ডেবি রোজের বয়স আঠেরো। ও আমাদের ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিল জন্ডিস নিয়ে। ডেবি কখনও আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। শুধু হেসেছে। হাসপাতালকে রোগ বালাইয়ের সরাইখানা বলা যায়। এর এক একটা ঘরে এক এক রকমের অসুখ লুকিয়ে থাকে মানুষের শরীরে বাসা বেঁধে। অসুখের সাথে সুখের একেবারেই বনাবনি নেই, তাই হাসপাতালের ওয়ার্ড গুলোতে একটা বিষন্নতা ছেয়ে থাকে। একজন রুগী হাসপাতালে হাসে কখন? সুস্থ হয়ে গেলে, বা সুস্থ হওয়ার রাস্তায় চলা শুরু করলে, তাই না?
কিন্তু ডেবি প্রথম থেকেই হাসত।
ডেবির ডাউন সিনড্রোম ছিল।
আমাদের শরীরের একুশ নম্বর ক্রোমোজোমে গোলমাল হলে শিশু ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মায়। যারা এতে ভোগে তারা খর্বকায়, গোলগাল চেহারার হয়। মুখটা হয় মোঙ্গলদের মতো। অর্থাৎ মাথার ওপরের দিকটা একটু চ্যাপ্টা মতো, চোখ দুটো সরু, বড় জিভ, এবড়োখেবড়ো দাঁত। এদের মানসিক বয়স আটকে থাকে আট-নয় বছরে। ডাউনেরও আবার অনেক প্রকারভেদ হয়। ডেবির ডাউনের মাত্রা এতটাই ছিল যে ওর মানসিক বিকাশ অনেকটাই আটকে গিয়েছিল। বাইরের পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া কোন কিছুই ওকে স্পর্শ করতে না।
আমার একদিনের অন কল ডিউটিতে ডেবি ভর্তি হল জন্ডিস নিয়ে। ওকে প্রথম দেখলাম ওয়ার্ডের একটা সাইড রুমে, শুয়ে আছে। ক্লান্ত চোখ দুটো বোজা। নার্স ততক্ষণে স্যালাইনের নল লাগিয়ে দিয়েছেন। ডেবির গোটা শরীরটা গাঢ় হলুদ বর্ণের।ডেবির পাশে বসেছিলেন ওর বাবা মা। ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম শরীরটা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। প্যারাসিটামলেই জ্বর কমে যাবে। কিন্তু জ্বরটা এল কেন?
জন্ডিস যে ভাল রকমেরই হয়েছে তা রক্তের পরীক্ষাতেই ধরা পড়ল। তার সাথে পাওয়া গেল ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। এটাই তাহলে জ্বরের কারণ। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া শরীরে এল কীভাবে তা জানার জন্য যে পরীক্ষা করার প্রয়োজন তার ধকল ডেবি নিতে পারত না সেইদিন। আমরা অ্যান্টিবায়োটিক চালু করলাম। আগে জীবাণুটাকে মারি, তারপরে তার গোড়াটা খুঁজব না হয়।
পরেরদিন রাউন্ডের সময় ডেবির ঘরে ঢুকে দেখি মেয়ে চোখ খুলেছে। অনেক চনমনে লাগছে ওকে। যদিও তখনও হাতের ক্যানুলা দিয়ে স্যালাইন চলছে। ডেবি অবাক চোখে বাবার মোবাইলে কার্টুন দেখছিল। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে একগাল হাসল।
অপরিচিত মানুষ দেখলেই আমাদের মধ্যে প্রথমে যে লজ্জা যা আপাত গুটিয়ে থাকা ভাবটা আসে তা ডেবির মধ্যে ছিল না। তা ওর ডাউন সিনড্রোমের জন্যই। আমি ডেবির কপালে হাত দিয়ে দেখলাম গা তখনও গরম, কিন্তু আগের দিনের তুলনায় কম। ওর হাসিতে আমিও মুখে হাসি এনে বললাম,
-কেমন আছ ডেবি? ইউ ওকে?
ডেবি কোন উত্তর দিল না। মুচকি হেসেই চলল। হলুদ ঘোলাটে চোখের মনিদুটো তখনও উজ্জ্বল।
-ডেবি কথা বলে না ডক্টর।
ওর মা বললেন।
-ওহ, সরি মিসেস রোজ । আমি বুঝতে পারিনি।
-না না, ইটস ওকে। সবারই প্রথমে এই ভুলটা হয়। ডেবির বরাবরই কথা বলে না। কখনও কখনও ইশারায় বোঝায় ওর কী চাই। কিন্তু আমাদের মেয়ে সবসময় হাসে। কখনও ওকে গোমরা মুখে দেখবেন না। আমরাও কোনদিন ওর চোখে জল বা মুখে রাগ দেখিনি।
ডেবির মাথায় স্নেহের হাত বোলাতে বোলাতে বলছিলেন ওর মা।
ডাউন সিনড্রোমের রুগীদের মধ্যে কেউ কেউ কথা বলতে পারে না। আমরা শুকনো ডাক্তারি বিদ্যা থেকে এটা জানি। কিন্তু এক মা যে তার সন্তানের জন্মাবধি তাকে মূক অবস্থায় দেখছে তার সাথে মানিয়ে নিয়ে এতটা পথ হাঁটাটা যে কতটা দূরহ তার বিন্দুমাত্র আঁচ আমার পাওয়ার কথা নয়। আমি তো শুধু রোগকে চিনি। রুগীর ভিতরটাকে কোনদিন চিনতে পারি না,বা তার ফুরসতও নেই আরো চল্লিশজন রুগীর মাঝে ডুবে থাকার দরুন। ডেবির মাকে কিন্তু দেখলাম মেয়েকে অনেক যত্ন নিয়ে বড় করেছেন। ডেবির কানে দুল আছে। চুল যত্ন করে বাঁধা মাথার দুপাশ দিয়ে। গোলাপি রঙের মিনি মাউস আঁকা টিশার্ট পড়েছিল ও। মিসেস রোজের কাছেই ডেবির জন্ডিসের ইতিহাস জানা শুরু করলাম।
বেশিদিন না, মাত্র দুসপ্তাহতেই মেয়েটা হঠাৎ করে এমন হলুদ হয়ে গেছে। গত পাঁচদিন তার সাথে জুড়েছে কাঁপুনি দিয়ে ধূম জ্বর। ডেবির যে হেপাটাইটিস অর্থাৎ লিভারের ভাইরাল রোগ হয়নি তা আগেরদিনই রক্তের রিপোর্টে বুঝেছিলাম। ওর পিত্তনালী কোথাও একটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে আসলে। তাই সেই পিত্ত লিভার থেকে অন্ত্রে আসতে না পেরে রক্তে মিশছে, জমছে চামড়ার নিচে। তাই চামড়াও হলুদ হয়ে উঠছে। ডেবির জ্বর আয়ত্তের মধ্যে আনতে পারার পরে ওর পেটের স্ক্যান করা হল।
আমরা যা ভেবেছিলা তাইই। পিত্তনালীতে পাথর আটকে আছে। এর চিকিৎসা হল মুখের মধ্যে নল ঢুকিয়ে অন্ত্রের মধ্যে দিয়ে পিত্তনালীতে পৌঁছে সেই পাথরকে বার করে আনা। একে ডাক্তারিতে ই.আর.সি.পি বলে। গোটা নামটা বেশ ভজকট,তাই নাই বা বললাম। ডেবিকে ই.আর.সি.পি করতে জানা ডাক্তারবাবুর কাছে রেফার করা হল।
হাসপাতালের সেরা গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট দেখতে এলেন ওকে। বললেন ই.আর.সি.পি করা সম্ভব নয়।
ডেবির ডাউন সিনড্রোম আমাদের শত্রু হয়ে দাঁড়াল। ওর গলা খুব ছোট আর অনমনীয়, ঘাড় তেমন ভাঁজ হয় না। তাই ক্যামেরা ঢোকানো যাবে না। তবে হ্যাঁ, অজ্ঞান করতে পারলে একটা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। অতএব অজ্ঞানের ডাক্তার বাবু এলেন।
অ্যানেস্থেসিস্ট দেখে বললেন ডেবিকে অজ্ঞান করা যাবে না। কারণ ওর হৃদপিন্ড খুব দূর্বল। একবার অজ্ঞান করলে জ্ঞান না ফিরতেও পারে। তবে হ্যাঁ, হৃদপিন্ডের ডাক্তার যদি আশ্বাস দেন তাহলে অজ্ঞান করার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে।
কার্ডিওলজিস্ট ডেবির ইকোকার্ডিওগ্রাম করলেন নিজে হাতে। মেয়েটার হৃদপিন্ডের অবস্থা নাকি ভাল না। একে ডাউন সিনড্রোমের জন্য দূর্বল, তার ওপরে শরীরের ইনফেকশনে আরো কাহিল হয়ে গেছে। কোন রকম চাপই আর নিতে পারবে না।
ডাক্তারিবিদ্যাটা একটা খুঁটিতে বাঁধা গবাদি পশুর মতো। সে নিজের চরার জায়গায় ঘাস খায় মাথা নামিয়ে, ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও স্বাধীন ভাবে নিজেকে,ভাবে তার গমন অবাধে, অসীমে। এমন ভাবতে ভাবতেই গলায় বাঁধা দড়িতে টান পড়ে। সে ফিরে আসে খুঁটির কাছে। ডেবিকে আমরা কোন ভাবেই আর সুস্থ করতে পারব না, এটা মেনে নিতে বেশ অসুবিধা হয়েছিল আমাদের। তিনটে ডিপার্টমেন্ট মিলিয়ে মিটিং হল, যদি কোন একটা উপায় বার করা যায়। তেমন কিচ্ছু পাওয়া গেল না। মহাশক্তিমান, ভগবানকে প্রায় ছুঁয়ে থাকা ডাক্তাররা তাদের অস্ত্র নামিয়ে রাখল।
এই যুদ্ধটা যে কদিন ধরে চলেছে সে কদিন রোজ আমি রাউন্ডে ডেবিকে একবার করে দেখতে গিয়েছি। দেখেছি মেয়েটার গায়ের চামড়া গাঢ় হলুদ থেকে ধীরে ধীরে কমলা বর্ণের দিকে এগোচ্ছে। শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে। বারবার অ্যান্টিবায়টিক বদলিয়েও বন্ধ হয়ে থাকা পিত্তনালীর ইনফেকশনকে বাগে আনা যাচ্ছে না।
ডেবি কিন্তু রোজ আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছে। অপাপবিদ্ধ হাসি। আমি আর কিছু বলতে পারতাম না, ওর বাবা মাও বুঝতে পারছিলেন কী হতে চলেছে। মেয়েটা দিন পনেরো রোগের সাথে যুঝে হার মানতে লাগল। একদিন সকালের রাউন্ডে ওয়ার্ডে ঢোকার পরে সিস্টার বললেন ডেবির অবস্থা একেবারেই ভাল না। পেট ফুলে গেছে। ওর ঘরে ঢুকে দেখি ওর বাবা-মা দুজনেই মাথার কাছে বসে আছেন। ডেবির শরীরের চামড়ার তলায় এক একটা জায়গায় রক্ত জমতে লেগেছে, হৃদস্পন্দন হয়ে এসেছে ক্ষীণ, শ্বাসের ওঠানামা দ্রুত আর অগভীর। এই মুহূর্তটাকে আমি চিনি। অনেকবার সাক্ষী থেকেছি এর।
এই সময় মৃত্যু এসে বলে তুই যে নিছক মানুষ সেটা আরেকবার বুঝে নে ভাল করে।
আজকে লিখতে বসে এত কিছু ভাবছি, কিন্তু সেদিন সেই মুহূর্তে এই সার্জারির ডাক্তারবাবুর এত ভাবনার অবকাশ ছিল না। আরো বেশ কিছু রুগী দেখতে হবে, ক্লিনিকে যেতে হবে, অনেক কাজ। আমি সেদিন সব জেনে বুঝেও মুখে স্বভাবসিদ্ধ মেকি হাসি টেনে এনে ডেবিকে বলেছিলাম
-ইউ ওকে?
মেয়েটা নিষ্প্রভ চোখ নিয়ে হেসেছিল শুধু। আগের সবদিনের মতো।
সেদিন দুপুরে ডেবি মারা যায়।
||
এই যে আমরা শ্বাস নিই, হাঁটি, দৌড়ই, ভালবাসি, আঘাত পাই, হিংসা করি, হাসি, কাঁদি এই সব কিছু আমাদেরকে প্রতি নিয়ত বোঝায় আমরা বেঁচে আছি। আমাদের পাঁচটা ইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা শুষে নিচ্ছি চারপাশের জগতটাকে। ডেবির কিন্তু একটি মাত্রই অভিব্যক্তি ছিল। ওর কোন ভয় ছিল না; কষ্ট, ব্যথা ছিল না; রাগ-হিংসা ছিল না। ছিল শুধু হাসিটুকু। তাই যখন মৃত্যু ওর ঘাড়ের কাছে গরম শ্বাস ফেলছে তখনও ও হেসেছে। জীবন আর মৃত্যুর তফাতটুকুই যে মেয়েটা আঠেরো বছরের জীবনে বোঝেনি।
কখনও চরম ব্যথায়, দারুণ মনের কষ্টে কুঁকড়ে গেলেও তাই জীবনকে ধন্যবাদ দেবেন। জানবেন ওই ব্যথাটুকুও আপনাকে বেঁচে থাকার স্বাদ দিচ্ছে।