২০১৭ সালে মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বেসরকারি হাসপাতালের রাহাজানি রুখতে বিশেষ বিল পাস হয়। সেদিন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী অভিযোগ করেন, ‘লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিত্সা খরচ। আমরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোম, সব জায়গায় একই ব্যবস্থা চলছে। আমার মনে হয় এমন ঘটনা গোটা দেশেই চলছে। এনাফ ইজ এনাফ।’
আজ সে বিলের কি অবস্থা আমি পাঠককুলকে ভেবে দেখতে বলব। বর্তমানে নতুন করোনা প্রকোপে যখন গোটা রাজ্য আক্রান্ত তখন কি সে বিল মেনে চলছে বেসরকারি হাসপাতাল?
একই অবস্থা গোটা দেশে। গোটা পৃথিবীতে। স্বাস্থ্য যখন সবচেয়ে বড় পণ্য তখন সুলভ চিকিৎসা এক বড় অংশের কাছে সুদূর স্বপ্নে পরিণত। এই পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে চূড়ান্ত আর্থিক বৈষম্য। এই পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ দৈনিক ২ ডলারের কম অর্থে জীবন কাটায়। নভেল করোনা ভাইরাস তাদের কাছে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, সমাজ সর্বত্র এর প্রভাবে মানুষ বিপর্যস্ত।
ধরুন একে নিয়ে চলছে এক রক্তাক্ত মুনাফার লড়াই। কে আগে আনবে ভ্যাকসিন? ভ্যাকসিন জরুরি এ নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু লড়াইটা বিজ্ঞানীদের বা গবেষকদের নয়। রাজনৈতিক নেতা থেকে বহুজাতিক কোম্পানি সবাই যেন কোন বানেগা ক্রোড়পতির মত লোভের আর লাভের জিভ বার করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এখানে মানবতার বিজ্ঞান নয় নির্মম বাণিজ্য তাল ঠুকছে। এর ওপর তাদের কোটি কোটি টাকার মুনাফা নির্ভর করছে।
এ যুগে বিজ্ঞানী বা গবেষকরা অসহায়, যাদের হাতে তাদের পরিশ্রম মেধার ফসল প্রায় কিছুই থাকে না। ধরুন পৃথিবীর কজন জানেন কে প্রথম মোবাইল ফোন আবিষ্কার করেছিলেন সেই ডঃ মার্টিন কুপারকে? সবাই জানেন অপ্পো, সামসুং, নোকিয়া, এপেল এসব কোম্পানির নাম। তিনি কিন্তু বেঁচে আছেন। আমরা কজন কম্পিউটারের জনক চার্লস ব্যাবেজকে মনে রেখেছি? কিন্তু সবাই চিনি এইচপি, এপেল, ডেল বা লেনোভো ইত্যাদি কোম্পানির নাম। কারণ গবেষণা আজ বিশাল ব্যয়বহুল ও বহুধাবিস্তৃত কর্মসূচি যা কোন ব্যক্তি বা কয়েকজনের এমনকি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও বহন করা সম্ভব নয়। তাই চাই রাষ্ট্রের ভূমিকা।
কিন্তু দেশের সরকার মানবকল্যাণে গবেষণা থেকে তার হাত উঠিয়ে নিয়েছে। তারা বলছে ‘লেট মার্কেট ডিসাইড’ বা বাজার সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করুক। ফলে দানবের মত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো গোটা গবেষণা আবিষ্কারের পেটেন্ট সব ভোগ দখল করছে। ১৯৭০ সালে যেখানে কর্পোরেট সংস্থাগুলি গবেষণার কাজে ২.৩% আর্থিক দায়িত্ব বহন করত, ২০০০ সালে সেটা হল ৮% আর ২০১৬ তে প্রায় ১৫% এর বেশি। (ডেরেক বক, ইউনিভার্সিটিজ ইন মার্কেট প্লেস )।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুসারে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ (প্রায় ২০০ কোটি) তাদের অসুস্থতার সময় নিয়মিত ভাবে প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণের সুযোগ নিতে পারে না। এশিয়া- আফ্রিকার কিছু দেশে এই পরিমাণ পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি। পৃথিবীর শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ মূল্যের ভিত্তিতে শতকরা ৯০ ভাগ ওষুধ ব্যবহার বা ভোগ করে। মানে বাকি ৮৫% মানুষ মাত্র ১০% ব্যবহারের ক্ষমতা রাখে।
অপরদিকে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৯৬ অবধি সারা পৃথিবীতে মোট ১২২৩ টি যে নতুন ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে তার ১% এরও কম হয়েছে এই উষ্ণ প্রধান দেশগুলির বা ট্রপিক্যাল রোগের ওপর। একই ভাবে গত ২৫ বছরে নতুন আবিস্কৃত ওষুধের খুব ন্যূনতম ট্রপিক্যাল রোগ বা যক্ষ্মার জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে, যদিও পৃথিবীর মত রোগভারের ১১% এই অসুখগুলির জন্য হয়ে থাকে। শতকরা ৯০ ভাগ নতুন আবিষ্কৃত ওষুধ পৃথিবীর ধনী ২০% মানুষের যে রোগগুলি হয়ে থাকে , তার জন্য ব্যবহৃত হয়। (The Lancet: Drug development output; what proportion for tropical diseases? July 99)। বর্তমানে গড়ে একটি নতুন ওষুধ বাজারজাত করতে খরচ হয় প্রায় ২২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবার বুঝুন, অধিকাংশ গবেষণা তাই বিভিন্ন ধাপে অসফল হয়ে বন্ধ করে দিতে হয়। তাই দেশের সরকার এ বিষয়ে দায়িত্ব না নিলে তা সম্পূর্ণ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে পড়ে। তারা যে গবেষণালব্ধ ওষুধে লাভ অনেক বেশি, তাতেই অর্থ ঢালে। বিভিন্ন ট্রপিক্যাল রোগে, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বলছে, শুধু ২০১৫ সালে ৪ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছেন বা ২৫০ মিলিয়ন মানুষ বাকি জীবন ভুগেছেন বা সময়ের আগে মারা গেছেন। কিন্তু এসব রোগের জন্য গবেষণা বিশেষ ভাবে অবহেলিত।
ইতিমধ্যে এর বেশ কিছু রোগকে ডব্লিউ এইচ ও অবহেলিত রোগ বলে চিহ্নিত করেছে। যেমন ডেঙ্গু, লেপ্রসি (কুষ্ঠ), সিস্টসেরকসিস, পীত জ্বর, চাগাস রোগ, ফাইলেরিয়াসিস বা গোদ, লেশ্মিনিয়াসিস, এস্ক্যারিয়াসিস ইত্যাদি। এছাড়া ম্যালেরিয়া, মাল্টি ড্রাগ রেসিস্টেন্ট যক্ষ্মা, ডায়রিয়া, গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন, এইডস এসব তো আছেই। কিন্তু ভারতে এসব রোগের ওপর গবেষণায় সরকারি বরাদ্দ ক্রমশ কমছে। বেসরকারি কোম্পানির গবেষণায় এগুলো অবহেলিত। কারণ সাধারণত এসব গরিব মানুষের বেশি হয়।
তথ্যসূত্র:
1.https://www.wonderslist.com/10-popular-companies-profited-nazis
2. Government’s Policies and Growth of Pharmaceutical Industry in India 1947-2018 :A Review Discussion Paper, Prasanta Kumar Ghosh, published by RIS (Research and Information System for Developing Countries)
3. Federation of Medical and Sales Representatives’ Associations of India, news and conference documents, Patna 2019
4. Shyamal Chakroborty ঐতিহ্য উত্তরাধিকার ও বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত, দ্বিতীয় মুদ্রণ 2011
5. অসুস্থ ওষুধের জগত Association of Health Service Doctors & West Bengal Medical and Sales Representatives Union,
লেখক ডাঃ তাপস সেন, শ্রী অমিতাভ গুহ,
এপ্রিল 2008
6 পেটেন্ট কাহিনী আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে,
লেখক: অংশুতোষ খাঁ ও শ্যামল চক্রবর্তী,
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, আগস্ট 2006
7. প্রাচীন ভারতে শল্য চিকিৎসা, লেখক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, মৌলবাদ ও বিজ্ঞান পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ
8. সাবধান জীবানুরা নিকটেই আছে! মৃত্যুঞ্জয়প্রসাদ গুহ, জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনী, জানুয়ারি 2006
9. Pharmaceutical Industry in India wikipedia
10. বিশ্বায়ন ভাবনা দুর্ভাবনা, সম্পাদক অমিয় বাগচী, অমিতাভ গুহ, 2002, প্রকাশক ন্যাশনাল বুক এজেন্সি
11. The 21st Century Pharmaceutical and Biotech Sector, Robin Walsh
12. সবার জন্য নয় ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা dw.com
13. National Family Health Survey 65 (NFHS-4), Ministry of Health and Family Welfare, 2015-16
14. What are APIs and How They Threaten India’s Status of a ‘Pharmacy of the World’, Himani Chandna, The Print, 26th February, 2020
15 .The Health Workforce in India,
Human Resources for Health Observer, Issue No. 16 WHO
16. Emergence of Pharmaceutical Science and Industry: 1870-1930 Chemical and Engineering News, Vol.83, Issue 25
17. The Lancet: Drug Development Output; What Proportion for Tropical Diseases? July 99
18. বিজ্ঞান ও অনুসন্ধান– স্বাধীন নির্মোক, পরাধীন গবেষণা, জয়ন্ত ভট্টাচার্য
(চলবে)