অনেকদিন পর আবার স্ক্যালপেল লিখতে বসলাম।
বরাবর আমিই লিখি, আপনারা পড়েন। আজকেও তার অনেকটা একইরকম থাকবে, লিখছি, কিন্তু আপনাদের জন্য একটা প্রশ্ন রেখে যাব এই লেখার শেষে। প্রশ্নটা খুব অস্বস্তিকর হলেও উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন। চাইছি এটা নিয়ে আলোচনা হোক।
আজ আগে একজনের কথা বলি, মার্গারেট ওয়েসলের বয়স ৬৫। দুই বছর আগে মার্গারেটের হার্ট অ্যাটাকের পরে বাইপাস সার্জারি করতে হয়। সার্জারির পরে সেবারে মতো মার্গারেটকে বাঁচানো সম্ভব হলেও ওঁর হৃদপিন্ডটা দূর্বলই রয়ে গিয়েছিল। এক বছর আগে ওর আবার একটা স্ট্রোক হয়। তারপর থেকে মার্গারেটের দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে বিছানায়, শরীরের বাঁদিকটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
এক সন্ধ্যায় মার্গারেটকে হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে নিয়ে এল ওঁর মেয়ে, মার্গারেটের পেটে অসহ্য ব্যথা। স্বাভাবিক ভাবেই সার্জারির ডাক্তারবাবুটির ডাক পড়ল। মার্গারেটের পেটের সিটিস্ক্যান করালাম, তাতে দেখা গেল হতভাগ্য মার্গারেটের কোলনে অনেকদিন ধরে বাসা বেঁধেছিল ক্যান্সার। সেই ক্যান্সারের জন্য কোলন এখন ফেটে গেছে, পেটের ভিতরে ছড়িয়ে পড়েছে মল। মার্গারেটের রক্তে সেপ্টিসেমিয়ার ছাপ স্পষ্ট।
এই অবস্থায় সার্জেনের কাজ হল রুগীকে জলদি থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া, কোলনের ফেটে যাওয়া অংশ বাদ দিয়ে পেটের ভিতরে জমে থাকা মল বা পুঁজ পরিস্কার করা, তারপরে কোলনের সুস্থ অংশকে পেটের উপরে নিয়ে আসা। একে বলে কোলস্টমি, রুগীর মল তখন পেটের ওপরে লাগানো একটা ব্যাগে জমা হয়। এই অপারেশন ঠিক ভাবে করতে পারলেই সেই যাত্রায় মানুষটাকে বাঁচিয়ে তোলা যায়।
কিন্তু মার্গারেটকে থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হল না। কারণ আমি অপারেশন করে ওর কোলন পেটের উপরে নিয়ে চলে এলেও ওর নিজের জীবনটা কেমন হত? দুর্বল হৃদপিন্ডর ওপরে জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়ার চাপ সহ্য করতে পারত মার্গারেট? পক্ষাঘাতগ্রস্থ শরীর নিয়ে দিনের পর দিন নিজের কোলস্টোমির ব্যাগ পরিষ্কার করতে পারত ও? যে ক্যান্সার ওর শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে তার জন্য কেমোথেরাপি নেওয়ার ক্ষমতা ওর দূর্বল শরীরের থাকত? আমি সার্জেন হয়ে খুব নিপুণতার সঙ্গে না হয় অপারেশনটা করে দিলাম। কিন্তু আমি কি আদৌ মার্গারেটের জীবনটাকে বাঁচালাম? নাকি আরো এক দুর্বিষহ জীবনের দিকে ঠেলে দিলাম ওকে?
সার্জেনের হাতে স্ক্যালপেল আছে মানেই সে তাকে চামড়ায় ছোঁয়াবে এমন নয়। কখনও কখনও তাকে স্ক্যালপেল নামিয়েও রাখতে হয়। যে চিকিৎসায় রুগী কেবলমাত্র বেঁচে থাকবে, কিন্তু তার জীবন যাপনের মান হবে নরক যন্ত্রণার সমান সেই চিকিৎসার কি আদৌ কোন প্রয়োজন আছে?
মার্গারেট আর ও মেয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা হল। ডাক্তারের নৈতিক দায়িত্ব রুগীকে মিথ্যা না বলা। আমিও মার্গারেটকে জানালাম ওর অপারেশন হলেও যদি ওকে অপারেশন টেবিল থেকে বাঁচিয়ে আনা যায় তাহলে ওঁর বাকি জীবনটা কেমন হবে। এমন জীবন মার্গারেট চান না। মার্গারেটের জন্য আমরা দুটো ফর্ম ভরলাম। সেই ফর্ম দুটো ওর ফাইলে রাখা হল। ওয়ার্ডে মার্গারেটকে ভর্তি করে ওকে যতটা সম্ভব আরামে রাখা হল। মরফিন দিয়ে ওর ব্যথা কমিয়ে আনা হল, ওর যাতে শ্বাসকষ্ট না হয় তাই অক্সিজেন দেওয়া হল। মার্গারেটের সঙ্গে একে একে দেখা করতে এল ওর পরিবার পরিজন। কয়েক ঘন্টা পরে শান্তির ঘুমের মধ্যে মারা গেলেন মার্গারেট।
যে দুটো ফর্ম আমরা ভরলাম তাদের জন্যই আজকের স্ক্যালপেল লেখা। ফর্ম দুটোর নাম EOLC আর DNACPR।
EOLC এর পুরো কথা হল End Of Life Care. রুগীর জীবনের শেষ ঘন্টাগুলোতে তাকে যতটা সম্ভব আরামে রাখা। খেয়াল রাখা যাতে তাকে ব্যথায় কষ্ট না পেতে হয়, সে যদি কিছু খেতে চায় তাতে যেন বাধা দেওয়া না হয়, তার যদি শ্বাসকষ্ট হয় তাহলে যেন অক্সিজেন মাস্ক সে পায়। সে যে ধর্মে বিশ্বাসী সেই ধর্মের যাজক আসেন তার সঙ্গে কথা বলতে।
DNACPR এর পুরো কথাটা একটু খটমট। Do Not Attempt CardioPulmonary Resuscitation. এর মানে হল রুগীর হৃদপিন্ড কাজ করা বন্ধ করলে (কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট) তাহলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হবে না। কথাটা শুনতে অমানবিক মনে হচ্ছে কি? কিন্তু ভেবে দেখুন, আগের বারের মতোই যদি বুকে বারবার চাপ দিয়ে, শক দিয়ে যদি মানুষটাকে মৃতুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনা হয় তাহলে কি তাকে আদৌ বাঁচানো হল? নাকি তার মরণ যন্ত্রণাকে প্রলম্বিত করা হল?
আবার একই কথা বলি, সঠিক চিকিৎসার লক্ষ্য একটা মানুষকে কেবল বাঁচিয়ে রাখা নয়, তাকে একটা বাঁচার মতো জীবনের যোগ্য করে তোলা।
এবার অন্য আরেক দিকের কথা ভেবে দেখুন। মার্গারেটের যদি অপারেশন হত তাহলে বেশ কয়েকজন সার্জেন, অ্যান্সেস্থেটিস্ট, নার্সের প্রয়োজন হত। থিয়েটার ব্যস্ত থাকত ওই সময়ে, অন্য কোন রুগীর অপারেশন করা যেত না। অপারেশনের জন্য যন্ত্রপাতিও লাগত। পরে ওকে কেমোথেরাপি দিলেও তার খরচ ছিল। মার্গারেটের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলেও অন্তত চারজন ডাক্তার, নার্সকে প্রয়োজন হত সেই সময়ে।
ইংল্যান্ডে চিকিৎসায় কোন খরচ হয় না। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে সব চিকিৎসা বিনামূল্যে হয়। সে আপনার গায়ের ছোট্ট ফোঁড়া কাটা থেকে শুরু করে বাইপাস সার্জারি অবধি, দেশের নাগরিকদের জন্য সব ফ্রি। কিন্তু হাসপাতালের রিসোর্স তো খরচ হয়ই।
শুধু অর্থ না, লোক বল, সময় এগুলোও কিন্তু স্বাস্থ্যব্যবস্থার সম্পদ বা রিসোর্স। এই তিনটেই হাসপাতাল ঠিক ভাবে কাজ করার জন্য ভীষনই প্রয়োজনীয়। তাই এদের সঠিক ব্যবহারের দিকেও নজর রাখতে হয় বই কী।
তাহলে কি ডাক্তারবাবুরা মার্গারেটের জীবনে দাঁড়ি টেনে এনে অমানবিক কাজ করলেন? নাকি মার্গারেটের জীবনের শেষ ঘন্টাগুলোকে যতটা সম্ভব শান্তিপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করলেন? অন্যদিকে হাসপাতালও তার রিসোর্সকে অন্য রুগীর প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারল।
কিন্তু আমাদের নিজেদের দেশে তো এমনটা হতে দেখিনি কখনও।
দেখেছি ফাইনাল স্টেজের ক্যান্সার আক্রান্ত রুগীর জন্য তার বাড়ির লোক জমিজমা বন্ধক রেখে টাকা জোগার করেছে। তাকে কেমোথেরাপি দিয়েও সুস্থ করে তোলা যাবে না জেনেও লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে চিকিৎসায়। সেই মানুষটি মারা গেছেন। তারপরে তার পরিবার সংসারের কী হয়েছে? পাহাড়ের মতো দেনার বোঝা বয়েছে তার স্ত্রী-সন্তান। এভাবে বাঁচানোর চেষ্টা কি সত্যিই চেষ্টা? দেশের বা রাজ্যের যে হাতে গোনা মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে তারা হয়ত
সেই অর্থ খরচ করতে পিছপা হবেন না। কিন্তু বাকিদের কী হবে?
এখানে সমস্যাটা অনেক গভীরে। হাসপাতাল বা ডাক্তার কি কখনও বলেন যে রুগীকে এভাবে আর বাঁচানো সম্ভব নয়, অথবা বাঁচিয়ে রাখলেও তার জীবন যাপনের ধরণ হবে যন্ত্রণাময়? অন্যদিকে রুগীর বাড়ির লোকও ভাবেন ‘একটা শেষ চেষ্টা করি’। এই ‘চেষ্টা করা’-র অতল গভীরে তলিয়ে যান তারা। এখানে সামাজিক ভাবনাটাও অনেকটা দায়ী। আমাদের সমাজ এখনও এতটা ‘প্র্যাক্টিকালি’ ভাবতে রাজী নয়। তার ফল কী হচ্ছে?
প্রতিদিন এমন চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন রুগীরা যা আদতে নিষ্ফলা। আর্থিক অস্বচ্ছলতার ঘূর্ণাবর্ত থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারছেন না তার পরিবার পরিজন। যে যাওয়ার সে চলে যায়, কিন্তু যারা পড়ে থাকে তাদের কী হয়? টাকা নেই বলে মেয়েটার হয়ত বিয়ে পিছিয়ে যায়, ছেলেটার উচ্চশিক্ষার স্বপ্নটা নষ্ট হয়ে যায়, অথবা সে আর বাড়িটাকে পাকা করতে পারে না, দেনা শোধ করে মাথা তুলে দাঁড়াতেই হয়ত ছেলে না মেয়েটির দশটা বছর লেগে যাবে।
‘মানবিকতা’ শব্দটার যতটা ওজন ততটাই জটিল এই মানবিকতার বোধ। একটা নিশ্চিত মৃত্যুকে প্রলম্বিত করতে গিয়ে একটা পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতার শিরদাঁড়া বেঁকে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া কি আদৌ মানবিকতার পরিচয়? প্রতিটি মৃত্যুই শোকের, একজন কাছের মানুষকে হারানো চরম কষ্টের। কিন্তু কবে আমরা বুঝব কোথায় থামতে হবে? ‘আমার সর্বস্ব দিয়ে লড়ে যাব’ এই বোধ থেকে কবে বেরিয়ে আসতে পারব আমরা?
আপনাদের কী মনে হয়? নাকি যেমন চলছে তেমনটাই ভাল?
আমাদের মতো গরিব দেশে এই ব্যবস্থা চালু করা অত্যন্ত জরুরি…. বহু পরিবার নিঃস্ব হওয়া থেকে বাঁচবে…
আমি মানবিকতার পক্ষে।আপনার সঙ্গে।আপনার লেখার সঙ্গে।