অপরিকল্পিত, অত্যাশ্চর্য, অভূতপূর্ব আবিষ্কার যা আমাদের জীবনের ধ্যানধারণাকে পাল্টে দেয়- এতবড় বাক্যকে ইংরিজিতে এক কথায় বলে Serendipity. যদিও বাংলা তর্জমা নেই তবু মানে বুঝতে কারুর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কথাটি অদ্ভুত হলেও বহুলপ্রচলিত এবং তার পেছনে একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। পারস্যের কল্পরাজ্য সেরেনদ্বীপের তিন রাজকুমারী নাকি এইরকম ঘন ঘন আবিষ্কার করতেন। মজার কথা হল যে কথাটি নাকি সংস্কৃত ‘সিংহল দ্বীপ’ এর অপভ্রংশ -তখনকার আরবীয় ব্যাপারীরা তাকে সেরেনদ্বীপে রূপান্তরিত করেন।
আমাদের অনেকের জীবনেই নাকি এরকম অনেক ঘটনা ঘটে থাকে কিন্তু আমাদের মনে দাগ কাটে না। তা উপলব্ধি করার মত ক্ষমতা আমাদের অধিকাংশেরই নেই। লুই পাস্তুর বলেছিলেন ‘ chance favours only the prepared mind’
নিউটন সাহেবের মাথায় আপেল পড়াকে কি serendipity বলা যাবে? যদিও আপেল আদৌ পড়েছিল কিনা সে বিষয়ে অনেকের সংশয় আছে। কিছু ক্ষেত্রে কিন্তু এই আখ্যা না দিয়ে কোন উপায় নেই। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং স্ট্যাফাইলোকক্কাস নামে এক ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ছুটি থেকে ফিরে দেখেন যে একটি পেট্রি ডিশের ঢাকনা খোলা থেকে গেছিল-আর সেই ডিশে এক নীল সবুজ ছত্রাক প্রবেশ করেছে। অনেকেই হয়ত সেই ডিশটি ফেলে দিতেন কিন্তু ফ্লেমিং সাহেবের চোখে পড়ল যে যেখানে ওই ছত্রাক ঢুকেছে তার চারপাশের ব্যাক্টেরিয়ার কলোনী ধ্বংস হয়ে গেছে। ছত্রাকের নাম penicillium -তার থেকে আবিষ্কৃত হল penicillin নামের অ্যান্টিবায়োটিক- আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের শুরু নাকি সেখান থেকেই।
বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও serendipity-র অজস্র উদাহরণ পাওয়া যায়। ধরুন ফরাসি বিজ্ঞানী অঁরি বেকরেলের গল্প। অনুপ্রভা (phosphorescence) নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ইউরেনিয়ামের একটি ক্রিস্টাল থেকে ফটোগ্রাফিক প্লেটে ছায়া পড়ছিল। বেকরেল সাহেব ভেবেছিলেন যে ক্রিস্টালের ওপর সূর্যালোক পড়ে নাকি তাই হচ্ছিল। ১৮৯৬ সালের এক দূর্যোগপূর্ণ দিনে উনি সেদিনের মত কাজ বন্ধ করে ক্রিস্টালটিকে একটি ফটোগ্রাফিক প্লেটে জড়িয়ে তাঁর কাজের ড্রয়ারে বন্ধ করে বাড়ি যান। কিছুদিন পরে ফিরে এসে ড্রয়ার থেকে ক্রিস্টালটি বের করে দেখেন যে ফটোগ্রাফিক প্লেটটি ঘোলাটে হয়ে গেছে। সূর্যের রশ্মিকে আর দোষ দেওয়া গেল না। আবিষ্কৃত হল তেজস্ক্রিয়তা (radioactivity)- যদিও নামটা পিয়ের ও মেরি ক্যুরির দেওয়া।
জার্মান বিজ্ঞানী রন্টগেন সাহেবের গল্পটাও বেশ মজার। Cathode ray tube নিয়ে কাজ করছিলেন। অন্ধকার ঘরে টিউব অন করলেই একটা প্রতিপ্রভ (fluorescent) স্ক্রিন জ্বলে উঠছিল। টিউবকে উনি যা দিয়েই ঢাকুন না কেন- স্ক্রিনের সেই দ্বীপ্তিকে বন্ধ করা যাচ্ছিল না। একরকম অসহায় হয়েই উনি টিউবের সামনে তাঁর হাত রাখেন-ব্যাস্ স্ক্রিনে ভেসে উঠল তাঁর হাতের অস্থিগুলির ছবি। স্ক্রিনকে ফটোগ্রাফিক প্লেট দিয়ে বদলে দিতেই জন্ম নিল প্রথম x-ray ছবি। মার্কিন দেশে রন্টগেন সাহেবকে সম্মান দেখাতে x-ray কে রন্টজেনোগ্রাম বলা হয় এখনো।
একটা আবিষ্কারের গল্প বলি যা আমরা দৈনন্দিন জীবনে অহরহ কাজে লাগাই অথচ সেই আবিষ্কারের কাহিনী হয়ত অনেকেরই জানা নেই। মার্কিন engineer Percy Spencer ম্যাগনেট্রন নিয়ে কাজ করছিলেন যা থেকে উচ্চ শক্তির তরঙ্গের বিচ্ছুরণ হয়। একদিন হঠাৎ নজর করলেন যে তাঁর পকেটে রাখা চকলেট বারটি গলে গেছে কাজ করার সময়। আপনি আমি হলে ভবিষ্যতে পকেটে চকলেট বার রাখা বন্ধ করতাম কিন্তু স্পেনসার সাহেব একটা বাটিতে পপকর্ণ রেখে মেশিনের সামনে রাখলেন। পপকর্ণ ফুটতে আরম্ভ করল। ১৯৪৫ সালেই উনি microwave এর পেটেন্ট নেন এবং তার কয়েক বছর পরেই তা জনসাধারণের রান্নাঘরে প্রবেশ করে।
আপনি হয়ত বলবেন যে এসব তো পুরনো গল্প- এর সাথে কোভিড সার্টিফিকেটের কি সম্পর্ক ? সেই বোঝাতেই আজকের এই লেখা। কোভিডের কল্যাণে আপামর জনসাধারণ একটা নতুন কথা শিখেছে-তা হল PCR. কি সেই পরীক্ষা-কেনই বা করা হয়? জেনেটিক্সের গোড়ার দু-চার কথা বলে নেওয়া ভাল।
কোষের অভ্যন্তরে থাকে নিউক্লিয়াস, যেখানে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম-যাতে জড়ানো DNA’র ফিতে। DNA’র ফিতে কিন্তু দুটো (double stranded) -একটা ফিতে আরেকটি ফিতেকে লেপ্টে জড়িয়ে থাকে। চার অক্ষরের বর্ণমালা দিয়ে DNA তৈরী-(A,T,G,C) – যাদের আমরা বলি base বা নিউক্লিওটাইড । এক ফিতের A সবসময় অন্য ফিতের T’র হাত ধরে আর C’র হাত ধরে G- তাই এদের বলা হয় complementary বা পরিপূরক base. যে কোনভাবেই সেই বর্ণমালা সাজানো থাকতে পারে-একই অক্ষর বার বারও আসতে পারে। আমরা যদি ফিতে বরাবর বানান পড়ে যাই তাহলে কখনো সেই বর্ণসমন্বয় প্রোটিন তৈরীর সংকেত বহন করবে (যখন তাদের আমরা বলি gene) কখনো বা করবে না (পরিভাষায় junk DNA). Transcription পদ্ধতিতে সেই জেনেটিক কোড চলে আসে নিউক্লিয়াসের বাইরে কোষের সাইটোপ্লাজমে messenger RNA বা mRNA’র হাত ধরে। সেই mRNA’র নির্দেশ অনুযায়ী সাইটোপ্লাজমে থাকা রাইবোজোম প্রোটিন সংশ্লেষ করে যাকে পরিভাষায় বলে translation.
এবার ধরুন একটি ছোট্ট টুকরো DNA থেকে আপনি গোটা DNA’র বানান উদ্ধার করতে চান (অর্থাৎ genetic code উদ্ধার করতে চান) – এটা অনেকটা টুকরো কিছু লেখা থেকে গোটা চিঠি উদ্ধার করার মত ব্যাপারটা। এইখানেই PCR বা Polymerase chain reaction এর ভুমিকা যা আধুনিক জিন প্রযুক্তিতে এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। এই পদ্ধতিতে gene amplification (পরিবর্ধন) করা হয়। অপরাধী সনাক্তকরণ, পিতৃত্ব-বিবাদ, রোগ নির্ণয় বা genetic engineering সর্বক্ষেত্রে এর প্রয়োগ। অনেকক্ষেত্রে এক ফোটা রক্তই এই পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট ।
এরকম যে কিছু একটা করা যায় তা প্রথম জানা যায় সেই সত্তরের দশকে। নরওয়ের বিজ্ঞানী Kleppe এরকম একটা ধারণা দিয়েছিলেন। ছোট ছোট DNA’র টুকরো (যাকে পরিভাষায় primer বলা হয়) থেকে DNA polymerase নামে এক উৎসেচকের সাহায্যে (যা Escherichia Coli নামে এক ব্যাক্টেরিয়া থেকে পাওয়া যেত) DNA’র ফিতে বা strand বানানো গেছিল- কিন্তু সে পদ্ধতি ছিল অনেক সময়সাপেক্ষ আর ৫০ ডিগ্রির উর্দ্ধে তাপমাত্রা উঠলেই উৎসেচকের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেত। সেই পদ্ধতিকে PCR নাম দেওয়া হয় নি।
এবার আসি সেই serendipity তে। ১৯৬৯ সালে আমেরিকার Yellowstone National Park এর উষ্ণ প্রস্রবন থেকে আচমকা আবিষ্কৃত হল এক ব্যাক্টেরিয়া যার নাম দেওয়া হল Thermus Aquaticus – অর্থাৎ এই ব্যাক্টেরিয়া গরম ও ভেজা জায়গায় থাকা পছন্দ করে। তার বছর সাতেক পরে সেই ব্যাক্টেরিয়া থেকে পাওয়া গেল এক উৎসেচক – উচ্চ তাপমাত্রাতেও যার কার্যক্ষমতা অক্ষত থাকে (যে জীবাণু উষ্ণ প্রস্রবণের মুখে বসবাস করে তার উৎসেচকের এই ক্ষমতা যে থাকবে তা বলাই বাহুল্য) – উৎসেচকের নাম করা হল Taq DNA Polymerase (Taq হল Thermus Aquaticus এর আদরের ডাকনাম)।
আমেরিকার রসায়ন বিজ্ঞানী কেরী মালিস ১৯৮৩ সালে cetus corporation এ Sickle cell disease এর বিটাগ্লোবিন জিন নিয়ে গবেষনা করছিলেন। গাড়ী চালাতে চালাতে নাকি তাঁর মাথায় আসে যে এই নতুন আবিষ্কৃত উৎসেচকের সাহায্যে যদি DNA’র পরিবর্ধন বা amplification করা যায়। জন্ম নিল সেই অভিনব পদ্ধতি যার সাহায্যে আণবিক জীববিজ্ঞান, বায়োকেমিস্ট্রি, জেনেটিক্স ও চিকিৎসাশাস্ত্রে এক নবদিগন্ত উন্মোচিত হল। আগের পদ্ধতির কিছু পরিবর্তন করলেন মালিস সাহেব। যেহেতু উচ্চ তাপমাত্রাতেও এই উৎসেচকের ক্ষমতা অক্ষত থাকে তাই বারবার thermal cycling এর ব্যবস্থা করা হল আর দেখা গেল যে বারবার বিক্রিয়ার জন্য একবার উৎসেচক দেওয়াই যথেষ্ট । Thermal cycling থেকেই chain reaction কথাটির সৃষ্টি। DNA’র পরিবর্ধন হতে লাগল সূচকীয় ভাবে ( exponentially).
১৯৮৯ সালে Science magazine Taq Polymerase কে ‘ Molecule of the year’ আখ্যা দেয়। এই আবিষ্কারের জন্য মালিস সাহেবকে দশ হাজার ডলার পুরষ্কার দেয় তাঁর কোম্পানি। কিন্তু কিছুদিন পরেই Cetus এই পেটেন্ট বিক্রী করে দেয় Roche Molecular System কে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। মালিস সাহেব তাতে যথার্থ কারণেই আহ্লাদিত হন নি যদিও ১৯৯৩ সালে পাওয়া নোবেল পুরষ্কার হয়ত তাঁর সম্মানহানিতে প্রলেপ লাগাতে সাহায্য করেছিল।
আসুন এই পদ্ধতিকে সহজভাবে বোঝার একটু চেষ্টা করা যাক। এটি একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া-এবং প্রতিটি চক্রে আছে তিনটি করে ধাপ। প্রতিটি চক্রের শেষে DNA’র সংখ্যা দ্বিগুণ হয় অর্থাৎ তৃতীয় চক্রের শেষে 2^3এবং ৩০ টি চক্র (যা স্ট্যান্ডার্ড বলে ধরা হয় ) শেষে DNA’র কপির সংখ্যা দাঁড়ায় 2^30 বা 10^9 – যা একেবারে কল্পনাতীত।
এবার চক্রের ধাপগুলি নিয়ে আলোচনা করা যাক
Denaturation বা বিকৃতকরণ-দুই ফিতেযুক্ত DNA কে ৯৫ ডিগ্রি তে উত্তপ্ত করা হয় যার ফলে তা এক ফিতের DNA তে পরিণত হয়। (তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় দুই ফিতের সংযোগকারী হাইড্রোজেন বন্ধন গুলি ভেঙ্গে যায়)।
Annealing বা সংযুক্তকরণ- এই ধাপে তাপমাত্রা আবার ৫০ থেকে ৬০ ডিগ্রিতে নামিয়ে আনা হয় কারণ primer সংযুক্তিকরণের জন্য এটাই সর্বোত্তম তাপমাত্রা ।
Elongation/extension বা প্রসারণ- এই শেষ ধাপে তাপমাত্রাকে আবার ৭২ ডিগ্রি তে নিয়ে যাওয়া হয় কারণ Taq DNA Polymerase এর কার্যক্ষমতার জন্য এই তাপমাত্রাই সর্বোত্তম ।
কি কি জিনিষের প্রয়োজন এই PCR পদ্ধতিতে ?
Target DNA-মানে যে DNA কে আপনি সম্প্রসারণ করতে চান যেমন ধরুন অপরাধক্ষেত্র বা crime scene থেকে সংগ্রহ করা এক ফোঁটা রক্ত।
Primer- এক ফিতে DNA’র ছোট ছোট টুকরো যাদের বানান (base sequence) Target DNA’র দুই প্রান্তিক base sequence এর পরিপূরক। এই Primer এর অবস্থান Taq Polymerase কে জানিয়ে দেয় যে কোথা থেকে DNA’র সংশ্লেষণ শুরু করতে হবে।
Enzyme- অর্থাৎ Taq DNA Polymerase
Nucleotide – অর্থাৎ A,T,G,C যাদের সাহায্যে Taq Polymerase DNA’র সংশ্লেষণ করবে।
এবার আসি আপনার কোভিড পরীক্ষার সার্টিফিকেটে-সেখানে তো PCR এর জায়গায় RT-PCR লেখা আছে। এটা তাহলে কি নতুন কোন পদ্ধতি? আসলে PCR শুধুমাত্র DNA’র ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য (উৎসেচকের নাম যে DNA Polymerase তাই তা শুধু DNA বানাতে সক্ষম)। কিন্তু Covid 19 তো একটি RNA virus-তাহলে উপায়? আমরা DNA থেকে transcription পদ্ধতিতে mRNA বানাতে পারি কিন্তু RNA থেকে DNA-সে তো প্রকৃতির বিরুদ্ধে হাঁটা।
আবার সেই সিংহলী রাজকুমারীর প্রবেশ। ১৯৭০ সালে RNA tumour virus থেকে দুই মার্কিন বিজ্ঞানী (ডেভিড বাল্টিমোর ও হাওয়ার্ড টেমিন) হঠাৎ করেই এক নতুন উৎসেচকের সন্ধান পেলেন। এই উৎসেচক RNA থেকে DNA’র কপি বানাতে সক্ষম (যাকে বলা হয় complementary DNA বা )। উল্টোপথে চলতে পারে বলে এই ভাইরাসদের নাম দেওয়া হল retrovirus. (পাঠকের জানা প্রয়োজন যে AIDS এর ভাইরাস যার পোষাকী নাম Human Immunodeficiency Virus বা HIV এই retrovirus গ্রুপের একটি অন্যতম সদস্য)। Transcription এর উল্টো পথে চলে বলে এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হল Reverse transcription এবং এই উৎসেচকের নাম দেওয়া হল Reverse transcriptase বা আমাদের পরিচিত RT.
এবার আসি কোভিড পরীক্ষায়। Reverse transcriptase উৎসেচকের সাহায্যে viral RNA কে cDNA তে পরিবর্তন করে তারপর সেই PCR এর সাহায্যে কোভিড এর সন্ধান। কম সংখ্যক PCR চক্রের পরেই যদি কোভিডের সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে যে আপনার শরীরে ভাইরাসের সংখ্যা বেশী। একে বিজ্ঞানীরা cycle threshold বা CT নাম দিয়েছেন। কাজেই CT’র সংখ্যা যত কম আপনার বিপদ তত বেশী।
শেষ করার আগে আসুন আমরা প্রণাম জানাই সেই সিংহলী রাজকুমারীদের আর সেই সব বিজ্ঞানীদের যাঁরা পকেটে রাখা চকলেট বার গলে গেলে তার কারণ অনুসন্ধানের পথে হাঁটেন। আশা করব মানবকল্যাণের জন্য এরকম বহু serendipity’র আগমন ঘটবে ভবিষ্যতে। ভাবুন তো এরকম না ঘটলে কি আমরা Jurassic Park দেখতে পেতাম?