‘ডাক্তার বাবু একসপ্তাহ ধরে কোমরে অল্প অল্প ব্যথা হচ্ছিল। ভেবেছিলাম কমে যাবে। কিন্তু কাল থেকে ডানপায়ে এমন যন্ত্রণা শুরু হয়েছে যে পায়ের আঙুল পর্যন্ত কনকন করছে। উরুর পেছনে জ্বালা করছে, পায়ের তলায় যেন কাঁটা ফুটছে।’
অথবা,
‘সকালে বেসিনে মুখ ধুচ্ছিলাম। তারপর হঠাৎ সোজা হতে গিয়ে দেখলাম কোমরটা আটকে গেছে। আর দু পায়ে কনকনে যন্ত্রণা হচ্ছে। হাঁটতেই পারছি না।’
এই ধরণের ব্যথার সমস্যা নিয়ে মাঝে মাঝেই রোগীরা আসে।
‘ডাক্তার বাবু আমার কি এটা সায়াটিকার ব্যথা ?’
সায়াটিকা হতে পারে এসব ক্ষেত্রে। তবে মনে রাখতে হবে যে, সব পায়ের যন্ত্রণাই কিন্তু সায়াটিকা নয়।
‘সায়াটিকা’ এক বিশেষ ধরণের তীব্র কনকনে পায়ের যন্ত্রণা যা কোমরের নীচের অংশ বা পাছা থেকে উরুর পেছন দিয়ে হাঁটুর পেছন দিয়ে পায়ের ডিম, গোড়ালি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পায়ের পাতা পর্যন্ত নেমে আসে। এই যন্ত্রণা সায়াটিক নার্ভের উৎপত্তিস্থল অর্থ্যাৎ মেরুদন্ডের কোমরের (লাম্বার) নীচের দিকের নার্ভের গোড়া। লাম্বার নার্ভ অর্থ্যাৎ স্নায়ুতন্তু গুলোর রুট বা গোড়া থেকে উৎপন্ন হয়ে সায়াটিক নার্ভের পথ বেয়ে চলে। তাই একে বলে ‘সায়াটিকা’। এক্ষেত্রে ব্যথার সাথে স্নায়ু বা নার্ভে চাপ পড়া বা স্নায়ু তন্তু উত্তেজিত হওয়ার নানান উপসর্গ- যেমন, পা ঝিন্ঝিন্ করা, জ্বালাপোড়া ভাব, পায়ের কোনো অংশে অসাড় ভাব, পায়ের আঙুল বা পায়ের পাতার জোর কমে যাওয়া, পা ভারী-ভারী লাগা, অল্প খুঁড়িয়ে হাঁটা থাকতে পারে।
যন্ত্রণা যদি উরু বা পায়ের সামনের দিকে হয়, ব্যথা যদি হাঁটুর নীচে কখনই না যায়, ব্যথার সাথে যদি অন্য উপসর্গ না থাকে – তাহলে তাকে সায়াটিকা বলা মুশকিল।
এখানে প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, বাংলা ভাষায় ব্যথা ও যন্ত্রণা আলাদা শব্দ হলেও চিকিৎসা পরিভাষায় ব্যথার বিভিন্ন রূপের মধ্যে একটা রূপ হল ‘যন্ত্রণা’। প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ নয়।
সায়াটিকা নারী-পুরুষকে সমান তীব্রতায় আক্রমন করে। মধ্যবয়সে ৪০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে এর প্রবণতা সবচেয়ে বেশী থাকে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সায়াটিকার কারণ নিহিত থাকে মেরুদন্ডের ভেতরে – যাতে স্নায়ুতন্তু বা নার্ভের গোড়ায় চাপ পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী হয় স্লিপ ডিস্ক, অর্থ্যাৎ মেরুদন্ডের হাড় বা কশেরুকার মাঝে মাঝে যে জেলি জাতীয় পদার্থ থাকে তা সরে গিয়ে মেরুদন্ডের ভেতরে স্নায়ুতন্তুর গোড়ায় চাপ পড়ে। এছাড়া মাঝবয়সে বা বেশী বয়সে লাম্বার স্পন্ডিলাইটিস, স্পন্ডাইলোলিস্থেসিস বা মেরুদন্ডের হাড় সরে যাওয়া, কোমরে চোট, মেরুদন্ডে সংক্রমণ হয়ে পুঁজ জমা, মেরুদন্ডের টিউমার- এইসব কারণেও সায়াটিকা ব্যথা হতে পারে।
তাছাড়া মেরুদন্ডের বাইরে কোনোভাবে সায়াটিক নার্ভে চাপ পড়লে সায়াটিকা হয়। যেমন- মাংসপেশীর তীব্র সংকোচন, টিউমার কারণে।
সায়াটিকা নিজে কোনো রোগ নয়। মেরুদন্ড বা তার আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো রোগের উপসর্গমাত্র।
স্লিপ ডিস্কের কারণে সায়াটিকা হলে সেই ব্যথা কাশলে বা হাঁচলে প্রচন্ড বেড়ে যায়। রোগীকে বিছানায় চিৎ করে শুইয়ে হাঁটু সোজা রেখে পা একটা একটা করে বিছানা থেকে উপরে তোলার চেষ্টা করলে ব্যথা মারাত্মক বাড়ে।
কোনোভাবে স্নায়ুতে চাপ পড়ে সায়াটিকা ব্যথা হয় ঠিকই তবে প্রথম কয়েকদিন তার সাথে থাকে স্নায়ুর গোড়ায় রস জমে যাওয়া, বিষাক্ত কিছু রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে স্নায়ুর উত্তেজনা, জ্বালা ইত্যাদি। দুয়েকদিন পরে এই রাসায়নিক কারণগুলো কমে যায়। তার পরেও যদি সায়াটীকা ব্যথা না যায় তবে তার কারণ গুরুত্ব সহকারে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে খোঁজা উচিত। প্রথমে এক্সরে, দরকার হলে রক্তপরীক্ষা, এম আর আই, সিটি স্ক্যান, নার্ভের সঞ্চলন পরীক্ষা ইত্যাদি করতে হতে পারে।
প্রথমদিকে বিশ্রাম নেওয়া, ভারী কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা, ব্যথার ওষুধ, গরম শেঁক ইত্যাদিতে কাজ হতে পারে। তা না হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মেরুদন্ড বিশেষজ্ঞ, অস্থিবিশেষজ্ঞ, ব্যথা বিশেষজ্ঞরা এই ব্যথার চিকিৎসা করেন।
বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট ব্যায়াম, বিশ্রাম, শরীরের ওজন কমানো, ধূমপান ত্যাগ করা, শোয়া-বসার ভঙ্গিমায় সতর্ক যত্ন নেওয়া, ব্যথার ওষুধ, ফিজিও থেরাপি, মেরুদন্ডে স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন – এসবে কাজ হয়। কোনো কোনো বিরল ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
সায়াটিকা ব্যথা চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে সেরে যাওয়া উচিত। তার চেয়ে বেশীদিন থাকলে তা ক্রনিক ব্যথায় পরিণত হয়। সেক্ষেত্রে ফলাফল অত ভাল হয় না।
ক্রনিক ব্যথা জটিল আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি মানসিক সমস্যা, হতাশা তৈরী করতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হতে পারে।