ে এতদিন বেঁচে থাকবে এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল।
– একই রকম, সেপসিস একই আছে, সারাদিনই ঝিমিয়ে থাকে।
– ওকে, খুব কিছু তো করার নেই।
– হ্যাঁ।
– বাড়ির লোক আসছে?
– আসছে তো, ওয়াইফ আর মেয়ে রোজ সন্ধ্যে বেলাতে আসছে।
সত্যি বলছি, আমাদের কোন ওয়ার্ড রাউন্ডেই ড্যারেনের পিছনে বেশি সময় নষ্ট হত না। শুধু ব্যথা কমাবার ওষুধ আর স্যালাইনেই দায় সেরেছিলাম আমরা। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর জন্য দিন গোনা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না। ওর প্রতিদিনের সার্জিকাল নোটে লেখা থাকত, পেশেন্ট ফর প্যালিয়েশন। সেম অ্যাজ বিফোর।
এমনি করে সপ্তাহ ঘুরে মাস এল, ড্যারেন যে ওয়ার্ডের এক কোণে আছে এক ভাবে এটা বাকিদের কাছেও আর নতুন কিছু নয়। ওর বাড়ির লোকও দেখলাম ধীরে ধীরে আসা কমিয়ে দিল। প্রথমে একদিন অন্তর অন্তর, পরে সপ্তাহে তিনদিন। ড্যারেনের বাড়িতে অনুপস্থিতিটা হয়ত তখন ওদের কাছেও অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।
এক মাস দশদিনের মাথায় কিন্তু ম্যাজিক হল একটা। ড্যারেন বিছানা থেকে আস্তে আস্তে উঠে বসতে লাগল। জ্বর কমছে তখন, রক্ত পরীক্ষাতে আশ্চর্যজনক ভাবে সেপসিসের মাত্রাও কমতে লাগল। দেড় মাসের মাথায় ড্যারেন মুখে আবার খাবার নিল। স্বাভাবিক ভাবে মলত্যাগও করল। তার মানে কোন জাদুবলে ড্যারেনের সিকামের ফুটো জোড়া লেগে গেছে! পেটের ভিতরের ইনফেকশনও গায়েব! ওর ইচ্ছাশক্তির কাছে হয়ত মৃত্যুর ভগবানও হার মানছেন তখন।
আমরা এবারে আবার অ্যান্টিবায়োটিক চালু করলাম। ড্যারেনকে ডায়াটিশিয়ান দেখতে শুরু করল, ওর ওজন বাড়তে লাগল। একদিন ওয়ার্ড রাউন্ডে দেখলাম ড্যারেন জানলার পাশে বসে বই পড়ছে।
– হাই মিস্টার আর্ল, কেমন আছেন?
বোবা মানুষটা ঘাড় নেড়ে জানালেন বেশ ভাল আছেন।
– বাহ, এবারে কি?
বৃদ্ধ এবারে বইয়ের পিছনের মলাটে কাঁপা কাঁপা হাতে কিছু লিখে আমার হাতে দিলেন, মুখে হাসি।
আমি বাড়ি যাব।
ড্যারেনের মুখের হাসিটা সেদিন আমাদেরকেও ছুঁয়ে গেল। ওর ছুটির ব্যবস্থা করে দিলাম আমরা। দুমাস হাসপাতালে কাটিয়ে এবারে ও বাড়ি ফিরবে।
পরেরদিন হাসপাতালের করিডরে ড্যারেনের স্ত্রী আর মেয়ের সাথে দেখা হল। ওকে নিয়ে যেতে এসেছে বোধ হয়।
– খুব খুশি তো এখন আপনারা? আমি কথাটা বলে দেখলাম আমার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মা মেয়ের মুখে হাসির লেশ মাত্র নেই।
– আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে মিস্টার ঘোষ?
– হুম, বলুন।
– আমরা চাইনা ও বাড়ি আসুক।
এই কথাটার জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না, যারা দুমাস আগেই ড্যারেনকে বাঁচিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছিল তারাই এখন আর সেই মানুষটাকে চাইছে না!
একটু থতমত খেয়ে গিয়ে বললাম, – ও কিন্তু একদম সুস্থ, ভাল খাচ্ছেও। নিয়ে যান বাড়ি, কোন অসুবিধা হলে আমরা তো আছিই…
– না তা নয় ঠিক।
– তবে?
– না, মানে, বাবাকে বাড়িতে নিয়ে এলেও তো অনেক কেয়ার লাগবে, শরীর তো এখনও উইক, আমাদের বাড়িতে একতলাতে আমি আর মা থাকি, আবার কিনা দোতলাতে তেমন জায়গাও নেই আর, বাবা হাসপাতালে ছিল এই কমাস, আমরাও অন্যরকম ভাবে গুছিয়ে নিয়েছি। এখন ওঁকে সিঁড়ি দিয়ে ওঠাতে নামাতে অনেক অসুবিধা…
– তার মানে আপনারা..
মেয়ে যখন নির্বিকার চিত্তে অজুহাতের জাল বুনে চলেছে তখন মাকেও দেখলাম হাসি মুখে ঘাড় নেড়ে যেতে, এবারে তিনি মুখ খুললেন, – ড্যারেনকে আমরা আর বাড়ি নিয়ে যেতে চাই না, আপনারা কোন কেয়ার হোমের ব্যবস্থা করুন।
আমাকে ওই করিডরে বোকার মতো দাঁড় করিয়ে রেখে এবারে মা আর মেয়ে হাসপাতালের গেটের দিকে হাঁটা লাগাল।
খবরটা ড্যারেনকে দেওয়ার মতো শিড়দাঁড়ার জোর আমার ছিল না। জুনিয়র ডাক্তারটি যখন যতটা সম্ভব যত্ন নিয়ে ওকে খবরটা দিচ্ছে তখন আমি একটু দূরে বেসিনের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম বোবা ড্যারেন মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে টুপটাপ। কাঁধ দুটো ঝুলে পড়েছে। খবরটা শোনার আগের আর পরের কয়েক মিনিটের মধ্যেই মানুষটার বয়স যেন আরো কুড়ি বছর বেড়ে গেল।
সেই দিন রাতেই ড্যারেন আর্ল মারা যায়।
ড্যারেনের স্ত্রী আর মেয়ে ওঁকে নিঃসন্দেহে ভালবাসত, কিন্তু মানুষের মন খুব প্লাস্টিক, নমনীয়। তাকে যেমন খুশি বাঁকিয়ে তেড়িয়ে নেওয়া যায়। আসন্ন মৃত্যুর সাথে আপস করতে করতে ওদের মনটারও আর ড্যারেনকে দরকার হয়নি। স্ত্রী আর চায় নি তার স্বামীকে, মেয়ে তার বাবাকে। বুড়োকে ছেড়ে দুজনেই আবার সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। তাই ম্যাজিক করে বেঁচে ফেরা ড্যারেন তখন তাদের কাছে উদ্বৃত্ত।
ড্যারেনের ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর প্রথম কারণ লেখা হয়েছিল মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশন, কিন্তু আমি জানি ওটা ড্যারেনের ইচ্ছামৃত্যু ছিল। ওর বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা মরে গিয়েছিল সেই মুহূর্তটায়, যখন জুনিয়র ডাক্তারটি কানের কাছে বলেছিল, আপনার ফ্যামিলি চায় না আপনি এখন বাড়িতে আসুন, ওদের একটু অসুবিধা হবে, তবে আপনি একদম চিন্তা করবেন না মিস্টার আর্ল, হাসপাতালের বিস্বাদ খাবার আর খেতে হবে না আপনাকে। আমরা আপনার জন্য সেরা কেয়ার হোমের ব্যবস্থা….
অসাধারন।আবার অপেক্ষায় রইলাম।
ক্ষমা চেয়ে নিয়েই বলছি। আপনার মোবাইল নাম্বার টা যদি দেন, খুব সমস্যা তে না পড়লে ফোন করবো না। আমি এর নিয়মিত পাঠক।