সৃষ্টিসুখের একজন ফোন করলেন রাত আটটা নাগাদ। একটা বই আমাকে দিতে এসেছেন তিনি। বইটার ছবি এখানে দিতে পারব না।
তার আগে বইটা সম্বন্ধে বলি। দেশভাগ সম্পর্কে লেখা কবিতার এক বিশাল সংগ্রহ। প্রায় সাড়ে তিনশ জন লেখকের লেখা। এক জায়গায়। বিশাল কাজ নিঃসন্দেহে। প্রকাশক সৃষ্টিসুখের সাহস দেখে অবাক হতে হয়। সব লেখককে এই মস্ত বইয়ের এক কপি করে দেওয়া সহজ কথা নয়। তাও আবার কবিতার বই। সেই বই বিক্রি করা যাবে এই রকমের আত্মবিশ্বাস সত্যিই ঈর্ষণীয়। আরও অবাক কাণ্ড। তাঁরা প্রকাশের দিনে গরহাজির লেখকদের কপি বাড়িতে পৌঁছে দেবেন পণ করেছেন। ঠাট্টা করে বলাই যায় ধন্যি ছেলের অধ্যবসায়।
সেই বইয়ের ছবি কেন দিতে পারলাম না সেটি এবারে খোলসা করে বলি। আমি থাকি বারাসতে, প্রতাপাদিত্য রোডে। একই জায়গায় একই নামে দুটি রাস্তা থাকার কথা নয়। এখানে কিন্তু আছে। আমরা যেখানে থাকি এটি আগে ছিল পঞ্চায়েত। পরে মিউনিসিপ্যালিটিতে ঢুকেছে। সেই আমলেই এই রাস্তার নাম ছিল প্রতাপাদিত্যের নামে। এদিকে পুরোনো মিউনিসিপ্যালিটিতেও আর একটি রাস্তা আগে থেকেই ছিল একই নামের। কাজেই একই শহরে একই নামের দুটি আলাদা রাস্তা রয়েছে। আমার ঠিকানায় দেওয়া রাস্তায় না এসে সৃষ্টিসুখের সেই তিনি পৌঁছেছেন অন্য রাস্তাটিতে। এমনই কপাল সেই রাস্তায়ও আর এক জনের কাছে একই বই পৌঁছনোর কথা। সেই প্রাপক আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি শ্রীমান চন্দন ঘোষ।
যাই হোক শেষ অবধি ফোনাফুনি করে যা ঠিক হল, আমার বইটিও তিনি চন্দনের কাছে রেখে যাবেন। আমি ওর থেকে নিয়ে নেব।
এই ঠিকানার গণ্ডগোল আমার জীবনে বহুবার ঘটেছে। ঘটনাক্রমে আমি আর চন্দন দুজনেই বক্ষরোগের চিকিৎসক। কিন্তু সে তো খাতায় কলমে। কোথায় আমি ডাক্তারি থেকে অবসৃত এক অস্তিত্ব আর কোথায় চন্দন। সে হল গিয়ে যাকে বলে গর্জনশীল(ইংরেজিতে রোরিং) প্র্যাকটিশনার। কিন্তু রাস্তার নাম যে একই। কদাচিত পথভোলা রোগীর ভুল সংশোধন করে দিতে হয় আমাকে।
এর চাইতেও বড় ব্যাপার ঘটেছে। আমার নামের চিঠি বিলি হয়েছে কলকাতার প্রতাপাদিত্য রোডে। সেখানেও কিঞ্চিৎ ভাগ্যের চিমটি রয়েছে। আমার এলাকার PIN হল ৭০০১২৬ আর কলকাতার রাস্তার পিন ৭০০০২৬, কাজেই ভুল ঘটেছে।
কাণ্ড হয়েছিল যখন আমার পোস্টিং ছিল নদীয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জে। কলকাতার স্টেট ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট, টাকা বেশি ছিল না, হাউসস্টাফশিপের জমানো এক দেড়শ টাকা, সেইটি ট্র্যান্সফার করতে চেয়েছিলাম কর্মস্থলে। বছরখানেক পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম সেটি পৌঁছেছে বিহারের কিষাণগঞ্জে।
ঠিকানা বিভ্রাটের সব চেয়ে মজার ঘটনা ঘটেছিল মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে। ঠিক ঠিকানা বিভ্রাট নয়, নাম বিভ্রাট। আমার বছর পাঁচেকের সিনিয়ার অরুণাংশু চৌধুরীর কাছে পৌঁছেছিল অ্যাড্রেস নট ফাউন্ড ছাপ মারা আমার লেখা খামে বন্ধ চিঠি। ভারি ভদ্র মানুষ ছিলেন দাদাটি। খাম না খুলে আমাকে খুঁজে চিঠিটা দিয়েছিলেন। ভেতরে ছিল আমার লেখা ব্যর্থ একটি প্রেমের চিঠি। আমার ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে এক অতি শহুরে অভিজাত পরিচিতা তাঁর ঠিকানা বলে যেটি দিয়েছিল সেটা ডাহা ভুল ছিল।
মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় এই পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি কৃষ্ণবর্ণ ভাঙাচোরা পার্সেলটিকে বিধাতাপুরুষের ডাকপিওন ভুল ঠিকানার এই সবুজ গ্রহে বিলি করে যায়নি তো?
নইলে কেউই চিনতে পারে না কেন? কেন আমার বন্ধুরা, এমনকি নিজের কন্যাটিও অবধি ব্লক করে দেয় আমাকে?