রিটায়ার্ড চাকুরে হরেন্দ্রনাথ নিজেকে প্রয়োজনমত সংশোধন করতে দ্বিধা করেন না। দ্বিধা তো করেনই না, একটু যেন ভালোও বাসেন। ভুল কিছু ঘটলে তা সংশোধন হওয়াই উচিত।
প্রতিক্রিয়াশীলদের উৎপীড়নে সারা জীবনে নিজের বহু ভুল বহুবার সংশোধন করেছেন। এই বাবদে তাঁকে সংশোধনবাদীও বলা যায়।
আজ আবার নিজেকে সংশোধন করলেন হরেন বাবু। এ’বারের ব্যাপারটা অবশ্য বেশ জটিল।
ব্যাপার বুঝিয়ে বলতে গেলে হৃদয়ঙ্গম করা বেশ মুশকিল।
হরেনবাবুর বয়েস হয়েছে বটে। কিন্তু সেই বয়েসকে ঘাড়ে উঠতে দেননি। ব্যান্ডের গান শোনেন। র্যাপট্যাপও। খুব নরম গোছের ওই খোলামেলা ইয়েটিয়েও মোবাইলে ডাউনলোড করে দেখেন দু’একটা।
আর চুটিয়ে সায়েন্স ফিকশন পড়েন।
তো গতকাল রাতে এ হেন কল্পগল্পের পোকা হরেন স্বপ্নের ভেতরে উঠেছিলেন এক সময়যানে। উঠেই খালি একটা সিনিয়র সিটিজেন সিট পেয়ে গুছিয়ে বসলেন তিনি।
কোথায় যাচ্ছিলেন খেয়াল নেই। তবে যদ্দুর মনে পড়ছে, জুলিয়াস সিজারকে সত্যিই ব্রুটাস কোপ মেরেছিল কিনা এই ঘটনা দেখাবার জন্য একটা অতীত-ভ্রমণের কনডাকটেড ট্যুর ছিল।
টিকিটে ডিসকাউন্ট অফার ছিল। যানে উঠে ফাঁকা একটা সিনিয়র সিটিজেন সিটে গুছিয়ে বসলেন তিনি।
এই সময়যানটা আবার লোকাল ট্রেনের মত।
প্রচুর স্টপ। প্যাসেঞ্জার ওঠানামা করছিল মাঝে মাঝেই। মাঝে একটা স্টেশনে, বোধহয় শ’ পাঁচেক বছর আগের হবে সে’খানে গাড়িটা দাঁড়াতেই, এক ছোকরা উঠে এসে হরেনের সিটের সামনে দাঁড়াল।
এসেই খুব মোলায়েম গলায় তাঁকে বলল, – খোকা, সিনিয়র সিটিজেন সিটটা যে ছাড়তে হবে। এট্টু বসব। অনেক দূর যাব আসলে। আম্রপালি মহাশয়ার সঙ্গে দেখা কত্তে যাচ্চি তো!
দু’বছর আগে রিটায়ার করা হরেন্দ্রনাথ অবাক হলেন।
গলায় কণ্ঠি, কপালে তিলক, চোখ ঢুলুঢুলু এই নবীন ছোকরা তাঁকে সিনিয়র সিটিজেন সিট ছাড়তে বলছে! আবার ‘খোকা’ বলে ডাকছে। এ কী অরাজকতা?
তাঁর দোনামনা ভাব দেখে, বুঝিয়ে বলল পাশের সিটের সহযাত্রী। – বুইলেন না, এই বাবাজি তো আপনার চাইতে কিছু না হোক পাঁচশ’ বছরের বড়। নিমাই চৈতন্যের চেলা বলে বোধ হচ্চে। দিন বাবু, সিটটা ছেড়েই দিন।
অকাট্য যুক্তি শুনে কোমরে ব্যথা নিয়েই সিট খালি করে উঠে দাঁড়াতে হল হরেনকে।
এইটুকু দেখেই ঘুমটা ভেঙে গেল।
প্রস্টেট বেড়েছে বলে রাতে বার চারেক উঠতে হয় বেচারাকে। পরে শুয়ে ফের ঘুম এলো বটে কিন্তু কল্পস্বপ্নটা ফিরে এলো না।
ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম শেষে সকালে যখন উঠলেন হরেনবাবু, স্বপ্নটা মনে পড়ল।
নিজেকে শেষ বারের মত সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নিলেন শ্রী হরেন্দ্রনাথ সরখেল, আজ সকাল থেকে।
না বাসে মেট্রোয় আর তিনি সিনিয়র সিটিজেন সিটের সামনে ভিড় ঠেলে হাঁচোড়পাঁচোড় করে হাজির হবেন না। সিটের দাবীও করবেন না।
কে বলতে পারে?
সিনিয়র সিটিজেন সিটে বসে মোবাইলে ফেসবুক কিম্বা গেম খেলতে ব্যস্ত ওই তরুণ বা বালিকা সাজা যুবতীটি, যে কিনা তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও না দেখার ভান করছে, সে হয় তো আসলেই সুদূর অতীত থেকে বর্তমানে বেড়াতে আসা কোনও অতি সিনিয়র।