চারদিকে শুধু খারাপ খবর, এর মাঝে দাঁড়িয়ে আজ একটা জিতে যাওয়ার গল্প বলি।
ডাক্তারকে রুগীর প্রতি সংবেদনশীল হতেই হয়। কিন্তু সেখানেও একটা প্রচ্ছন্ন দুরত্ব বজায় রাখি আমরা, কারণ খুব বেশি কোন রুগীর সঙ্গে মানসিক ভাবে যুক্ত হয়ে পড়লে আমাদের চিকিৎসার পদ্ধতিতে ক্ষতি হতে পারে। তাই একজন রুগীর প্রতি একটা ‘অব্জেক্টিভ ভিউ’ সব সময় থাকে আমাদের। কিন্তু তার পরেও কোন কোন ঘটনা মনে দাগ কেটে যায়।
গত জানুয়ারি মাসে ইংল্যান্ডে কোভিডের মহামারির প্রকোপ ভয়ানক ভাবে বেড়ে যায়। এই সময়ে আমার হাসপাতালের আইসিইউ বেডের সংখ্যা ২০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ তে। এই ৮০টি বেডের বেশির ভাগ রুগী তখন কোভিড আক্রান্ত। এত সংখ্যক রুগীকে সামলানোর জন্য যে পরিমাণ ডাক্তারের প্রয়োজন তা আইসিইউ এর ছিল না। তাই জানুয়ারি মাসে অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের কিছু ডাক্তারকে আইসিউতে ডিউটি করতে যেতে হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলাম আমি।
যেদিন থেকে আইসিউতে আমার ডিউটি শুরু হওয়ার কথা তার আগের দিন একটা এমার্জেন্সি অপারেশন হল। শিভন মিলসের বয়স চল্লিশ, ওজন একশো কেজির উপরে। শিভন জ্বর আর পেটের ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয় হাসপাতালে। সিটি স্ক্যানে দেখা যায় পেটের বাঁদিকে কোলনে ইনফেকশন হয়ে কোলন ফুটো হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে শিভনের প্রথম আলাপ অপারেশন টেবিলে। ততক্ষণে সার্জারি শুরু হয়ে গিয়েছে। অন্য দুজন সার্জেন অপারেশন করছেন। আমি তাদের অ্যাসিস্ট করার জন্য নামলাম। শিভনের পেটের ভিতরের অবস্থা খুবই খারাপ, মল কোলনের ফুটোর মধ্য থেকে বেরিয়ে গোটা পেটে ছড়িয়ে আছে। বেশ ভাল রকমের ইনফেকশন হয়ে রয়েছে। শিভনের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যানেস্থেসিস্টও চিন্তিত। বেশিক্ষণ ওকে এভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাবে না। তার কারণ ওর ওজন অস্বাভাবিক ভাবে বেশি, লাংসের অবস্থা ভাল নয়, ডায়াবেটিস আছে এবং ব্লাড সুগার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই অবস্থায় পেটের সেপসিস শিভনকে মৃত্যুর আরো কাছে ঠেলে দিয়েছিল। খুব বেশিক্ষণ ধরে অপারেশন করা গেল না। ফেটে যাওয়া কোলনকে কেটে বাকি কোলনকে পেটের উপরে এনে মলত্যাগের রাস্তা করা হল। পেটের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মলকে যতটা সম্ভব বার করে দেওয়া হল। অপারেশনের পর শিভন আইসিউতে গেল।
এরপর দিন থেকে শুরু হল আমার আইসিউ এর এক মাসের ডিউটি। এই কাজে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই, সিনিয়র ডাক্তারদের সাহায্য করি। আইসিইউ এর ৮০ খানা বেডের মধ্যে ৭৪ খানাতেই কোভিড রুগী। তাদের প্রত্যেকের মুখে নল পড়ানো আছে, ভেন্টলেটরে রয়েছে তারা। প্রতিদিন সকাল আসি আর হ্যান্ডওভারের মিটিং এর সময় খেয়াল করি আগের দিনের লিস্টের চার-পাঁচজন আর নেই, তাদের জায়গায় এসেছে নতুন রুগীরা। ডাক্তারদের প্রানান্তকর চেষ্টা সত্ত্বেও যেভাবে একের পর এক কোভিড রুগী মারা যাচ্ছিল সেই দৃশ্য দুঃস্বপ্নের মতো, সেই মৃত্যু ভয়ঙ্কর। দুটো ফুসফুসই ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায়, এক্সরেতে একেবারে সাদা লাগে দেখতে। তারপর হার্ট ফেল করতে থাকে। কারোর কারোর আচমকাই শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্তপাত হতে থাকে। একটা সময় অসহায় হয়ে ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দেয়। ভেন্টিলেটর বন্ধ করার কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যায় রুগী, তার জায়গায় চলে আসে ওয়ার্ডে অপেক্ষা করতে থাকা আরেক কোভিড পেশেন্ট। এই মৃত্যু মিছিলের মধ্যেই আইসিউ এর একটা ছোট ঘরে জীবনের সঙ্গে লড়াই করছিল আরো পাঁচটি রুগী। এদের কোভিড হয়নি, এদের মধ্যে একজন শিভন।
অপারেশনের দিন সাতেক পরেও শিভনের অবস্থা দেখলাম একই রকম। ভেন্টিলেটরের নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে ও। বুকটা সামান্য ওঠানামা করছে। আমি রোজ একবার করে শিভনকে দেখতে যেতাম। দেখে আমাদের সার্জারির টিমকে জানাতাম শিভন কেমন আছে। রোজই আমার টেক্সটটা এমন হত।
Intubated, blood markers not improving, stoma not working.
দশ বারোদিন কেটে যাওয়ার পরেও শিভনের পেটের উপরে বানানো পায়খানার রাস্তা অর্থাৎ স্টোমা কাজ করা শুরু করল না, পেটটা বিশ্রি ভাবে তখনও ফুলে আছে। এর অর্থ শিভনের সেই সেপসিস এখনও ঠিক হয়নি। বারবার অ্যান্টিবায়োটিক বদলেও কোন সুরাহা হয়নি। শিভনের ওজন বেশি হওয়ার কারণে ভেন্টিলেশনেও অসুবিধা হচ্ছিল। মেয়েটার গলা বলে প্রায় কিছু নেই, মুখটা কাঁধের সাথে মিশে গেছে। প্রতিদিন ভেন্টিলেশন কমাবার চেষ্টা হলেই শিভনের স্যাচিউরেশন কমতে শুরু করত, আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে হত। এভাবে কতদিন চলবে?
পনেরো দিন কেটে গেল। এর মধ্যে শিভনের পাশের আরো চারটে বেডের রুগীদের বেশ কিছু বার বদল হল। একজন মারা গেল, বাকিরা সুস্থ হয়ে ওয়ার্ডে ফিরল। কিন্তু শিভনের শারীরিক উন্নতির কোন লক্ষণই নেই। কোন একটা জায়গায় গিয়ে চিকিৎসা থামাতে হবে, ডাক্তারদের বলতে হবে যে আমরা যতটা পেরেছি লড়েছি, আর কিছুই করার নেই আমাদের। কিন্তু শিভনের বয়স মাত্র চল্লিশ! বাড়িতে তার দুটি সন্তান আছে। শিভনের স্বামীকে আমি রোজ একবার করে কল করে বলি স্ত্রী কেমন আছে। কোভিডের কারণে হাসপাতালে আসার সুযোগ নেই তার। তিনি আমার কথা শোনেন, তারপর ঠান্ডা গলায় বলেন,
কোন আশা আছে?
আমি বলি চেষ্টা আমরা করছি। এইটুকু বলেই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফোন নামিয়ে রাখি।
একদিন মাঝরাত থেকে শিভন প্রচন্ড কাঁপতে শুরু করল। খুব জ্বর এসেছে ওর। ভোরবেলায় ন্যাসাল সোয়াবের রিপোর্ট এল, শিভনের কোভিড হয়েছে। এইটুকুই যেন বাকি ছিল মেয়েটার। ওই ছোট ঘরটা থেকে শিভনকে বার করে এনে অন্যান্য কোভিড রুগীর মধ্যে রাখা হল। দিন তিনেকের মধ্যে শিভনের ফুসফুস দুটো সাদা হয়ে গেল। এই অবস্থায় সিনিয়র আইসিইউ কনসালট্যান্ট বললেন,
Lets call it a day now.
এবার আমাদের থামতে হবে। আর কোন ভাবে শিভনকে বাঁচানো সম্ভব নয়। ঠিক হল যে শিভনের ভেন্টিলেশনের মাত্রা কমিয়ে নেওয়া হবে, ওর রক্তচাপ ধরে রাখার জন্য যে ওষুধ দেওয়া হচ্ছিল তাও একটি লেভেলের ডোজের উপরে আর দেওয়া হবে না। তাই করা হল। দেখলাম শিভন তখনও লড়াই করে চলেছে। অপারেশনের ১৬ দিন পরেও এক মুহূর্তের জন্যও ওর জ্ঞান ফেরেনি, কিন্তু কম ভেন্টিলেশন নিয়ে, দুটো মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ফুসফুস নিয়েও মেয়েটা হার মানেনি। এবার যেন কোন জাদুমন্ত্রে ওর স্যাচিউরেশন ভাল হতে থাকল।
শিভনের শরীর একটু ভাল হলেও ওকে ভেন্টিলেটর থেকে একেবারে বার করে আনা গেল না। গলার টিউবটাও ওভাবে অতদিন রাখা যায় না। তাই ওকে থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে আবার একটা অপারেশন করতে হল। শিভনের গলার সামনের অংশ কেটে ট্রাকিওস্টোমি করা হল। সেখানে ঢোকানো হল নল। তাই দিয়ে চলল ভেন্টিলশন। শিভনটা এটাও সহ্য করে নিল।
একুশ দিন পরের কথা। একদিন ভোরবেলায় শিভনের জ্ঞান ফিরল। ভেন্টিলেশন তত দিনে অনেকটাই কমিয়ে নেওয়া হয়েছে। পেটের উপরে করা ওর স্টোমা তত দিনে কাজ করতে শুরু করেছে। কিন্তু এই তিন সপ্তাহে ওর পনেরো কিলো ওজন কমে গেছে। শরীরটা যেন অনেক শুকিয়ে রয়েছে, গোল মুখটা ছোট হয়ে হনুর হাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জ্ঞান ফিরে আসার পরই শিভন ছটফট করতে শুরু করল। গলায় লাগানো ট্রাকিওস্টোমির জন্য ও কথা বলতে পারবে না, এই বোধটা মেয়েটার তখনও আসেনি। ও এদিকে ওদিকে তাকায় আর নার্সদের হাত নেড়ে ডাকে। বোঝা যায় কিছু বলতে চাইছে। দেখলাম শিভনের চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। গত একুশদিনের কিছুই ও জানে না। ও শুধু এইটুকু বুঝেছে যে অপারেশনের পর ওর জ্ঞান ফেরার পর থেকে ও আর কথা বলতে পারছে না। আইসিউএর মনিটরের বিপবিপ শব্দ শুধু ওর সঙ্গী।
নার্সরা একটা বোর্ড আর কাগজ এনে দিল। দূর্বল হাতে পেন নিয়ে শিভন লিখল,
-আমি বাড়ি যাব।
জ্ঞান হওয়ার পরেই মেয়েটার প্রথম ইচ্ছা। স্বাভাবিক ভাবেই ও ফিরে যেতে চায় ওর স্বামী সন্তানের কাছে। কিন্তু এখনও তো সময় আসেনি। শিভনের কাছে গিয়ে ওকে বললাম এই কয়েক দিনে কী কী হয়েছে। বিকেলের দিকে নার্সরা ভিডিও কলে ওর সঙ্গে ওর স্বামী সন্তানের দেখা করিয়ে দিল। তাদের হাসি মুখ দেখে শিভন নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। এরপর থেকে ওকে বিছানায় রাখাই যেত না আর, ছটফট করতে করতে নেমে যেত। বিছানার পাশের চেয়ারে বসিয়ে রাখা হত ওকে। এতদিন শুয়ে থাকার কারণে ওর পায়ের পেশির জোরও এমন নয় যে ও একটু হাঁটতে পারবে। দিনে দু’বেলা ফিজিওথেরাপি চলতে লাগল ওর। আইসিউতে রাউন্ডে এলে দেখতাম ও করিডোরের রেলিং ধরে ধরে হাঁটছে, সঙ্গে একজন নার্স। আমাকে দেখে ডান হাত তুলে হাই বলত। প্রায় একমাস আইসিউতে কাটাবার পর একদিন সকালে শিভনের অক্সিজেন বন্ধ করার পরও দেখা গেল ও দিব্যি শ্বাস নিতে পারছে! ততদিনে ওর খাওয়া দাওয়াও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। নিজেই হেঁটে বাথরুমে যায়। সেদিন বিকেলে শিভনের ট্রাকিওস্টোমি খুলে দেওয়া হল।
একটা সোমবারে রাউন্ডে এসে দেখি শিভন বেশ সাজগোজ করে চেয়ারে বসে আছে। আমি ওর কাছে এগিয়ে এসে হাসি মুখে নার্সের দিকে তাকাতে নার্স বললেন,
-আজকে শিভন বাড়ি যাচ্ছে।
আমি শিভনের দিকে ফিরে বললাম,
-কী খুব খুশি তো?
শিভনের গলায় প্রচন্ড ব্যথার কারণে তখনও ও কথা বলতে পারে না। আমার কথার উত্তরে ও একগাল হাসল,
তারপর মজার ছলে পট করে ডান চোখটা টিপল।
আমি তখন আরো একবার মৃত্যুকে হেরে যেতে দেখলাম। শিভন সেদিন আমার মতো আরো জনাপনেরো ডাক্তার নার্সের মুখে হাসি ফুটিয়ে ছিল। যারা এই একমাস অক্লান্ত পরিশ্রম করেও কত মানুষকে বাঁচাতে পারেনি, দিনের শেষে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে বসেছে। শিভন সেদিন আমাদের সবাইকে জিতিয়ে দিয়েছিল। জীবনের এমন উদযাপনের সুযোগ তো আর রোজ রোজ হয় না।
সহমত পোষণ সহমত পোষণ করছি এই মুহূর্তে লকডাউন বন্ধ হোক।