২০১২ সাল, আমি তখন আর.জি.করে সেকেন্ড ইয়ারের ট্রেনি। একদিন আমার ইনটার্ন ভাই বিক্রমের কাছে শুনলাম ওর মাকে নাকি ভর্তি করতে হয়েছে চেস্ট মেডিসিনের ওয়ার্ডে। দেখতে যেতে হবে। ফুসফুসের চারিদিকে জল জমেছে। একে আমরা প্লিউরাল ইফিউশন বলি। কিন্তু কেন জলটা জমল সেটা খুঁজে বার করা দরকার। সেই জন্যই আমার যাওয়া।
বিকেলবেলা, বিক্রমের সাথে চেস্ট মেডিসিন ওয়ার্ডে ঢুকলাম, কাকিমা বসেছিলেন বাঁ দিকের রো-এর একটা বেডে। ছোট খাটো মানুষ, গায়ে একটা ঘরে পরার শাড়ি জড়ানো। মায়াময় মুখ খানি। মায়েরা যেমন হয় আর কি। কয়েক মিনিট বসে কথা হল, আমার বাড়ি কোথায়, কে কে আছেন বাড়িতে, সদ্য বিয়ে করেছি, স্ত্রীয়ের ছবি দেখালাম, খুব মিষ্টি মেয়ে..
সার্জারির ডাক্তারবাবুকে তারপরে কাজের কথায় আসতেই হল। বুকে জল জমল কেন? কি করে বোঝা গেল জল জমেছে? কাকিমা বললেন কদিন ধরে শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল খুব, সেখান থেকেই বুকের এক্সরে করা, তাতেই ধরা পড়ল।
আর কিছু?
এই ‘আর কিছু’ টার কথা বিক্রম আমাকে আগে থেকেই বলেছিল, কিন্তু কাকিমার মুখ থেকেই শুনতে হত।
– বাঁ দিকের বুকে একটা ফোলা দেখছিলাম কয়েক মাস ধরে।
– ফোলাটা বাড়ছে?
– হ্যাঁ, প্রথমে একটা ছোট মার্বেলের মতো ছিল বুঝলে, কিন্তু দেখতে দেখতে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।
– কাউকে বলেননি?
– কাকে বলব বাবা, এতো মেয়েদের লজ্জার জিনিস। তুমি ছেলের মতো, তোমাকে বলতেই লজ্জা লাগছে।
ওয়ার্ডের সিস্টার দিদিকে ডেকে নিয়ে কাকিমার বেডের চারিদিক পর্দা দিয়ে ঘেরা হল। তারপরে সেই মানুষটা অনেক কুন্ঠার সাথে ব্লাউজ সরালেন।
বাঁ দিকের স্তনে ডিউস বলের সাইজের একটা টিউমার। শক্ত পাথরের মতো। ওপরের চামড়া পাতলা হয়ে কালো হয়ে এসেছে। বাঁ দিকের বগলেও অনেকগুলো ছোট ছোট ফোলা।
বিক্রমের মায়ের স্তনের ক্যান্সার হয়েছিল। ওই টিউমার থেকে বায়োপ্সি করে জানা গেল বেশ বাজে রকমের ক্যান্সার। ছড়িয়েছে বগলের লিম্ফ গ্ল্যান্ড গুলোতে। বুকের সিটি স্ক্যান হল, তাতে দেখা গেল ক্যান্সার ছড়িয়েছে দুটো ফুসফুসেই, ডাক্তারি নাম মেটাস্টাসিস । সেই মেটাস্টেসিস থেকেই জল জমেছে বুকে।
স্টেজ ফোর ব্রেস্ট ক্যান্সার। এই মারণ রোগের অন্তিম পর্ব।
আমি আর বিক্রম রিপোর্ট হাতে পেয়েই বুঝেছিলাম কি হতে চলেছে। সন্তান তার যত্নে কোন ত্রুটি রাখেনি। অনেক ব্যয় বহুল কেমো থেরাপি চলল। কিন্তু কাকিমাকে বাঁচানো গেল না। পরের কয়েক মাসেই সব শেষ।
বিক্রমের মা একা নন। আর.জি.করে প্রতি সপ্তাহে এমন রুগী দেখতাম আমরা। স্বামী নিয়ে আসতেন স্ত্রীকে, ছেলে-মেয়ে নিয়ে আসত মাকে। এঁরা সবাই সংসারের কাজেতেই নিজের সর্বস্ব ঢালা মানুষ। বুকের ওপরে গজিয়ে ওঠা চাকতিটাকে প্রথমে পাত্তা দেননি। লজ্জায় লুকিয়েছেন বাড়ির লোকের কাছে। যখন এসেছেন আমাদের কাছে তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেরী হয়ে গেছে। অনেক সময় এমনও দেখেছি যে সেই টিউমার ফেটে ঘা তৈরি হয়েছে, পুঁজ গড়াচ্ছে, অথচ মানুষটা তাও মুখ বুজে সহ্য করে চলেছেন।
স্তন নারী শরীরের একটা দারুণ জিনিস। আমি যদি বলি এদের কাজ শুধু মাত্র সন্তানদের লালন করা তাহলে সেটা মারাত্মক বড় দ্বিচারিতা হবে। দুপেয়ে মানুষের সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে পুরুষের শরীরে মনে ঢেউ তুলেছে এই এক জোড়া গোলক। নারী শরীরের যে অংশের জন্য লেখকরা কবিরা সবচেয়ে বেশি শব্দ খরচ করেছে সেটা এই নরম ফ্যাটের টুকরোই। মেয়েদের শারীরিক সৌন্দর্যের প্রায় সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে স্তনের আকার,গঠন। তাহলে যে অঙ্গটাকে নিয়ে এত মাতামাতি তাকে নিয়েই এত অবহেলা কেন?
আমাদের দেশে প্রতি চারজন মহিলা ক্যান্সার রুগীর মধ্যে একজন ভোগেন স্তনের ক্যান্সারে। পাশ্চাত্যের থেকে সামান্য কম। কিন্তু সেই তুলনায় মারা যান অনেক বেশি রুগী। তার কারণ এদেশে অধিকাংশ স্তনের ক্যান্সার ধরা পরে অনেক দেরীতে। অন্য দিকে ইংল্যান্ডে এসে দেখেছি একদম অন্য ছবি। এখানে প্রায় অধিকাংশ স্তনের ক্যান্সার প্রাথমিক স্টেজের বাইরে এগোয় না। তার আগেই রুগী আসেন সার্জেনের কাছে। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গোটা স্তন বাদ দিতে হয় না। স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরে যেতে পারেন সেই মহিলাটি।
আমাদের দেশে এমনটা হয় না কেন?
কারণটা হল লজ্জা। নিজের আব্রু বজায় রাখার চেষ্টা।
তার মানে কি পাশ্চাত্যের মেয়েদের লজ্জা নেই?
আছে তো। লজ্জা নারীর একটা সহজাত প্রবৃত্তি। দেশ বদলালেও এই প্রবৃত্তি বদলায় না।
তাহলে ওদের এমন কি আছে যেটা আমাদের নেই?
সেই জিনিসটা হল সমাজের দৃষ্টি ভঙ্গী। আমাদের মেয়েরা খুব ছোটবেলা থেকে শরীর নিয়ে সচেতন। ওড়না বা শাড়ির আঁচলের এপাশ ওপাশ হলে বিড়ম্বনায় পরে তারা। যে দেশে মেয়েদের শেখানো হচ্ছে নিজেকে ভাল করে ঢেকে রাখ তাহলেই পুরুষরা কামে উন্মত্ত হয়ে ঝাঁপাবে না সেই দেশে মেয়েদের শরীরের প্রতিটা ইঞ্চির গোপনীয়তা রক্ষার তাগিদ অনেক।
দেশ হয়ত এগোচ্ছে। কিন্তু আমাদের মন এগোচ্ছে না।
যেসব মহিলারা এই লেখা পড়ছেন তাদের বলি, আপনার স্তন দুটি আপনার খুব বড় গর্বের অঙ্গ। ওদের যত্ন নিন, যাদের বয়স তিরিশের বেশি তারা অন্তত মাসে একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুটো স্তন পরীক্ষা করুন। গোলমেলে কিছু মনে হলেই একজন সার্জেনকে দেখিয়ে নিন। আর যাদের বয়স পঞ্চাশের ওপরে তারা একবার দুটো স্তনেরই এক্সরে করান, একে ম্যামোগ্রাফি বলে। আপনার সার্জেনই এই টেস্ট লিখে দেবেন। একবার ম্যামোগ্রাফির রিপোর্ট ভাল এলে তিন বছর ছাড়া ছাড়া করালেই হবে।
আর ছেলেদের বলি, নিজের স্ত্রীকে এটা পড়ান। দিদি, বোন বা মাকে নিজে থেকে পড়াতে না পারলে ফরোয়ার্ড করে দিন।
নিচের লিঙ্কে ক্লিক করলে একটা পিডিএফ পাবেন, সেটা ডাউনলোড করতে পারেন, স্তনের ক্যান্সারের স্ক্রিনিং নিয়ে অনেক সহজ ভাবে বোঝানো আছে,
https://www.gov.uk/government/publications/breast-screening-information-for-women-with-learning-disabilities
খুব সুন্দর লেখা।